অভিমত
কারো জন্য দুর্ভোগ, কারো ‘মঙ্গলকাব্য’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘বর্ষার দিনে’ কবিতায় বলেছেন—
‘এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়...
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়॥’
বর্ষা যে কোনো মানুষকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও কবি বানিয়ে দেয়। কথাটা বোধহয় মিথ্যে নয়।
টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে আর মন ভালো থাকলে ভাবের উদয় হবে না, এমন তো হতে পারে না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যদি আজকের ঢাকা শহরের নাগরিক হতেন? তাঁকে যদি প্রতিদিন মিরপুর ১২ নম্বর থেকে মতিঝিলের কোনো একটি জাতীয় পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে কাজ করতে হতো?
তা হলে তিনি কী লিখতেন। তাঁর মনে কোনো ভাবের উদয় হতো?
তিনি হয়তো লিখতেন—
‘তোমার আমার জীবনের মত
সড়ক হয়েছে ক্ষত বিক্ষত
মাঝখানে কাটা, বর্ষার পানি,
টানিয়া চলেছি জীবনের ঘানি।’
বর্ষা পুরোপুরি শুরু না হতেই নগরবাসীর দুর্ভোগ শুরু হয়ে গেছে। রাস্তায় বের হলে কতক্ষণে গন্তব্যে পৌঁছাবেন তার নিশ্চয়তা নেই। প্রতি বর্ষার চিরাচরিত দৃশ্য এটি। দৈবক্রমেই কি না ঠিক বর্ষার আগ মুহূর্তে ঢাকা শহরসহ সারা দেশেই যেন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির ধুম পড়ে যায়। ঢাকা ওয়াসার মহা উৎসব চলে। মানুষের দুর্ভোগ যেন চরমে ওঠে সেই চেষ্টাটাই প্রাণপণ চালিয়ে যান বেরসিক কর্মকর্তারা। কোনো প্রকার সমন্বয় না থাকার কারণে ছয় মাস আগে যে সড়কটি কাটা হয়েছে বৈদ্যুতিক খুঁটি বা ব্রডব্যান্ড লাইনের জন্য, সেই সড়কটি আবার বর্ষার ঠিক আগমুহূর্তে কাটা হচ্ছে পানির লাইন সংস্থাপন করার জন্য। এ কেমন অরাজকতা!
নগরবাসীর পথ চলাচলে কোনো দুর্ভোগ পোহাতে হবে কি না, সেই চিন্তা করার সময় নেই তাদের।
মাঝে মাঝে মনে হয় যাঁরা এসব রাস্তার কাজটি করেন, তাঁরা সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন কবে বর্ষা আসবে। সে সময় কাজ করলে কিছু অযৌক্তিক কারণ দেখানো যাবে কোনোমতে কাজ করেই। মাটি বালু ভরাটসহ আরো কিছু কাজ বৃষ্টি-কাদার জন্য করা যায়নি বলা যাবে। ঠিকাদার বিলটি ঠিকমতো পাওয়ার জন্য নানা রকমের তদবির করে কাজ সম্পন্ন হয়েছে এই সনদ নিতে ব্যস্ত হয়ে উঠবে। কাজ শেষ হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে আবার রাস্তা বসে যাবে। আবার সড়ক বিভাগ দরপত্র আহ্বান করবে। কোটি কোটি টাকা খরচ হবে এক সড়ক করতে গিয়ে।
এই হচ্ছে আমাদের নগর উন্নয়নের চিত্র।
কবিদের কাছে বর্ষা মঙ্গল হয়ে দেখা দেয়। নগরবাসীর জন্য বয়ে আনে দুর্ভোগ। তবে কবিদের মতো ঠিকাদারসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জন্য বর্ষাকাল আসলে মঙ্গলই বয়ে আনে। কারণ এই বর্ষায় কাজ করে তাদের ভাগ্যলক্ষ্মী সুপ্রসন্ন হয়। অল্প কাজ বা গোঁজামিল দিয়ে কোনোমতে কাজ করে বিল পাওয়া যায়। কারণ দেখানো যায় বর্ষার পানি সব ধুয়েমুছে নিয়ে গেছে। যে পরিমাণ বালু ফেলার কথা, তা ফেলার পরেও থাকেনি। বৃষ্টির বেরসিক পানি তা ধুয়ে নিয়ে গেছে।
আমাদের এভাবে আর কতকাল ‘বর্ষামঙ্গল’ কবিতা পড়তে হবে জানি না।
হে ধরণী, তুমি আর কতকাল আমাদের এই দুর্ভোগ দেখাবে? বলে দাও।
লেখক : ছড়াকার ও সাংবাদিক।