অভিমত
দুই মেয়রের দুই বছর
বহুদিন আগে বিটিভির একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে (সম্ভবত ইত্যাদি) আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে উপস্থাপক প্রশ্ন করেছিলেন, ঢাকার মেয়র হলে আপনি কী করবেন? জবাবে স্যার বলেছিলেন, আমি এমন কাজ করব যাতে এই শহরে কেউ পা রেখেই বুঝতে পারে যে, এখানে একজন মেয়র আছেন।
বাস্তবতা হলো, বহু বছর ধরে এই শহরের রাস্তাঘাট, অলিগলি, ফুটপাথ আর ড্রেনে যে নৈরাজ্য ছিল, তাতে এ প্রশ্নই মানুষের মনে উঁকি দিত যে, আসলেই এই নগরীর কোনো অভিভাবক আছেন কি না? এমনকি ঢাকাকে দুই ভাগ করে উত্তর-দক্ষিণ নামে দুই সিটি করপোরেশন করার পরও এই মহানগরীর বাসিন্দাদের দুর্দিন শেষ হয়নি। তবে সেই চিত্র বদলাতে শুরু করেছে।
এখন ঢাকার দুই অংশেই, বিশেষ করে উত্তরাংশের বাসিন্দা হিসেবে আমরা দেখি, ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে এই শহরের চিত্র। ধীরে ধীরে এই শহরের মানুষ বুঝতে শুরু করছে যে, এখানে মেয়র আছেন। বছর কয়েক আগেও আমরা এই মহানগরীতে পর্যাপ্ত এবং মানসম্মত পাবলিক টয়লেট না থাকার যে আক্ষেপ করতাম, এখন সেখানে ঝকঝকে পাবলিক টয়লেট রাস্তার পাশেই দেখতে পাই যেখানে ৫ টাকা দিয়ে টয়লেট করতে হলেও সেখানে ঢুকলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। পাবলিক টয়লেট মানেই দুর্গন্ধ, কাদাপানিতে সয়লাব আর ইজারাদারের গলা খাকানোর চিরাচরিত দৃশ্য বদলে গেছে। এখন ঢাকা শহরের বুকে এমন সব পাবলিক টয়লেট তৈরি হয়েছে, যেগুলো দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। তাঁদের একটি বড় অর্জন ঢাকার আকাশ বিলবোর্ডের জঞ্জালমুক্ত করা।
কারওয়ান বাজার রেল ক্রসিং থেকে সাতরাস্তার মোড় পর্যন্ত আধা কিলোমিটারেরও কম দূরত্বের পথটুকুতে যারা নিয়মিত যাতায়াত করেন, তারা জানেন এখানে বছর দুই আগেও কী বীভৎস অবস্থা ছিল। রাস্তার উপরে ট্রাকের পর ট্রাক, ময়লা, ধূলা, দুর্গন্ধ। সামান্য এই পথটুকু মনে হতো জাহান্নামের সদর দরজা। এখন এই পথ নির্ঝঞ্ঝাট। রোড ডিভাইডার দিয়ে সেখানে গাছ লাগানো হয়েছে। রাস্তার ওপরে ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকে না। ধূলাবালি নেই। রাস্তার ওপর আবর্জনা পড়ে থাকে না। দুপাশে সুন্দর ফুটপাথ। অনায়াসে হেঁটে যাওয়া যায়। যিনি দুই বছর আগে এই সড়ক দেখেননি, তাকে এটা বিশ্বাস করানো কঠিন হবে যে, এই সড়কের চিত্র কী ভীষণরকম বদলে গেছে।আর এটি সম্ভব হয়েছে উত্তর সিটির মেয়র আনিসুল হকের একক চেষ্টায়, সাহসে এবং একরোখা ভাবনায়-যার সাক্ষী আমরাই। কারণ ট্রাক চালক-মালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে এই সড়ককে জঞ্জালমুক্ত করতে গিয়ে তাকে যে ভীষণ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছিল, সেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার দুঃসাহস অনেক বড় রাজনীতিবিদেরও নেই বলে আমরা মনে করি।
কেবল এই সড়কটুকুই নয়। মেয়র আনিসুল হক গুলশান-বারিধারার মতো অভিজাত এলাকার ফুটপাথ দখলমুক্ত করতে যেসব অভিযান চালিয়েছেন এবং চালাচ্ছেন, যেভাবে ক্ষমতাবানদের চ্যালেঞ্জ করছেন, তা সত্যিই বিস্ময়ের। গুলশানে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর থেকেই গুলশান ও বনানীর নিরাপত্তা বাড়ানোর উদ্যোগ নেন তিনি। এজন্য গুলশান এলাকায় নিয়ন্ত্রিত নিবন্ধিত রিকশা চালু এবং গুলশানের ভিতর দিয়ে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বাসের রুট পারমিট বাতিল করে শুধু গুলশান-বনানীতে চলাচলকারী ‘ঢাকা চাকা’ নামে আলাদা বাসের ব্যবস্থা করেন। তেজগাঁও, মহাখালী, গুলশান, বনানী, মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় অনেক সড়ক ও ফুটপাথ দখল করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অফিস নির্মাণ করা হয়েছিল। মেয়রের নির্দেশে সেগুলোও উচ্ছেদ করা হয়। মাত্র দুই বছরেই তিনি তাঁর নির্বাচনী এলাকায় যে ধরনের পরিবর্তনের আভাস দিয়েছেন, মেয়াদের বাকি তিন বছরে তিনি যে পুরো উত্তর সিটির চেহারা বদলে দেবেন, সে বিষয়ে সন্দেহ কম।
