‘যাত্রী লীগ’ ও ‘রোগী লীগ’ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে
এক মাসের মধ্যে পাবলিক দুই-দুইটা বাড়ি খাইল। প্রথমে শ্রমিক ধর্মঘট করে দুদিনের জন্য যে ভোগান্তি হলো তা যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকা শ্রমিক পরিবহন সংস্থা করতে পারে সেটা ভাবা যায়নি। দোষটা পাবলিকের। ক্ষমতায় যে থাকে তার ‘ভোদাই’ পাবলিকের কথা চিন্তা করতে হয় না। তার মধ্যে শ্রমিক ধর্মঘটের নেতৃত্ব দিলেন একটা ফুল মন্ত্রী, যিনি আবার প্রাক্তন সমাজতান্ত্রিক; অন্যজন আধা মন্ত্রী যার নেতা একজন জাতীয় বেহায়া। কারোরই কিছুই এসে যায়নি, কারণ, পাবলিকের কোনো ক্ষমতা নেই, তাকে পাত্তা না দিলেও চলে।
এরপর এলো ডাক্তারদের ধর্মঘট। বগুড়ার এক হাসপাতালে রোগীর আত্মীয় ও ইন্টার্ন ডাক্তারের ঝামেলা হলো আর ডাক্তাররা সারা দেশে ধর্মঘট করল। সরকার শেষ পর্যন্ত এই ধর্মঘট পালনকারী ডাক্তারদের কাছে মাথা নিচু করে তাদের দাবি মেনে নিল। ডাক্তার ভাই ও বোনদেরকে হাজার সালাম, আপনারা দাবি আদায় করতে জানেন ও পেরেছেন। তা ছাড়া যেটা শিখিয়ে দিয়েছেন সেটা হলো, ‘জোর যার মুল্লুক তার’। অর্থাৎ ক্ষমতা আছে বলেই আপনাদের কথা সরকার শোনে, রোগীর ক্ষমতা নেই তাই তাদের সুবিধা-অসুবিধা দেখার দরকার নেই।
আপনাদের কাছে সেবা-টেবা বা জনগণের কষ্ট কোনো বিষয় না দেখে বেশ স্বস্তি হয়েছে। এটা একটা বড় শিক্ষা।
অসুবিধা কেবল একটু আমাদের, যারা আপনাদের কাছ থেকে সেবা পাওয়ার জন্য হাত-পা ধরি। পরিবহন শ্রমিকই হোক আর ডাক্তারই হোক পাবলিককে কেউ পাত্তা দেয় না। দেবেই বা কেন, পাবলিকের তো কোনো ক্ষমতা নেই। সে তো পাঁচ বছরে একবার ভোটার হয়, আর তারপর সে আবার পাঁচ বছর পর একদিনের জন্য একটু কদর পাওয়ার অপেক্ষা করে। এর মাঝখানে পাবলিক বলে কিছু আছে বোঝা যায় না। অতএব পাবলিককে বাদ দিয়ে চলাই ভালো।
শ্রমিক আর ডাক্তারের ক্ষমতার উৎস তাঁদের রাজনৈতিক সংগঠন। জনগণের ক্ষমতার উৎস হওয়া উচিত রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু এই দুই ধর্মঘটে প্রমাণ হয়ে গেল জনগণ আসলেই ফালতু। তাদের স্বার্থ রক্ষা করার কেউ নেই। সরকার যখন শ্রমিক আর ডাক্তারের সঙ্গে দরকষাকষি করে, তখন পাবলিকের কথা চিন্তা করে এটাতেও প্রমাণ মেলেনি। যদি মিলত তাহলে তো ধর্মঘটই হতো না।
তাই নিরুপায় হয়ে ‘যাত্রী লীগ’ ও ‘রোগী লীগ’ গঠনের পরামর্শ দিচ্ছি। আপনি যদি সরকারের অসুবিধা করার ক্ষমতা না রাখেন আপনারে সরকারসহ কেউ পাত্তা দেবে না।
‘যাত্রী লীগ’ ও ‘রোগী লীগ’-এর খসড়া মেনিফেস্টো এখানে দেওয়া হলো :
