স্মৃতিচারণ
আসাদ ছিলেন এক স্বাধীনতাকামী সৈনিক
শহীদ আসাদের সঙ্গে আমার পরিচয় ষাটের দশকেই। তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ছিলেন। নেতৃত্বস্থানীয় পদেও ছিলেন। তখন আমার ছাত্রজীবন শেষ হয়ে গেছে। সে সময় আমি শ্রমিক এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। আসাদকে তখন থেকেই আমি চিনতাম।
আসাদ ছিলেন একজন মুক্ত বিপ্লবী, মনেপ্রাণে তিনি বিপ্লবকে ধারণ করতেন। মার্কসবাদে বিশ্বাস করতেন সৎ, নিষ্ঠাবান এই মানুষটা। একই সঙ্গে তিনি বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন, আবার একই সঙ্গে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন কৃষক সংগঠনও করতেন। আসাদ বড় মাপের নেতা হতে পারতেন যদি তাঁর অকালমৃত্যু না হতো।
দেশের জন্য আসাদ প্রতিনিয়ত কাজ করেছেন। আমি তাঁর গ্রামের বাড়িতেও গেছি। মান্নান ভূঁইয়ার (১৯৭১ সালে শিবপুরে যাঁর নেতৃত্বে একটা বড় রকমের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল) খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন আসাদ।
সেদিনকার যে ঘটনাটি ঘটে—১৪৪ ধারা জারি করেছিল আইয়ুব খান সরকার। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে যাঁরা মিছিল নিয়ে বেরিয়েছিলেন, তাঁর মধ্যে আসাদ ছিলেন। আমি সে মিছিলে ছিলাম না, কারণ তখন আমি তো আর ছাত্র নই। কিন্তু আমি জানতে পেরেছি, আমার ভাই হায়দার আনোয়ার খান জুনু আসাদের পাশেই সামনের সারিতে ছিল। অল্প কিছুদূর থেকে একটা জিপ থেকে মিছিলকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে পুলিশ, আসাদ শহীদ হন।
আসাদ শহীদ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশটা একটা পুরো অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে উঠল। সারা দেশ নড়ে উঠল, কেঁপে উঠল, জেগে উঠল। এর আগে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেটা নতুন মাত্রা লাভ করল। এর আগে একটা ইতিহাস বলতে হয়, সেটা হচ্ছে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যে প্রথমে ৬ ডিসেম্বর ১৯৬৮ সালে তখনকার লাট ভবন ঘেরাও থেকে এই আন্দোলনের সূত্রপাত, তার পরে ৭ ও ৮ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে দেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়েছিল। তার পরে ২৯ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী হাট হরতালের ডাক দিয়ে ছিলেন। সেই মনোহরদীতে হাট হরতাল অর্গানাইজ করতে আসাদও সক্রিয় ছিলেন এবং সেখানে তিনি পুলিশের লাঠির বাড়ি খেয়ে আহত হন। তখনকার দিনে তো টেলিফোনও ছিল না, মোবাইল তো ছিলই না। এটা সকাল বেলার ঘটনা। মনোহরদী বাজারে এ ঘটনা ঘটেছিল এবং সেখানে কয়েকজন কৃষকও গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। আসাদও সেখানেই ছিলেন। সেখানে তিনি কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করতে গিয়ে, অর্থাৎ মওলানা ভাসানীর ডাকে হাট হরতাল পালন করতে গিয়ে আহত হয়েছিলেন। তিনি মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়েই এই খবর ঢাকায় পৌঁছানোর জন্য তিনি ঢাকায় চলে এসেছিলেন। কিছুটা পথ সাইকেল চালিয়ে এবং কিছু পথ ট্রেনে করে ঢাকায় এসছিলেন।
তখন আমরা একটা গোপন জায়গা থাকতাম। আমাদের একটা গোপন আস্তানা ছিল। আসাদ সাহেব সেটা চিনতেন, সে আস্তানায় এসে খবরটি দিলেন। আমার মনে আছে, সেখানে কাজী জাফর আহমদ ছিলেন। তিনিও খবরটি শুনলেন। তখন তিনি বিভিন্ন পত্রিকায়ও খবরটি দিতে গিয়েছিলেন। দৈনিক পাকিস্তান নামে একটা পত্রিকা ছিল (পরবর্তীকালে দৈনিক বাংলাদেশ), সেখানে নির্মল সেন কাজ করতেন সাংবাদিক হিসেবে। আসাদ যখন শহীদ হলেন, নির্মল সেন সেই খবরটি বর্ণনা করে বলছিলেন, ‘সেদিন সে এসেছিল খবর দিতে, আজ এলো খবর হয়ে।’ অর্থাৎ মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সেই যে কৃষক হাট হরতাল হয়েছিল, তার অর্গানাইজ করতে গিয়ে আহত অবস্থায় মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে এসেছিলেন খবর দেওয়ার জন্য। আর তার মাত্র অল্প কয়েক দিন পরেই, এক মাসও হয়নি, তিনি নিজেই খবর হয়ে এলেন! শহীদ হলেন আসাদ।
আসাদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে স্ফুলিঙ্গ জেগে উঠেছিল। আসাদের মৃত্যুর পরপরই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কয়েক দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করে, তার মধ্যে ২৪ জানুয়ারি হরতাল ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই ২৪ জানুয়ারির হরতাল তো হরতাল নয়, সে যেন এক বিরাট অভ্যুত্থান! এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে অনেক ওলটপালট হয়ে গেল। আইয়ুব খানের পতন ঘটেছিল। আইয়ুব খানের পতন ঘটানোর পেছনে বিশাল ভূমিকা রেখে গিয়েছিলেন আসাদ, নিজের জীবন দিয়ে।
আসাদের জানাজা হয়েছিল পল্টন ময়দানে। লোকে লোকারণ্য, একেবারে ভরা ছিল পল্টন ময়দান। উপস্থিত ছিল প্রায় দুই লাখ মানুষ।
আসাদের বড় ব্যাপার হচ্ছে, তিনি ছিলেন এক স্বাধীনতাকামী সৈনিক। কেবল জাতীয়তাকামী নন তিনি, একই সঙ্গে সমাজতন্ত্রটাকেও ধারণ করতেন। সেই আদর্শকে আমরা যেদিন বাস্তবায়িত করতে পারব, সেদিনই আসাদের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা জানানো হবে।
লেখক : সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, সিপিবি।