তবে বসে নেই দক্ষিণ সিটির মেয়রও। গুলিস্তান-মতিঝিল ফুটপাথ অবৈধ দখলমুক্ত করার বিরাট চ্যালেঞ্জের ব্যাপার ছিল। তিনি সেটা করেছেন। রাস্তা-ঘাট সংস্কার করছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নাগরিকদের সমস্যা সরাসরি শুনছেন। তাৎক্ষণিক সমাধান দেয়ার চেষ্টা করছেন। তবে তার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সম্ভবত ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গার দূষণ ঠেকানো। তার এলাকায় হাজার হাজার কল-কারখানা-যেখান থেকে বর্জ্য সরাসরি বুড়িগঙ্গায় পড়ে। এই মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ঠেকানোর জন্য তাকে বিপুল বিনিয়োগ এবং সেইসাথে নানা কৌশল অবলম্বন করতে হবে।
আনিসুল হকের সঙ্গে দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনের মূল তফাৎ রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতায়। সাঈদ খোকন নিরেট পলিটিশিয়ান। ফলে তাকে আপস করতে হয় অনেক বেশি। কিন্তু আনিসুল হক রাজনীতিবিযুক্ত না হলেও তার সেই সীমাবদ্ধতা নেই। তিনি অনেক কিছুই করতে পারেন। তার দলীয় লোকদের কথায় প্রভাবিত না হলেও চলে। তাছাড়া ব্যক্তি হিসেবেও আনিসুল হক অনেক বেশি ক্যারিশমাটিক। মানুষকে প্রভাবিত করার একটা সহজাত গুণ তার রয়েছে। সরকারের সর্বোচ্চ মহলেও তার অবস্থান অনেক বেশি দৃঢ়।
তবে দুই মেয়রের কাজের তুলনা করা উচিত কি অনুচিত, সেই তর্কের বাইরে গিয়ে এটা বলা যায় যে, দুজনই চেষ্টা করছেন ঢাকাকে বদলে দেওয়ার। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ যেমন বলেছেন যে, তিনি মেয়র হলে এমন কাজ করবেন যাতে করে এই শহরে কেউ পা রেখেই বুঝতে পারে যে, এখানে একজন মেয়র আছেন-আনিসুল হক এবং সাঈদ খোকন দুজনই সেই চেষ্টাটি করছেন বলেই আমরা নাগরিকরা বিশ্বাস করি। যদিও একজনের মূল্যায়নে দুই বছর হয়তো যথেষ্ট সময় নয়। সুতরাং আমরা নাগরিকরা আশা করি, আগামী তিন বছর পর আমরা সত্যিই একটি বাসযোগ্য ঢাকা দেখতে পাব যেখানে নাগরিকরা ফুটপাথে নিরাপদে হাঁটার সুযোগ পাবে, সুশৃঙ্খল গণপরিবহনে গন্তব্যে যাতায়াত করতে পারবে, সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তায় হাঁটুজল জমবে না, রাস্তায় খানাখন্দ থাকবে না, ড্রেনেজ ব্যবস্থা আরও উন্নত হবে, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং হবে না, মানুষ সিগন্যাল মেনে চলবে, যানবহান নিয়ন্ত্রণে রাস্তার মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের প্রয়োজন হবে না বরং সিগন্যাল দেখেই মানুষ চলবে, ফুটপাথে অবৈধ দখল থাকবে না আবার হকাররা কম দামে জিনিসপত্র বিক্রি করে সংসার চালাতে পারবেন, অল্প আয়ের মানুষেরাও কম দামে জিনিস কিনতে পারবেন। সব মিলিয়ে একটা মানবিক নগরী হয়ে উঠবে তিলোত্তমা ঢাকা, এই প্রত্যাশা প্রতিটি নাগরিকের।
যদিও এই কাজগুলো করা এককভাবে মেয়রদের পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা ঢাকা শহরের উন্নয়নের সাথে ৫৪টি প্রতিষ্ঠান যুক্ত, যার ৮০ ভাগই মেয়রদের অধীনে নয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তরসহ এই ৫৪টি প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশেরই কারো সঙ্গে কারো সমন্বয় নেই। যেসব মন্ত্রণালয় ও সংস্থা কাজ করে তাদের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মেয়ররা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ বা কোনো নির্দেশনা জারি করতে পারেন না। সবার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা বেশ কঠিন। সেই সমন্বয়টুকু তৈরি হবে এবং সবাই মেয়রদের সহযোগিতা করবেন এবং এ ক্ষেত্রে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছাও প্রবল থাকবে-এমন প্রত্যাশা আমরা করি। দায়িত্ব নেওয়ার দুই বছরে আপাত সফল দুই মেয়রকে অভিনন্দন এবং তাঁদের আরো সাফল্য কামনা করি।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।