অভিমত
রাষ্ট্রপতির ভাষণ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা
উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে সুদূর মফস্বল থেকে যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসি, সেদিন এক অদ্ভুত অভিবাদনের মুখোমুখি হই। রিকশা থেকে নেমে কলাভবনের দিকে যেতেই টের পাই মাথায় কিছু একটা পড়ল এবং সেটি মুখ বেয়ে নেমে এলো সাদা শার্টে। ওপরে তাকিয়ে দেখি, কয়েকটি পাখি। পাখির প্রতি আমার মমতা, ভালোবাসা, সংবেদনশীলতা সেই শৈশব থেকে। ফলে পাখিদের ওই অভিবাদন আমি গ্রহণ করি এবং বাথরুমে গিয়ে মুখ ও শার্ট ধুয়ে পরীক্ষার হলে যাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ব্যাপারে আমার ইচ্ছা এতটাই দুর্নিবার ছিল যে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরমও কিনিনি। ভর্তি পরীক্ষাও ভালো দিয়েছিলাম। কিন্তু ফল বেরোনোর পর দেখা গেল ওই তালিকায় আমার নাম নেই। এরই মধ্যে পক্সে আক্রান্ত হই। বেশ কিছুদিন শয্যাশায়ী। শেষমেশ ভর্তি হই বাড়ির পাশে বরিশাল ব্রজমোহন (বিএম) কলেজে, যেখানে অধ্যয়ন এবং পরে দীর্ঘ সময় অধ্যাপনা করেছেন জীবনানন্দ দাশ; পরবর্তী সময়ে আমার যাবতীয় পড়াশোনা আর আগ্রহের মূল কেন্দ্রে ছিলেন গত শতাব্দীর এই অদ্ভুত চরিত্র।
এর বহু বছর পর এবিসি রেডিওর এক অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রখ্যাত অধ্যাপকের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে না পারা সম্পর্কিত আমার দুঃখবোধ শেয়ার করি। তিনি আমার কাজ সম্পর্কে জানতেন। তাই তিনি হয়তো রসিকতা করে অথবা সিরিয়াসলিই বলেছিলেন, ‘এটা নিয়ে দুঃখ করার কিছু নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারোনি তো কী হয়েছে? একদিন এখানে তুমি পড়াবে।’ স্যারের ওই কথা এখনো আলোর মুখ দেখেনি বা সে চেষ্টাও আমি করিনি। কিন্তু শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তনে আমাদের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কথা শুনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমার দুঃখবোধটা নতুন করে জেগে উঠেছে।
ওই দিন আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ দুজন মানুষ, আমার সাবেক সহকর্মী সানাউল্লাহ লাবলু ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়ে জানতে চেয়েছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব করার মতো কী আছে?’ আর বিবিসির সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান আরেকটি স্ট্যাটাসের শেষ লাইনে লিখেছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে এই প্রতিষ্ঠান নিয়ে আমার কোনো গর্ব হয় না।’
পাঠকের সুবিধার্থে রাষ্ট্রপতির একটা লাইন এখানে উদ্ধৃত করি। তিনি বলেছেন, ম্যাট্রিকে পেলাম থার্ড ডিভিশন, ইন্টারমিডিয়েটে গ্রেস দিয়ে পাস! ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স পাওয়া তো দূরের কথা, ফরমই কিনতে পারিনি। ভাগ্যের কী খেলা, আমি আজকে ঢাকা ইউনিভার্সিটির চ্যান্সেলর।
বহুদিন ধরেই আমরা নানা ফোরামে একটা প্রশ্ন রাখছি যে, আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় বলে আসলে কিছু আছে কি না? বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন—বুয়েট বা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিলে অন্যান্য পাবলিক কিংবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আসলে কতটা বিশ্ববিদ্যালয়? সেখানে কারা শিক্ষক হন এবং কোন যোগ্যতায়? ক্লাসে তাঁরা আসলে কী পড়ান? নিজের ক্লাসে কতটা সময় দেন আর অন্য জায়গায় ক্ষ্যাপের কাজে কতটা সময় দেন? তা ছাড়া ভালো ফলই কি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার একমাত্র শর্ত? সেখানে দলীয় আনুগত্য কি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়? যিনি এ রকম দলীয় আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কিংবা ভিসি অথবা প্রোভিসি হন, তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের কী করে ন্যায়-অন্যায় শেখাবেন? তিনি কী করে প্রকৃত শিক্ষায় দীক্ষিত করবেন?
