অভিমত
বৈশাখী ভাতার খবর কী?
গত বছরের চৈত্র মাসের শেষদিকে যখন পয়লা বৈশাখ সামনে রেখে সবখানে ইলিশ কেনার ধুম এবং আমরাও টেলিভিশনে ইলিশ নিয়ে নানা রকম উন্মাদনার খবর প্রচার করছিলাম, তখন কাকতালীয়ভাবে মোবাইল ফোনে একটা এসএমএস দেখে চমকে উঠি। ব্যাংক থেকে আসা ওই এসএমএসের বিষয় ছিল, আমার অ্যাকাউন্টে ১০ হাজার টাকা ঢুকে গেছে। ভেবে পাচ্ছিলাম না, এটা কিসের টাকা। বৈশাখী ভাতা? কই, সাংবাদিকদের জন্য কোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান বৈশাখী ভাতা চালু করেছে বলে তো শুনিনি। তাহলে এটা কিসের টাকা? সন্দেহ দূর করতে অফিসের অ্যাকাউন্ট সেকশনে ফোন করে জানলাম, ওটা বৈশাখী ভাতা নয়, মাস কয়েক আগের বিশেষ দিবসে কাজ করার বিল।
তবে বৈশাখী ভাতা না হলেও ভুলে যাওয়া ওই অর্থটি অপ্রত্যাশিতভাবে পাওয়ার আনন্দ ছিল দারুণ এবং বলা যায়, গত বছরের পয়লা বৈশাখের দিনটি কিছুটা হলেও রঙিন হয়ে উঠেছিল ওই টাকায়। তবে সেটা যদি আসলেই বৈশাখী ভাতা হতো, তাহলে এবারও সেই টাকাটা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতাম এবং ১০ হাজার টাকায় একজোড়া ইলিশ কেনার বিলাসিতা না করলেও বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিনটিকে অন্য উৎসবগুলোর মতোই রঙিন ভাবা যেত।
বৈশাখে কেন এই ভাতার প্রশ্ন বা প্রসঙ্গ এলো? বলা হয়, ঈদ হচ্ছে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। সে রকম দুর্গাপূজা হিন্দুদের, বড়দিন খ্রিস্টানদের। অন্য ধর্মাবলম্বীদেরও এ রকম নিজস্ব নানা উৎসব রয়েছে। কিন্তু এই ধর্মপরিচয় ছাপিয়ে এই ভূখণ্ডের মানুষের কি অভিন্ন কোনো উৎসব থাকবে না? যদি থাকে তাহলে সেটি কোন উৎসব? অবশ্যই সেই সর্বজনীন উৎসবের নাম ‘পয়লা বৈশাখ’। অর্থাৎ বাংলা বর্ষবরণ। যেখানে কোনো ধর্মীয় রীতিনীতি বা আচার-অনুষ্ঠানের সীমাবদ্ধতা নেই। যেখানে সব ধর্মের মানুষ একটা অভিন্ন উৎসবে মেতে ওঠার সুযোগ পায়। সুতরাং যদি ধর্মীয় উৎসবের জন্য আমরা বছরে একাধিক ভাতা পাই, তাহলে কেন আমাদের সর্বজনীন উৎসব পয়লা বৈশাখে উৎসব ভাতা পাব না?
এ চিন্তা থেকেই ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বৈশাখী ভাতা চালুর ঘোষণা দেয় সরকার। প্রস্তাবিত ওই বেতন কাঠামোয় বলা হয়, প্রত্যেক সরকারি চাকরিজীবী তাঁর মূল বেতনের ২০ শতাংশ ‘বাংলা নববর্ষ ভাতা’ হিসেবে পাবেন। সব ধর্মের সরকারি কর্মচারীদের নববর্ষে বাড়তি এই উৎসব ভাতা ঘোষণা করা হলেও সরকারের তরফে অনুরোধ ছিল, যাতে বেসরকারি পর্যায়েও এটি বাস্তবায়ন করা হয়। সরকারি চাকরিজীবীদের পাশাপাশি ভবিষ্যতে বৈশাখী বোনাসকে সর্বজনীন করতে সবার জন্য এটি বাধ্যতামূলক করা হতে পারে বলে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী অবশ্য ইঙ্গিত দিয়েছেন। যদিও এটি বাস্তবায়নের আগেই গোঁফে তেল দিয়ে লাভ নেই।
আশার কথা হলো, এবার বেশ কিছু বেসরকারি খাত বাংলা নববর্ষের ভাতা দেওয়ার প্রক্রিয়া চালু করেছে। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে বলা হয়েছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত মেঘনা পেট্রোলিয়াম কোম্পানি তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ২০ শতাংশ বৈশাখী বোনাস দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকসহ রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, রূপালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকও তাদের কর্মীদের মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে বাংলা নববর্ষ ভাতা দিচ্ছে। একই হারে বেসরকারি খাতের বেশ কিছু ব্যাংক এই ভাতা দিয়েছে বলে খবর মিলেছে। কিন্তু এর বাইরে যে বিপুলসংখ্যক বেসরকারি খাত ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেখানে বৈশাখী ভাতা চালুর প্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি। শোনা যাচ্ছে, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) বৈশাখী ভাতা দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্র, অনলাইন নিউজপোর্টাল ও টিভি চ্যানেলকে চিঠি দিয়েছে।
