অভিমত
হায় ৫৭!
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ নিয়ে কথাবার্তা ঢের হয়েছে। এ রকম সাংঘর্ষিক আর ভয়ঙ্কর বিধান কী করে এত দিন ধরে টিকে আছে, সেটি এক বিস্ময়। যদিও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে নতুন যে একটি বিল প্রস্তুত হয়ে আছে, সেটি পাস হয়ে গেলে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের এই বিতর্কিত ধারাটি রহিত হয়ে যাবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এখনো সংসদে ওঠেনি। তা ছাড়া এই আইনের অনেক ধারা নিয়েও নতুন করে বিতর্ক তৈরি হবে।
তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাকে বলা যায় আধুনিক ব্লাসফেমি, যার সবশেষ শিকার নতুন সময় ডটকম নামের একটি অনলাইন সংবাদপত্রের নির্বাহী সম্পাদক আহমেদ রাজু। দেশের অন্যতম বড় ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওয়ালটনের মোবাইল ফোন নিয়ে রিপোর্ট করায় তাঁর বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের এই বিতর্কিত ৫৭ ধারায় মামলা করে কর্তৃপক্ষ এবং তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
বাস্তবতা হলো, একই রকম সংবাদ যদি কোনো মুদ্রিত সংবাদপত্র বা টেলিভিশনে প্রকাশিত বা প্রচারিত হতো, তাহলে সেই রিপোর্টের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করার সুযোগ নেই। কেননা, ৫৭ ধারার প্রয়োগ কেবল অনলাইন মাধ্যমে কারো মানহানি ঘটালে। সেটি হোক সংবাদ কিংবা ফেসবুক স্ট্যাটাস। আইনের সবচেয়ে সাংঘর্ষিক জায়গা এটিই। কেননা, যে সংবাদ একটি পত্রিকায় ছাপা হলে তার বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য এ রকম ধারায় মামলা করার সুযোগ নেই, সেই একই ধরনের সংবাদ অনলাইন সংবাদপত্রে ছাপলেই ৫৭ ধারার আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ প্রচলিত অন্য আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং কেবল এই যুক্তিতেই এই বিধানটি বাতিল হওয়ার কথা। কিন্তু তা হয়নি বরং আমরা দেখছি সাংবাদিক প্রবীর শিকদার থেকে শুরু করে আহমেদ রাজু-প্রত্যেকেই ভিকটিম হচ্ছেন এই কালাকানুনের।
একাত্তর টিভির বার্তা প্রধান সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা তাঁর ফেসবুকওয়ালে লিখেছেন : ‘আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা রাখাই হয়েছে সাংবাদিকদের হয়রানি করার জন্য। এক মন্ত্রী এটা ব্যবহার করেছেন এক সাংবাদিককে হয়রানি করতে তাঁর হিন্দু বাড়ি দখল নিয়ে রিপোর্ট করায়। আরো করেছেন দু-একজন রাজনীতিক। এরপর করেছেন শিক্ষা বিভাগের ডিজি আর এখন শুরু করেছে ওয়াল্টনের মতো কোম্পানিও।’
সিনিয়র সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু লিখেছেন : ‘খবর যদি অসত্য, ক্ষতিকর বা মানহানিকর হয় তবে আইনি প্রতিকার আছে, কিন্তু তা অবশ্যই প্রক্রিয়া সাপেক্ষ। হয়রানি বন্ধ করার জন্য দণ্ডবিধির ৫০০/৫০১ ধারা সংশোধন করা হয়। এ ধারার মামলায় এখন সাংবাদিকদের সরাসরি গ্রেপ্তার করা যায় না। আদালত সমন দেন। এখন হয়রানির ভয়ংকর হাতিয়ার হলো আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা। ক্ষতিগ্রস্তের প্রতিবাদ জানানোর আগেই বা সাংবাদিককে আত্মপক্ষ সমর্থনের ন্যূনতম সুযোগ না দিয়ে সরাসরি শাস্তি! রাজুর ঘটনাটি ৫৭ ধারার চূড়ান্ত যুক্তিহীনতার সাক্ষাৎ প্রমাণ।’
২০০৬ সালে প্রণীত তথ্যপ্রযুক্তি আইনে সংশোধন আনা হয় ২০১৩ সালে। বলা হয়, মানুষের বাকস্বাধীনতার চরম পরিপন্থী এই আইনের ৫৭ ধারা যেখানে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ। কোনো ব্যক্তি এই অপরাধ করিলে তিনি অনধিক ১৪ বছর এবং ন্যূনতম সাত বৎসর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’
এখন কে কখন কোন কথাটিকে বা কোন সংবাদকে অথবা ফেসবুকের কোন স্ট্যাটাসকে তার মানহানীকর বলে মনে করবেন, তার কোনো মানদণ্ড নেই। ফলে ক্ষমতাবানরা বরাবরই এই বিধান অপব্যবহারের সুযোগ নেন। বিশেষ করে ধর্মীয় ইস্যুতে কারো কোনো বক্তব্য অপছন্দ হলেই তার বিরুদ্ধে এই ৫৭ ধারায় মামলা দিয়ে তাকে নাজেহাল করার বহু উদাহরণ এরইমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। এই আইনে এমন সব অপরাধের কথা বলা হয়েছে, যেসব অপরাধের ব্যাখ্যা নেই। ফলে ইচ্ছে মতো এর অপব্যবহার সম্ভব এবং তাই হচ্ছে।
তবে আমরা যখন মানুষের বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করতে ৫৭ ধারার মতো কালাকানুন বাতিলের দাবি জানাই, তার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাকস্বাধীনতার নামে যা ইচ্ছে তাই লেখা, অনলাইনে কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা, কারো বক্তব্য পছন্দ না হলেই তাকে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের বা মতের বলে প্রচার চালানো, সাংবাদিকতার নামে অপসাংবাদিকতা চর্চা বন্ধেরও দাবি জানাতে হবে।
মূলধারার কয়েকটি অনলাইন সংবাদপত্র বাদে বেশির ভাগই ভূঁইফোড় এবং বেশির ভাগ অনলাইন সংবাদপত্রই বস্তুত কোনো ধরনের বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার চর্চা করে না। বরং সাংবাদিকতাকে হাতিয়ার করে তারা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ব্ল্যাকমেইল করে। সুতরাং একদিকে আমরা যেমন ৫৭ ধারা বাতিলের দাবি তুলি, তেমনি ইন্টারনেটকে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার বন্ধেরও দাবি জানাই।
লেখক : সাংবাদিক