স্বাধীন ভাবনা
চাই সর্বজনীন গণতন্ত্র
প্রথমেই গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি স্বাধীন বাংলাদেশের ঘোষণা নিয়ে যাঁরা ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল বিশ্ববাসীর সামনে সরকার ঘোষণা করে, নয় মাস যুদ্ধ পরিচালনা করে বাংলাদেশকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দখল থেকে মুক্ত করেছিলেন। স্মরণ করি মুক্তিযোদ্ধাদের, যাঁদের সাহস, ত্যাগ ও সশস্ত্র কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। স্মরণ করি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচালনায় গঠিত সেদিনের ছয় দফা আন্দোলনভিত্তিক বাঙালি, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে। স্মরণ করি সাহসী লেখক, শিল্পী ও সাংবাদিকদের, যাঁদের মেধা, শ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল আমাদের সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের চিন্তা-চেতনা। আমার মনে হয়, ইতিহাসকে যাঁরা খণ্ডিত করেন, বিকৃত করেন, দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেন, তাঁরা রাষ্ট্র-জাতি ও জনগণের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কাজ করেন।
আমাদের চিন্তা-চেতনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ভবিষ্যৎ-ভাবনাকে পুনর্গঠিত করতে হবে আওয়ামী মুসলিম লীগের ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচি (১৯৪৯), যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা কর্মসূচি (১৯৫৪), আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচি (১৯৫৫), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচি (১৯৫৭), আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচি (১৯৬৬), ছাত্র সংগ্রাম কমিটির ১১ দফা কর্মসূচি (১৯৬৯), ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিলের ঘোষণা ও পরবর্তী ঘোষণাবলি ইত্যাদির ধারাবাহিকতায়। আজকের অবস্থা ভিন্ন, কর্মসূচিও ভিন্ন হবে। ১৯৭২ থেকে আজ পর্যন্ত রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে আমাদের আত্মশুদ্ধির অনুশীলনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি ও সক্রিয় করা দরকার। রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক কর্মকাণ্ডকে পতনশীলতা থেকে উত্থানমুখী ধারায় উত্তীর্ণ করতে হবে। মিথ্যা ও ভ্রান্তির প্রতি জনগণের মধ্যে ঘৃণা জাগা দরকার। সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের প্রতি জনগণের অনুরাগ ও সমর্থন দরকার। অমানুষের প্রতি ঘৃণা আর মানুষের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা সমর্থন দরকার।
আজ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আমার মনে জাগছে, একা একলা আমি অসহায়, অনেকের সমর্থন ও সহায়তা লাভ করে আমিও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারি, আমার শক্তিতে জাতি শক্তিশালী হতে পারে। এ মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে আমেরিকার স্বাধীনতা-যুদ্ধকালীন রাষ্ট্রচিন্তক Thomas Pain-এর একটি উক্তি :
No country can be called free, which is governed by an absolute power and it matters not whether it be an absolute royal power or an absolute
Legislative power as the consequence will be the same to the people.
নির্বাচনকে গণতন্ত্র মনে করা কিংবা গণতন্ত্রকে নির্বাচন মনে করা জনগণের জন্য মারাত্মক ভুল। এই ভুলটাই আমরা, এ দেশের জনগণ করে চলেছি। আমরা চাই, সর্বজনীন গণতন্ত্র। আর্থসামাজিক-রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক সর্বজনীন গণতন্ত্র। আমরা ভুল পথ থেকে শুদ্ধ পথে উত্তীর্ণ হব—এই আমাদের শপথ। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতাকে আমরা অর্থপূর্ণ করব। রাষ্ট্রকে আমরা জনমনের রাষ্ট্ররূপে গড়ে তুলব।
লেখক : সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।