গণমাধ্যম সর্বকালের বিরোধী দল
সাংবাদিকরদের কপালটাই খারাপ। যেখানেই যাক না কেন, যার চাকরিই করুক না কেন, ক্ষমতাবানদের খবর দিতে হয়, বিশেষ করে তাদের দুষ্কর্মের। সমস্যা হলো, ক্ষমতাবানরা অনেকেই সরকারঘনিষ্ঠ এবং সেই সব খবর ছাপা হলে ঝামেলা হয়, এমনকি সাংবাদিকের প্রাণও যায়। যেমন গেল শিমুলের। এটা পেশার দোষ। এই পেশায় রুজি করতে এসে আজ পর্যন্ত কেউ সরকারকে খুশি করতে পারেননি। কয়েকটি উদাহরণ দেখুন-
২. সমকালের শিমুলের প্রাণ গেল শাহজাদপুরের মেয়র বা তাঁর সমর্থকদের গুলিতে। সমকাল বিরোধী দলের সমর্থক কি? মামুনুর রশিদ চাকরি করে ‘বাংলাদেশ অবজারভার’ -এ, যার সম্পাদক হচ্ছেন ইকবাল সোবহান চৌধুরী যিনি প্রধানমন্ত্রীর গণমাধ্যম উপদেষ্টা। এই পত্রিকা ছাপল বাংলাদেশের ড্রাগ ব্যবসার ওপর খবর, যুক্ত করল চার নাম, যারা আবার সবাই সরকারি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই নিয়ে সংসদে কেবল হইচই হলো তা নয়, ইকবাল ভাইয়ের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার মামলাও হলো। আর রশিদকে পিছু লাগা একটা গাড়ি তাকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে গেল। সে এখন হাসপাতালে, বোঝা গেল কার দৌড় কতটা।
নাজমুল হুদা কাজ করেন একুশে টিভিতে, যার প্রধান হচ্ছেন মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল। তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থক সাংবাদিকদের অন্যতম নেতা। কিন্তু সাভারের গার্মেন্টস কারখানার ওপর রিপোর্ট করে জেল হাজত, রিমান্ড সবই খেতে হলো হুদাকে। এমনকি এটিএন নিউজের দুই সাংবাদিক পুলিশের হাতে বেধড়ক পিটুনি খেলেন রামপালবিরোধী হরতালের সংবাদ কাভার করতে গিয়ে।
তার মানে সাংবাদিকদের ওপর যা হচ্ছে তাতে স্টেশন বা মালিকের রাজনৈতিক অবস্থান বা সমর্থন দায়ী নয়। যেটা এই সংঘাত সৃষ্টি করছে, সেটা হচ্ছে, ক্ষমতাবানদের সঙ্গে গণমাধ্যম নামের যে কারখানা, তার চরিত্র ও পরিচয়।
৩. মিডিয়ার সঙ্গে ক্ষমতাবানদের দ্বন্দ্বটা কাঠামোগত, নীতিগত নয়। রাজনীতি তো নয়ই। যদি হতো তাহলে সরকারপন্থী গণমাধ্যমের সঙ্গে এই সব ঘটত না। সরকার অবশ্য এই সব ঘটনায় কিছুটা বিব্রত এবং বিষয়টা সহজ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। শিমুলের স্ত্রীকে চাকরি দেওয়া হয়েছে, মেয়র মিরুকে আটক, নাজমুল হুদাকে জামিন এবং মামুন গেছে হাসপাতালে। তা ছাড়া এটিএন নিউজের দুই সাংবাদিককে প্রহার করার জন্য পুলিশ কয়েকজনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে এবং ঢাকার পুলিশ কমিশনার টেলিভিশনে এসে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। যেসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত, তাঁদের বাদ দিয়ে সরকারও চলতে পারবে না। কিন্তু সমস্যাটা হলো গণমাধ্যম তার চরিত্রের কারণেই এই সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে যাতে সরকারপন্থী মানুষের নেতিবাচক খবর আসছে।
