অভিমত
প্রশ্নবিদ্ধ ঢাকার বিমানবন্দর
নাম বদল হলেও দেশের প্রধান বিমানবন্দরের দুরবস্থা, দুর্নীতি আর অনিয়মের যেকোনো উন্নতি হয়নি, তার সবশেষ উদাহরণ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিয়ন স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন দিন কয়েকের জন্য। চলে যাওয়ার দিন গত বৃহস্পতিবার দুপুরেই তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ সময় আড্ডা হয়। বললেন, আগামী মার্চের শেষ সপ্তাহ আবার আসতে পারেন।
শনিবার ভোরে ফেসবুক খুলে দেখি তাঁর স্ট্যাটাস। লিখেছেন : ‘বাংলাদেশ থেকে ২৪ ঘণ্টার বেশি পথ পেরিয়ে বাড়ি ফেরার আনন্দের এক-তৃতীয়াংশ মাটি হলো স্যুটকেস খোলার পর; শিকাগো এয়ারপোর্টেই লাগেজের চেহারা বিশেষত তালার দিকে তাকিয়ে যে আশঙ্কা হয়েছিল- সেটাই সত্য হলো বাড়ি ফিরে ৷ স্যুটকেসটা খোলা হয়েছে এবং তাড়াহুড়ো করে সব কাপড় ফেরত রাখতে গিয়ে জোর করে ঠেলে দেওয়া হয়েছে- পরিণতি হচ্ছে স্যুটগুলো হয়েছে কাপড়ের দলা।শুধু তাই নয় সেখান থেকে উধাও হয়েছে একটা মূল্যবান জিনিস; অর্থমূল্যে তা বেশি নয় কিন্তু দরকারি৷এমন ঘটনা ঢাকা বিমানবন্দরে এই নিয়ে দুইবার ঘটল গত ছয় মাসে৷ আমার উদ্বেগটা চুরি করে নেওয়ায় যতটা তার চেয়ে বেশি নিরাপত্তা নিয়ে। আপনার ব্যাগ থেকে চুরি সম্ভব হলে সেখানে অনাকাঙ্ক্ষিত এমনকি নিষিদ্ধ জিনিস ঢুকিয়ে দেওয়াও সম্ভব৷ সেটা আবিষ্কৃত হবে ভিন্ন দেশে, বাকিটা কল্পনা করতে পারেন৷ যাত্রীর কী হবে সেটা বাংলাদেশের কর্তাব্যক্তিরা না ভাবতে পারেন, কিন্তু বিমানবন্দর হিসেবে ঢাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে আগেও প্রশ্ন উঠেছিল, দ্বিতীয় বার উঠলে তার পরিণতি দেশের জন্য ইতিবাচক হবে না ৷ ঘটনা ঘটার পর এই নিয়ে আলোচনার ঝড় না তুলে এখনই পদক্ষেপ নিন৷ আমার কত ক্ষতি হলো সেটা খুব সামান্য বিষয়, বাংলাদেশের কত ক্ষতির আশংকা সেই ভেবেই এই কথাগুলো৷’
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অত্যন্ত পরিচিত এবং প্রখ্যাত এই অধ্যাপক ও লেখকের স্ট্যাটাসটি বিমানমন্ত্রী, বিমানের এমডি অথবা সংশ্লিষ্টদের নজরে আসবে কি না জানি না, তবে কাকতালীয় ব্যাপার হলো, তিনি যেদিন ঢাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রওনা হন, ওইদিনই আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা এবং বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এক অনুষ্ঠানে বলেছেন,‘বিমানবন্দরের দুরবস্থা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে।’ বিমানবন্দর এবং বাংলাদেশে বিমানের অব্যবস্থাপনা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খোদ অর্থমন্ত্রীও। তাতে পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি।
অধ্যাপক আল রীয়াজের সবচেয়ে বড় শংকার জায়গা হলো, আপনার ব্যাগ থেকে কী খোয়া গেল তার চেয়ে বড় কথা ব্যাগের ভেতরে অবৈধ বা ভয়ঙ্কর কিছু যদি ঢুকিয়ে দেওয়া হয় এবং কোনো দেশে নামার পর চেকিংয়ে যদি ধরা পড়ে যে আপনার ব্যাগে ‘নিষিদ্ধ জিনিস’ রয়েছে, তাহলে আপনার কী পরিণতি হবে, ভেবে দেখেছেন?