১. হরতাল করার আগে পাবলিকের কাছে লিখিত অনুমতিপত্র নিতে হবে। সেই অনুমতিপত্র স্বচ্ছ হাতের লেখায় লিখিত হতে হবে, বিশেষ করে ডাক্তারদের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের নির্দেশ মোতাবেক। শ্রমিকরা না লিখতে পারলে তাদের মৌখিকভাবে ফোনে আবেদনটি পাবলিককে জানাতে হবে। বিনা অনুমতিতে হরতাল করলে তাদের মোবাইল ফোনের লাইন বন্ধ করে দেওয়া হবে তিন মাসের জন্য।
২. ডাক্তার, ড্রাইভার ও মালিকদের সবাইকে কর সার্টিফিকেট সঙ্গে রাখতে হবে যাতে চাহিবামাত্র রোগী ও যাত্রী বুঝতে পারে তাদের ইনকাম কী রকম এবং ভিজিট ও ভাড়ার সঙ্গে করের মিল আছে কি না।
৩ প্রত্যেক ডাক্তারকে রোগী দেখার আগে এবং ড্রাইভারকে গাড়ি ছাড়ার আগে জাতীয় সংগীত গেয়ে শোনাতে হবে, যাতে বোঝা যায় এরা বাংলাদেশের নাগরিক এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। প্রয়োজনে তাদের রাজনৈতিক আদর্শ লিখিতভাবে দেয়ালে ও গাড়িতে টাঙিয়ে রাখতে হবে।
৪. গাড়ির মালিককে নিয়মিতভাবে বাসে বা ট্রাকে থাকতে হবে। যাতে করে অ্যাক্সিডেন্ট হলে জনগণ তাকে ধরতে পারে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। কেবল ড্রাইভার আর হেলপারের ওপর গাড়ি ছেড়ে দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। প্রতিটি বাসে ভ্রাম্যমাণ সালিসের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে ড্রাইভিং পছন্দ না হলে তৎক্ষণাৎ শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়।
৫. ডাক্তাররা যে ওষুধ রোগীকে দেবে তা নিজেরা খেয়ে রোগীকে নিশ্চিত করতে হবে। এমন কোনো চিকিৎসা করা চলবে না যেটাতে ডাক্তারদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নেই।
৬. ডাক্তার ও শ্রমিকের সব ইউনিয়নকে এক-তৃতীয়াংশ সদস্য রোগী ও যাত্রীদের জন্য ছেড়ে দিতে হবে। প্রতি মাসে সাতদিন অর্ধমূল্য বা বিনামূল্যে গাড়িতে ভ্রমণ করার অধিকার দিতে হবে। একইভাবে ডাক্তারদেরও সপ্তাহে দুদিন বিনামূল্যে রোগী দেখতে হবে।
আপাতত এগুলো হচ্ছে খসড়া দাবি। কিন্তু ‘যাত্রী লীগ’ ও ‘রোগী লীগ’ বর্তমানের দাবি ও বাস্তবতা। বর্তমান সরকার সব সময় বলেছেন, তারা জনগণের পক্ষের সরকার, কিন্তু দুই ধর্মঘটে প্রমাণ করে দিল যে তাদের অঙ্গসংগঠনগুলো কতটা শক্তিশালী এবং চাপের মুখে সরকার কতটা ছাড় দিতে প্রস্তুত। আজকে বাংলাদেশে পাবলিকের কোনো অস্তিত্ব নেই, যার কথা শুনতে সরকার দায়বদ্ধ। কেবল রাজনৈতিক সংগঠন ও উপসংগঠনকেই সরকার পাত্তা দিতে প্রস্তুত। সেটা অল্প শিক্ষিত শ্রমিকই হোক বা পাবলিকের টাকায় পড়া ডাক্তারই হোক। সেই কারণেই বেঁচে থেকে চলাফেরা করার জন্য ‘যাত্রী লীগ’ ও ‘রোগী লীগ’ প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া উপায় নেই।
পাবলিকের বন্ধুও নেই, বাপও নেই। তাই ‘লীগ’ ছাড়া গতি নেই।
লেখক : গবেষক ও সাংবাদিক