শিক্ষকরা সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত নাগরিক বলে পরিচিত। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যে রকম দলবাজি করেন, এমনকি টেলিভিশনের টক শোতে গিয়েও যেভাবে কোনো একটি পক্ষে নির্লজ্জ অবস্থান ঘোষণা করেন এবং যখন তাঁর কথার সঙ্গে একজন রাজনৈতিক কর্মীর কথার কোনো ফারাক থাকে না, তখন সেই শিক্ষককে কেন সমাজের মানুষ দল-মত নির্বিশেষে শ্রদ্ধা করবে?
বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ধরনের গবেষণা হওয়া দরকার, গবেষণার জন্য যে রকম বাজেট থাকার কথা, বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান ছাড়া তার কতটুকু আছে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালগুলোতে?
যে বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব তৈরির কারখানা, সেখানে বছরের পর বছর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। আবার যাঁরা ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি করেন, তাঁরা আসলে কী ধরনের রাজনীতি করেন এবং সেখানে কোন ধরনের নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে, তার একটা বড় উদাহরণ শনিবার বিকেলেই আমরা দেখেছি রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে; যার কয়েক ঘণ্টা আগেই রাষ্ট্রপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে প্রকৃত ছাত্রদেরই রাজনীতিতে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দোকানদারদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ নেতাদের চাঁদা চাওয়ার জেরে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বেশ কিছু দোকান জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সংঘর্ষে সাংবাদিকসহ অন্তত ২০ জন আহত হন বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। ওই ঘটনার পর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সব কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করে।
প্রশ্ন হলো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাহলে কী ধরনের ছাত্ররাজনীতির চর্চা চলছে? ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে কি এই পরিস্থিতি এড়ানো যেত? বলা মুশকিল। কারণ, নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় এবং কতটা স্বচ্ছ হবে, তার ওপরে নির্ভর করে ওই ছাত্র সংসদ আসলে কী করবে বা তারা নেতৃত্বের কতটা বিকাশ ঘটাতে পারবে? তা ছাড়া ছাত্রসংগঠনগুলোকে স্বাধীন বলা হলেও মূল সংগঠনই যেহেতু ছাত্রসংগঠন নিয়ন্ত্রণ করে, সুতরাং কেন্দ্র যেভাবে চাইবে রাজনৈতিক দলগুলোর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সেভাবেই চলবে। কেন্দ্র যদি মনে করতে থাকে যে তাদের ছাত্রসংগঠনগুলো রাজপথে প্রতিপক্ষ দমনের মূল হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহৃত হবে, তাহলে সেখানে কোনো নেতা নয়, বরং তৈরি হবে ক্যাডার; যারা একসময় নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হবে, কিন্তু তাদের কথায়-আচার-আচরণে নেতৃত্বের কোনো বালাই থাকবে না।
এত কিছুর পরও রাষ্ট্রপতির মতো আমারও ওই দুঃখবোধ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে না পারা। এখনো আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গা মনে হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। সুযোগ পেলেই একা একা ক্যাম্পাসে হাঁটি। কখনো স্ত্রী-সন্তান নিয়ে। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত… প্রতিটি ঋতুই যেন আলাদা করে মেলে ধরে এই ক্যাম্পাসের প্রকৃতি। কখনো এমনও মনে হয়, এই ক্যাম্পাসের কোনো গাছের নিচে বসে থাকতে থাকতেই যদি একদিন মরে যাই… তারপর যদি ফিরে আসি শঙ্খচিল শালিখের বেশে, মন্দ হয় না।
লেখক : সাংবাদিক