অভিমত
বিরুদ্ধ স্রোতের বিপরীতে উৎসবের জয়
এবার বর্ষবরণে কয়েকটি বিষয়ে কড়া নির্দেশনা ছিল। যেমন ১. বিকাল ৫টার পরে উন্মুক্ত স্থানে এবং সন্ধ্যার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো অনুষ্ঠান করা যাবে না। ২. মোটরসাইকেলে চালক ছাড়া কেউ থাকতে পারবে না। ৩. উৎসবে নারীরা ভ্যানিটি ব্যাগ বহন করতে পারবেন না। ৪. ভুভুজেলা (একধরনের উচ্চশব্দের বাঁশি) বাজানো যাবে না। ৫. মঙ্গল শোভাযাত্রায় মুখোশ হাতে নিয়ে হাঁটতে হবে।
এবার দেখা যাক এসব নির্দেশনা মানুষ আসলে কতটা মেনেছে বা পয়লা বৈশাখ দিনব্যাপী রাজধানী ঢাকার চিত্র কেমন ছিল?
১. বিকেল ৫টার মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ করতে হবে বলা হলেও বিকাল সাড়ে ৫টার পরে আমি বাসা থেকে অফিসে যাওয়ার পথে দেখেছি তেজগাঁও এলাকায় একটি অনুষ্ঠানের মাইকে ঘোষণা চলছিল, মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের মাঝে এসে উপস্থিত হবেন।
২. রাজধানীর অন্যতম প্রধান বিনোদনকেন্দ্র হাতিরঝিলে সন্ধ্যার পরে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয় এমনকি সেই দৃশ্য সরাসরি টেলিভিশনে দেখানোর জন্য হাতিরঝিলের একটি সেতুতে উঠতে আমাদের রিপোর্টারের সময় লাগে ঘণ্টা দেড়েক। অথচ আমাদের অফিস থেকে হাতিরঝিল হাঁটাপথ। রাত ৮টার পর পরিস্থিতি এতই খারাপ হয়ে যায় যে, কাউকে ঢুকতে দেওয়া তো দূরে থাক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী লোকজনকে হাতিরঝিল থেকে বের করে দিতে থাকে।
৩. মোটরসাইকেলে শুধু চালক নয়, ঢাকার বিভিন্ন সড়কে মোটরসাইকেলের দুজন, তিনজন এমনকি গাদাগাদি করে চারজনকেও বসতে দেখেছি, বিশেষ করে তরুণদের।
৪. উৎসবে ভ্যানিটি ব্যাগ বহন করা যাবে না-এমন নির্দেশনা না জেনে আবার অনেকে জেনেও ব্যাগ নিয়ে গেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের ব্যাগ চেক করে অনুষ্ঠানস্থলে ঢুকতে দিয়েছেন।
৫. সারা শহরেই অলিতে-গলিতে কিশোর-তরুণরা অব্যাহতভাবে ভুভুজেলা বাজিয়েছে। পাড়ায়-মহল্লায় যেসব মেলা বা আনন্দ-আয়োজন হয়েছে, সেখানে ভুভুজেলাসহ নানারকম বাঁশির আওয়াজে মুখরিত ছিল।
৬. মঙ্গল শোভাযাত্রায় মানুষের হাতে হাতে মুখোশ ছিল। ঢাকার বাইরের অনেক শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা মুখোশ পরে থাকলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের হওয়া প্রধান মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের বেশির ভাগই মুখোশ হাতে নিয়ে হেঁটেছেন।
এই ঘটনাগুলো আমাদের কী বার্তা দেয়?
১. উৎসবে করণীয়-বর্জনীয় বিষয়ে যত নির্দেশনাই দেওয়া হোক না কেন, মানুষ এসব উৎসবের আমেজ নিজের মতো করে উপভোগ করতে চায়।
২. জঙ্গি হামলা কিংবা অন্য যত রকমের হুমকি থাক না কেন, উৎসবের সময় সাধারণ মানুষ এসবে পাত্তা দেয় না। দুই ঈদে বাস-ট্রেন-লঞ্চে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ মাথায় নিয়েও মানুষ যেভাবে বাড়ি ফেরে, সেই দৃশ্যই বলে দেয়, এদের সাধারণ মানুষ কতটা উৎসবপ্রিয়।
৩. আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তার সিকিউরিটি প্ল্যান বা নিরাপত্তা পরিকল্পনার স্বার্থে কিছু নির্দেশনা দেবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ মানুষের নিরাপত্তা দেওয়াই তাদের প্রধান কাজ। কোনো একটা দুর্ঘটনা বা নাশকতা ঘটলে প্রথম জবাবদিহিটা তাদেরই করতে হয়। আবার এও ঠিক, সাধারণ মানুষ এসব নির্দেশনা মানতে চায় না। এই আপাত সাংঘর্ষিক অবস্থার ভেতর দিয়েই উৎসব চলে।
৪. শোভাযাত্রায় মুখোশ পরা যাবে না-এ রকম নির্দেশনা খুবই হাস্যকর। কারণ মুখোশ তৈরিই করা হয় এটি মুখে পরার জন্য। মুখ থেকেই মুখোশ। তা ছাড়া যেসব যুক্তিতে মুখোশ পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা, তাও খুব শক্তিশালী নয়।
৫. বিকেল ৫টার পর কোনো অনুষ্ঠান করা যাবে না-এই নির্দেশনাও যুক্তিযুক্ত নয়। প্রশ্ন উঠেছে বইমেলা বা বাণিজ্যমেলা যদি রাত ৮টা, ১০টা পর্যন্ত চলতে পারে, বর্ষবরণের অনুষ্ঠান কেন ৫টার মধ্যে শেষ করতে হবে? নিরাপত্তার আশঙ্কা থাকলে সেটি প্রতিহত এবং প্রতিরোধ করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। তারা উৎসবের সময়-সীমা বেঁধে দিতে পারে কি না, তা নিয়ে নানা মহল থেকেই প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি সরকারের একাধিক মন্ত্রীও এর সমালোচনা করেছেন।
৬. বাঙালি একদিকে খুব উৎসবপ্রিয়, অন্যদিকে আমাদের দেশে সম্প্রতি যোগ হয়েছে জঙ্গি হামলাসহ নানাবিধ বিপদ। কিন্তু এসবের ভয়ে গুটিসুঁটি মেরে মানুষ ঘরে বসে থাকবে, সেটি ভাববার কোনো কারণ নেই। বরং মানুষ ভয় পেয়ে ঘরে বসে থাকলেই সেসব লোকের সুবিধা, যারা চায় দেশ থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা উঠে যাক, যারা চায় বাঙালি পয়লা বৈশাখ পালন না করুক। মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিতে রমনার বটমূলে বোমা হামলার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু তারপরও কি ছায়ানটের ওই অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে? যারা বলছে মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালি সংস্কৃতির অংশ নয়; তাদের এই দাবির পরে কি শোভাযাত্রা বন্ধ হয়ে যাবে? অসম্ভব। বরং এসবের বিরুদ্ধ স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বাঙালির প্রাণের উৎসব আরো বেশি রঙিন হয়ে উঠবে এবং যারা ভয় দেখায়, একসময় তারাই বরং ক্লান্ত হবে।
লেখক : সাংবাদিক