২৫ মার্চের স্মৃতি
সেদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল
আমি তখন ক্যাম্পাসে থাকতাম, আমার যত দূর মনে পড়ে ফুলার রোডের ১৩ নম্বর বাড়িটার খুব সম্ভবত তিন তলায়। ২৫ মার্চ আমরা বিকেল ৪-৫টায় বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাসায় যাই। বঙ্গবন্ধু তখন সবাইকে নানান উপদেশ দিচ্ছিলেন। বিশেষ করে আমরা যারা শিক্ষকরা গিয়েছিলাম। আমি তখন শিক্ষক সমিতির উপরের স্তরের সদস্য। তো উনি আমাদেরকে বললেন যে, শিক্ষকদের উপরে তো ওদের আক্রোশ, আপনারা শিক্ষকরা সাবধানে থাকবেন। আর যতটা সম্ভব যদি পারেন নিজ বাড়িতে না থেকে অন্য জায়গা থাকবেন। তো আমি ও আমরা বললাম যে, বঙ্গবন্ধু আপনারও তো তাই উচিত। আপনারও তো ৩২ নম্বরে থাকাটা নিরাপদ না। আপনি অন্যত্র কোথাও সরে যান। বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন যে, আমি চলে গেলে তো সারা বাংলাদেশে আগুন জ্বলবে। আমাকে খোঁজ করবার জন্য। তাঁর তো অন্য ধরনের ফিলোসফি। তাকে তো আর বেশি বলা যায় না।
এরপর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সন্ধ্যায় আনুমানিক ৯টার দিকে বাসার দিকে রওনা দেই। তো আমি সাড়ে ৯টা, ১০টার দিকে বাসায় ফিরলাম। বাসায় আমার এক কাজিন ছিল যে জগন্নাথ হলে থাকত। সে সাধারণত সন্ধ্যার সময় বাসায় চলে আসত, খাওয়া-দাওয়া করত। কিন্তু সেদিন এসে শুনলাম ও খেয়ে হলে আবার চলে গেছে। আমি বললাম কাজটা তো ভালো হলো না। এরপর হঠাৎ গুলির শব্দ, মেশিনগানের আওয়াজ শুনতে পেলাম, সেগুলোর সঙ্গে তো পরিচিত ছিলাম না আমি। এগুলোর অভিজ্ঞতা তো আগে থেকে ছিল না। তো মনে হলো যে বিভিন্ন ধরনের আওয়াজ আর ট্যাংকের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আমি জানালা দিয়ে উঠে একটু তাকালাম, দেখলাম যে এক ধরনের গাড়ি যাচ্ছে। কামান ফিট করা।
রাত ১২টা থেকেই গুলাগুলি শুরু হলো। আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে গেলাম আমরা। আমাদের ফ্ল্যাটে দুটো রুম ছিল, দুটো দরজা, একটা দিয়ে ঢুকলে ড্রইং রুমের ভিতর দিয়ে চলে আসা যায়। আরেকটা পাশেই সাইড দরজা আছে, সেইটা দিয়ে কিচেনের ওখান দিয়ে আবার বাসায় প্রবেশ করা যায়। আমার হঠাৎ মনে হলো, আজকের রাতটা খুব খারাপ। তাই আমি ওই ড্রইং রুমের দরজায় একটা তালা দিলাম আর কিচেনের দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। ড্রইং রুমের দরজার যে ছিটকিনিটা সেটা খুলে দিলাম। অর্থাৎ বাইরে থেকে দেখলে যেন মনে হয় কেউ নেই। এই রকম একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করলাম। তারপর সারা রাত ধরে আমরা ফ্ল্যাটের মধ্যে যে জায়গাটা মনে করলাম যে, চতুর্দিক দিয়ে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা কিচেন এবং বাথরুমের এর মাঝে একটা জায়গা আছে, মোটামুটি সেইখানে আমরা বাসার যে কয়জন সবাই চিত, উপুর হয়ে শুয়ে রইলাম। সারা রাত ধরেই এই অভিজ্ঞতা।
পরের দিন ছিল ২৬ মার্চ, সেদিন কারফিউ। কাজেই বের হতে পারলাম না। তো বাইরে দেখলাম যে অনেক লাশ পড়ে আছে। বেশির ভাগই লুঙ্গিপরা। খুব সম্ভব আমার মনে হয় ইকবাল হলে ছাত্ররা আমাদের এলাকা নিরাপদ মনে করে দেয়াল টপকে আমাদের এলাকায় আসছিল এবং সেই সময় তারা গুলিতে মৃত্যুবরণ করে। তো ২৬ মার্চ সারাদিন কারফিউ ছিল। আমরা সারাদিন ঘরে বন্দি থাকার কারণে কেবল আকাশবাণী শুনছিলাম। ওরা বলছে যে, পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। আর রাত্রে বিবিসি শুনলাম, রেডিও অস্ট্রেলিয়া শুনলাম। তো এই হলো মোটামুটি অভিজ্ঞতা।
পরের দিন যখন ২৭ মার্চ কারফিউ উঠিয়ে নেওয়া হলো, সে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি। আমরা তখন বুঝতে পারছি যে এই এলাকায় থাকা নিরাপদ না। কোন দিকে যাওয়া যায় তাই ভাবছি, সঙ্গে আমার স্ত্রী, মা আরো দুই-চারজন। এই কথা ভাবছি তারপর এমন সময় আমার এক কলিগ এলেন। তিনি বললেন, অজয় এখানে থাকা সেফ না। আমার গাড়ি আছে, আমরাও বেরিয়ে পড়েছি, তোমরাও বেরিয়ে পড়। আমি তাঁকে বললাম যে, স্যার আমার তো যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। তিনি বললেন, আপাতত আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে চলো। এটা হচ্ছে এখন যে আবুল মনসুর রোড, সেইখানে একটা ফ্ল্যাটে আমরা আশ্রয় নিলাম।
পরের দিন ২৭ মার্চ দুই গাড়ি মিলিটারি আমাদের এলাকায় ঢুকল। ঢুকে আমাদের এলাকায় কয়েকটা ফ্ল্যাটে ওরা ঢুকে আমাদের কয়েকজন কলিগকে ওরা মারল। এটা চোখের সামনেই আমি দেখলাম। আমাদের মেডিকেল অফিসার ছিলেন মোর্তাজা সাহেব। উনি বেরিয়ে ছিলেন কী জন্য যেন, তো উনার ফ্ল্যাট থেকে উনাকে ডেকে গলা ধাক্কা দিয়ে দিলেন, কিন্তু তাকে মারলেন না। মেডিকেল অফিসার পরিচয় দেওয়াতেই হয়তো তিনি রক্ষা পেলেন। সেই দিনই ২৭ মার্চে আমাদের ওখানে প্রায় ১০-১২ জনকে হত্যা করেছিল মিলিটারিরা।
২৫ মার্চ দিনটি গণহত্যা দিবস হিসেবে এত দিন পরে স্বীকৃতি পেল, বিশ্ব যেন স্বীকৃতি দেয় সেই ব্যবস্থাও করতে হবে। পৃথিবীতে অনেক গণহত্যা দিবস আছে। তারমধ্যে এটা একটা হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
লেখক : শিক্ষাবিদ