৪. সমস্যাটা সেখানেই। গণমাধ্যম সরকারবিরোধী নয়, ক্ষমতাবানবিরোধী। যারা মুনাফা বা ক্ষমতা অর্জনের জন্য আইন ভাঙে তাদের কথা গণমাধ্যম বলবেই। কারণ গণমাধ্যম সেটা না করলে বাজারে টিকবে না। মালিকরাও পড়েছে বিপাকে। কারণ, যে পুঁজি তাঁরা নিয়োগ করেছেন, সামাজিক মর্যাদা অর্জনের জন্য, সেটাও সম্ভব নয় এই ধরনের সংবাদ পরিবেশন না করলে। অর্থাৎ এই খবরই কেবল তাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে ভোক্তার কাছে, যার বিনিময়ে তিনি জনপ্রিয়তার মাধ্যমে সামাজিক মুনাফা অর্জন করেন। ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা চলে কিন্তু টিকে থাকার স্বার্থেই মালিকও বাধ্য হন ক্ষমতাবানবিরোধী খবর দিতে।
৫. আর গণমাধ্যমের কর্মীরা নিজেদের টিকে থাকার স্বার্থে এসব রিপোর্টিং করে। যদি যে দক্ষতা, যোগ্যতা ও বাজারে সুনাম না অর্জন করতে পারে তাহলে এই সেক্টরে সে চাহিদা হারাবে এমনকি চাকরি গেলে নতুন চাকরি পাবে না। অনিশ্চিত হয়ে পড়বে তাঁর বেঁচে থাকা। এই ধরনের ক্ষমতাবানদের জন্য বিব্রত থেকে বিপজ্জনক খবর করতে হয়। মালিকও সেটা গেলেন। কারণ, তিনি না খেলে অন্যকোনো গণমাধ্যম খাবে। এই কারণেই ক্ষমতাবানবান্ধব গণমাধ্যম বলে কিছু নেই। অতএব সবচেয়ে বড়লোক মালিক আর সাধারণ গণমাধ্যমকর্মী সবাই এই পেশার বিশেষত্যের কারণে ক্ষমতাবান এবং সরকারের নাখোশ বান্দায় পরিণত হয়।
৬. অতএব গণমাধ্যমের চরিত্রটা বোঝা দরকার। সে চাক আর না চাক সে বিরোধী ভূমিকা পালন করতে বাধ্য, যদি সে বাজারে টিকে থাকতে চায়। প্রভাবশালী সরকারপন্থী গণমাধ্যম একটি স্ববিরোধী কথা। যেমন বিরোধী দলপন্থী গণমাধ্যম। এটা থাকে যতদিন দলটি বিরোধী অবস্থানে থাকে। তাদের সমর্থক দল সরকারে গেলেও মালিকরা আবার সরকারি ক্ষমতাবান হয়ে যায়। কিন্তু গণমাধ্যম বিরোধীই রয়ে যায়। যদি ইজ্জত নিয়ে গণমাধ্যমের দুনিয়ায় টিকতে চায়। কোনো উন্নতমানের সাংবাদিক তোষামোদী কর্মী হয় না। একটা তালিকা করুন দেখতে পারবেন।
৭. ক্ষমতাবানদের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটে কারণ পরিস্থিতির দিকে কেবল গণমাধ্যমই জনপ্রশাসনের চেহারার দিকে তাকায় এবং জনসম্মুখে উপস্থিত করে। এটা বাস্তবতা।
রাজনৈতিক দল বিরোধী থেকে সরকারি দলে পরিণত হয় কিন্তু গণমাধ্যম আজীবন বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকে। সেটা গণমাধ্যমের মালিক বা কর্মী বা নেতা চাক আর না চাক। গণমাধ্যম তাই তার পেশার চরিত্রের কারণে এই বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ। যারা পেশার ধর্ম ও চরিত্র মেনে নেন তারা সরকারের তোষামোদী করে না। তারা ভাবে না যে সরকার পাল্টালে তাদের দিন পাল্টাবে। সর্বকালের বিরোধী দলের দিন পাল্টায় না।