শুক্রবারই একটি অনলাইন সংবাদপত্র রিপোর্ট করেছে, ঘুষ দিলে বিমানের ফ্লাইটে বোমা রাখাও সম্ভব। গোয়েন্দাদের বরাত দিয়ে ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে,‘কঠোর নিরাপত্তার মধ্যেও যদি বিমানের বিভিন্ন পয়েন্টে ও সিটের পাইপের মধ্যে ঘুষ দিয়ে চোরাই স্বর্ণ রাখা সম্ভব হয়, তাহলে একই ব্যক্তিকে ঘুষের পরিমাণ বাড়িয়ে দিলে একইস্থানে বিস্ফোরক রাখা অসম্ভব নয়।’ তাই জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের এই বিশ্বায়নের যুগে এটা খুবই উদ্বেগের বিষয় বলে শঙ্কিত গোয়েন্দারা।
গত ২৭ নভেম্বর হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে যাওয়ার পথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটিতে ত্রুটি ধরা পড়লে তুর্কমেনিস্তানে জরুরি অবতরণ করতে বাধ্য হয়। প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমানে ত্রুটি পাওয়ার পর নড়েচড়ে বসেন গোয়েন্দারা। যে বিমানের সিটের নিচের পাইপ থেকে এর আগে চোরাই স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়েছিল, সেই একই বিমানেই প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে যাচ্ছিলেন।
ঢাকার বিমানবন্দরের অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ বহুদিনের। একাধিক দেশ এখান থেকে পণ্য পরিবহন বন্ধও করে দিয়েছিল। নিরাপত্তা জোরদারের পর সেই পরিস্থিতি বদলেছে। কিন্তু তারপরও অনিয়ম যে পরতে পরতে রয়ে গেছে, তা আমরা নিয়মিত টের পাই। বিমানবন্দরে যাত্রীদের হারানো মালামালের সন্ধান পাওয়ার পর সেগুলো যেই বিভাগের নিরাপত্তায় থাকে অর্থাৎ লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড বিভাগের কর্মকাণ্ড নিয়েও সম্প্রতি রিপোর্ট হয়েছে। ওই বিভাগের ব্যবস্থাপনায় মারাত্মক অনিয়মের সন্ধান পান বিমানবন্দরের দায়িত্বে থাকা ম্যাজিস্ট্রেট। খবরে বলা হচ্ছে, স্টোর রুমের চাবি সংরক্ষিত জায়গায় না রাখায় অন্য বিভাগের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তা ব্যবহার করেন, যে কারণে সেখান থেকে মালামাল চুরির ঘটনা ঘটে।
এসব অনিয়মের বাইরে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের হাতে যাত্রীদের নাজেহাল হওয়ার ঘটনা বোধ হয় কিছুটা কমেছে। কারণ যাত্রী হয়রানি ও প্রতারণা বন্ধে বিমানবন্দরের দুজন ম্যাজিস্ট্রেট বেশ তৎপর বলে খবর বেরিয়েছে। বিমানবন্দরের ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের দায়িত্বে থাকা দুজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট যাত্রী হয়রানি, ব্যাগেজ কাটাছেঁড়া, লাগেজ হারানো, লাগেজ থেকে চুরি, অবৈধভাবে অর্থ আদায়সহ নানা অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন। কিছু অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অপরাধীদের শনাক্ত করে সাজা দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিপূরণও আদায় করা হয়েছে। এ রকম বাস্তবতায়ও যখন আমাদের অধ্যাপক আলী রীয়াজের মতো এক বিদগ্ধ মানুষের লাগেজ কেটে তার ভেতর থেকে জিনিসপত্র চুরি করে নেওয়ার খবর পড়তে হয়, সেটি শুধু দুঃখজনকই নয়, বরং জাতি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জারও। এমন খবরও আমাদের পড়তে হয়েছে যে, বিমানবন্দরের ওই দুই ম্যাজিস্ট্রেট বেশ কিছু অনিয়ম ও দুর্নীতি হাতেনাতে ধরায় এবং সাজা দেওয়ায় তাঁদের ওপর ক্ষেপেছেন অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তারপরও যাত্রী হয়রানি বন্ধ এবং বিমানবন্দরের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে এ রকম ম্যাজিস্ট্রেট আরো বেশি নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
প্রধামন্ত্রীর বিমানে ত্রুটির তদন্ত চলছে। এটা নাশকতার পরিক্ল্পনা বলেও সন্দেহ করা হচ্ছে। যদি সত্যিই তাই হয়, তাহলে এটা দেশের জন্য বড় অশনিসংকেত। অবস্থার উন্নতি না হলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আসতে বিদেশিরা তো বটেই, অধ্যাপক আলী রীয়াজের মতো মানুষও নিজ দেশে আসার ভরসা পাবেন না।
লেখক : সাংবাদিক।