বাস্তবতা হলো, এ ধরনের ভাতা দেওয়ার ফলে প্রতিষ্ঠানের প্রতি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব এবং আন্তরিকতা বাড়ে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ে কাজের ক্ষেত্রে। অসন্তুষ্টি বা অতৃপ্তি নিয়ে যিনি কাজ করেন, তাঁর কাজের মান আর যিনি সন্তুষ্টি এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি শতভাগ আনুগত্য ও ভালোবাসা নিয়ে কাজ করেন, তাঁর কাজের মান কখনো সমান হতে পারে না।
এটা ঠিক যে, একটি প্রতিষ্ঠান যখন এ রকম বিশেষ ভাতা চালুর সিদ্ধান্ত নেবে, তাকে তখন ভাবতে হয় পুরো প্রতিষ্ঠানের সব কর্মীর কথা। যদি জনপ্রতি গড়ে পাঁচ হাজার টাকাও বৈশাখী ভাতা দিতে হয়, তাহলে যে প্রতিষ্ঠানের কর্মীর সংখ্যা ২০০, সেখানে বছরে অতিরিক্ত খরচ দাঁড়াবে ১০ লাখ টাকা। তার মানে প্রতিষ্ঠানকে এই ১০ লাখ টাকা হয় বাড়তি আয় করতে হবে অথবা মালিককে ভর্তুকি দিতে হবে। এখন সব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এই বাড়তি ব্যয় করার সক্ষমতা রয়েছে কি না?
পক্ষান্তরে এটিও ঠিক যে, যখন কোনো প্রতিষ্ঠান তার কর্মীদের জন্য এই বাড়তি ১০ লাখ টাকা খরচ করে, তখন কর্মীদের মধ্যে যে বাড়তি কর্মস্পৃহা তৈরি হয়, সেটিকে যদি আমরা টাকায় রূপান্তর করতে পারি, তাহলে তার পরিমাণ নিশ্চয়ই ১০ লাখ টাকার বেশি হবে। যেমন প্রতিবছরের শুরুতে যদি আপনি আপনার প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য একটা গণভোজের আয়োজন করেন, যেখানে সবাই পরিবারসহ আমন্ত্রিত থাকবে, তাহলে এই অনুষ্ঠানটির জন্য কর্মীরা পুরো বছর অপেক্ষা করবেন। এবং এই একটি দিনের আনন্দ উচ্ছ্বাস পরবর্তী দিনগুলোয় কাজের যে গতি বাড়াবে, সেটিরও অর্থনৈতিক মূল্য রয়েছে।
একজন কর্মী নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে যাবেন, কাজ করবেন এবং আট ঘণ্টা শেষ হলে বাসায় চলে যাবেন—নিশ্চয়ই এ রকম রোবটিক কাজ আমরা কেউই পছন্দ করি না। যেসব প্রতিষ্ঠান এ রকম রোবটিক স্টাইলে চলে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেখানের কর্মীরা মানসিকভাবে ওই প্রতিষ্ঠানকে ওউন করেন না। হয় তিনি রুটি-রুজির জন্য কাজ করেন অথবা তাঁর আর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু যেসব প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের জন্য নানা রকম আনন্দ-বিনোদনের ব্যবস্থা রাখে, সময়ে সময়ে তাদের পেছনে কিছু পয়সা খরচ করে, এ রকম উৎসব-পার্বণে সামান্য হলেও কিছু ভাতার ব্যবস্থা করে, সেসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা সব সময়ই একটা জব সিকিউরিটি বোধ করেন, প্রতিষ্ঠানের প্রতি একটা বাড়তি দায় অনুভব করেন। প্রতিষ্ঠানের দুঃসময়েও তার পাশে থাকেন। ফলে আপাতদৃষ্টিতে যদি মনেও হয় যে, বৈশাখী ভাতা দেওয়ার ফলে বছরে প্রতিষ্ঠানের একটা মোটা অঙ্কের অর্থ ‘গচ্চা’ যাচ্ছে, কিন্তু আখেরে এর ফল সুদূরপ্রসারী।
আপনি আপনার কর্মীর কাছ থেকে সর্বোচ্চ ভালো কাজটি যেমন প্রত্যাশা করেন, তেমনি আপনার কর্মীও আপনার কাছ থেকে একই সঙ্গে পেশাদারিত্ব এবং ভালোবাসা—দুটিই কামনা করেন।
আশা করব, আগামী পয়লা বৈশাখে দেশের সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই ঈদ-পূজাসহ অন্যান্য উৎসবের মতোই বৈশাখী ভাতাও পাবেন। আগুনমূল্যের রুপালি ইলিশ না হোক, অন্তত পরিবার-পরিজনের জন্য সুতির কাপড়ের লাল-সাদা পোশাকের পয়সাটাও যদি হয়, তাও অনেক এবং তাতেই আমরা খুশি।
বৈশাখী ভাতায় আরো রঙিন হয়ে উঠুক আমাদের প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ।
লেখক : সাংবাদিক