অভিমত
ভিসি সমাচার
একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রাতের আঁধারে পুলিশি পাহারায় বাসভবন ছাড়বেন—এটি কোনো কাঙ্ক্ষিত দৃশ্য নয়। কিন্তু তারপরও এমন দৃশ্যই আমাদের দেখতে হলো।
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ কে এম নূর উন নবী শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে রংপুরে তাঁর বাসভবন ছেড়ে চলে যান। এর ঘণ্টা চারেক আগে থেকে সাংবাদিকরা তাঁর বাসার সামনে অপেক্ষা করছিলেন, বিদায় বেলায় তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য। কিন্তু তিনি সাংবাদিকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পুলিশি পাহারায় বাসা থেকে বেরিয়ে যান।
৫ মে তাঁর চার বছর মেয়াদ পূর্ণ হয়। তিনি কোষাধ্যক্ষসহ একই সঙ্গে ১৪টি পদে একাই দায়িত্ব পালন করতেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো উপ-উপাচার্যও নেই। ফলে তাঁর এই চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিরাট শূন্যতা তৈরি হয়েছে। যদিও তিনি কৌশলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীষ্মকালীন ছুটি দিয়ে গেছেন।
তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও সরকারের কাছে প্রতিবেদন দিয়েছে তদন্ত কমিটি। ইউজিসির গঠিত সর্বশেষ কমিটি উপাচার্যের বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে রয়েছে ভর্তি পরীক্ষা ও আপ্যায়নের টাকা নিয়ে অনিয়ম, সরকারি গাড়ি ব্যবহারের স্বেচ্ছাচারিতা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ধারাবাহিক অনুপস্থিতি, একসঙ্গে ১৪টি পদ ধরে রাখা, শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হয়রানি ইত্যাদি। এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।
এই ঘটনার অব্যাবহিত পূর্বে আলোচনায় আসেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মীজানুর রহমান। ‘বিশেষ কর্মকর্তার’ পদ তৈরি করে এবং নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ছাত্রলীগের ১২ জন নেতাকে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, উপাচার্য বলেছেন, ‘ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের চাকরি দিতে আমি বাধ্য। নিয়োগপ্রাপ্ত ওই ১২ জন কঠোর পরিশ্রমী নেতাকর্মী ছিলেন। এর মধ্যে দুজন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার বাসিন্দা। এটাই তাঁদের সবচেয়ে বড় পরিচয়।’
উপাচার্যের এই বক্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠলে তার পক্ষ থেকে ওই সংবাদের প্রতিবাদ জানানো হয়। শুধু তাই নয়, প্রথম আলোর ওই প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে শিবির সংশ্লিষ্টতারও অভিযোগ আনা হয়। যদিও ফেসবুকে উপাচার্যের ওই প্রতিবাদলিপির নিচে কেউ কেউ এমন একটি ছবি যুক্ত করে দিয়েছেন, যেখানে দেখা যাচ্ছে ভিসি মীজানুর রহমান প্রথম আলোর ওই প্রতিবেদককে একটা অনুষ্ঠানে নিজের হাতে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন। ফলে কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন, ওই সাংবাদিক যদি শিবির সংশ্লিষ্টই হবেন, তাহলে তাঁকে ভিসি কেন মিষ্টি খাওয়ালেন? বাস্তবতা হলো, এখন যে কাউকে ঘায়েল করতে চাইলে তাকে এরকম কোনো বিশেষ রাজনৈতিক তকমা লাগিয়ে দেয়াটাই সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
পরপর দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির এই কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের মনে কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যেমন একটি দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে কাদের বসানো হচ্ছে? কী তাদের যোগ্যতা? নৈতিকতার মানদণ্ডে তারা কতটা উত্তীর্ণ? তারা নিজেরাই যদি এ রকম দুর্নীতি আর দলবাজিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পড়েন, তাহলে তাদের কাছ থেকে জাতি তো দূরে থাক, তাদের ছাত্রছাত্রীরাই বা কী শিক্ষা পাবে? একজন অধ্যাপক যদি টাকার কাছে নিজেকে বিকিয়ে দেন, দলীয় আনুগত্য প্রদর্শনের নামে নিয়ম-নীতি আর নীতি-নৈতিকতার জলাঞ্জলি দেন, তাহলে তাদের সঙ্গে একজন সাধারণ রাজনীতিবিদ কিংবা ঠিকাদার অথবা অন্য পেশার মানুষের কী পার্থক্য?
সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা সবচেয়ে উঁচুতে। তাঁরা কোনো একটি বিষয়ে কিছু বললে দলমত নির্বিশেষে সবাই সেটিকে মানে বা মানতে চায়। কিন্তু আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদে যে মানুষদের বসানো হচ্ছে, তাঁদের দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ কি শ্রদ্ধা করে? অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, হাসান আজিজুল হক, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো মানুষেরা কি এ মুহূর্তে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বে আছেন বা এ রকম মেধাবী, নীতিবান আর সর্বজনশ্রদ্ধেয় শিক্ষককে কি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি করা হবে?
একজন শিক্ষকের কাছ থেকে মানুষ সর্বোচ্চ নৈতিকতা এবং নিরপেক্ষতা আশা করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এসব যোগ্যতা বা গুণ থাকলেই সম্ভবত এখন তিনি ভিসি হওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়েন। এখন ভিসি হওয়ার প্রধানতম যোগ্যতা দলীয় আনুগত্য এবং এটি যেকোনো সরকারের আমলেই? একজন শিক্ষক কেন অমুকপন্থী তমুকপন্থী বলে পরিচিত হবেন? ভিসিদের কেন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের কাঁধে হাত দিয়ে চলতে হবে? রাজনৈতিক দলের নেতারাই তো বরং ভিসির বাসায় গিয়ে বসে থাকবেন তাঁর সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য।
একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে কেন রাজনৈতিক দলের অনুষ্ঠানে যেতে হবে। তিনি কেন নিজেকে রাজনীতি থেকে দূর রাখতে পারেন না? তাঁর দায়িত্ব তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ ঠিক রাখা, গবেষণার নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কারে সহায়তা দেওয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়নের সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করা। ব্যক্তিগত লোভ-লালসা তাঁকে কেন গ্রাস করবে? কেন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বা শিক্ষক রাস্তায় বেরোলে সাধারণ মানুষ রিকশা থেকে নেমে গিয়ে তাঁকে সালাম দেবে না? এমন শিক্ষকের সংখ্যা এখন কতজন যাদের দেখলে সাধারণ শিক্ষার্থী তো বটেই, বরং অন্য শ্রেণিপেশার মানুষও দাঁড়িয়ে তাঁকে সালাম দেয়? তাঁর কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করে? জাতির কোনো ক্রান্তিকালে সেই শিক্ষক কী বলেন, তা শুনতে ব্যাকুল থাকেন সবাই-এমন শিক্ষকের সংখ্যা এখন কত? আর নিরেট ভালো মানুষ, মেধাবী, যোগ্য, দলবাজ নন এবং দক্ষ প্রশাসক-এমন উপাচার্যই বা কতজন?
দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) শিক্ষকদের একটি নৈতিক আচরণবিধি তৈরি করেছে, যেখানে বলা হয়েছে : ‘যেহেতু শিক্ষকগণ দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক তৈরি করেন, অর্থাৎ একজন শিক্ষকই তৈরি করতে পারেন একজন ভালো বিচারক, প্রশাসক সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কবি, ডাক্তার, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ; তাই দেশে সরকার কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন নীতিমালার মতো শিক্ষকদেরও একটি নৈতিক আচরণবিধি থাকা প্রয়োজন যার নিয়মাবলি বাংলাদেশের শিক্ষকসমাজ মেনে চলবেন।
আমীন আল রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক।