‘পল্টিবন্ধু’র হাউশ, জোট করবে ঢাউস
আমার এক মামাতো ভাই গ্রাম থেকে কাল রাতে বাসায় এসেছেন। এসেই আমার মেয়েদের জ্ঞান দিতে শুরু করেছেন দেশের রাজনীতি নিয়ে, আগামীতে জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় আসবে। দেশের মানুষ আওয়ামী লীগ আর বিএনপির ওপর ভরসা রাখতে পারছে না। এরা শুধু ক্ষমতায় থাকা আর ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কামড়াকামড়ি করে। তাই তাঁর ইচ্ছা, এবার এরশাদের সঙ্গে জোট বাঁধবেন।
মেয়েরাও বেশ মজা পেয়েছে তাঁদের চাচার কথা শুনে। এরশাদ ক্ষমতায় গেলে মামাতো ভাই এমপি-টেমপি হয়ে যেতে পারেন, এ রকম কথাও নাকি বলেছে। আর এমপি হয়ে গেলে ওদের দুজনকে কক্সবাজারে প্লেনে করে বেড়াতে নিয়ে যাবেন, মালয়েশিয়ায় ঘুরতে নিয়ে যাবেন। আরো আরো কত্ত কিছু নাকি বলেছেন। মেয়েরা আমাকে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পরই চুপিচুপি বলে দিয়েছে।
আমার এই মামাতো ভাই ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা থেকে দূরে থেকেছেন। গ্রাম্য রাজনীতি বলতে যা বোঝায়, সেগুলো করেই বড় হয়েছে। এসএসসি তৃতীয় বা চতুর্থবারে কোনোমতে পার হয়েছেন। তবে আমি নিশ্চিত, তৃতীয় বিভাগের ওপরে উত্তীর্ণ হতে পারেননি। আর তাঁর দাবি, এইচএসসি উনি পাস করেছেন। কিন্তু জনশ্রুতি আছে, ইংরেজি পরীক্ষার পর আর তাঁকে পরীক্ষা কেন্দ্রের চৌহদ্দিতে দেখা যায়নি। তাঁর বন্ধুরাই আমাকে ঘটনাটা জানিয়েছেন। কারণ, তিনি ইংরেজি প্রথম পত্র পরীক্ষা এতটাই খারাপ দিয়েছেন যে নকল করে দ্বিতীয় পত্রের পুরো প্রশ্নের উত্তর দিলেও দুই পত্র মিলে নাকি পাস করতে পারবেন না, এটা নিশ্চিত হয়েই আর দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা দেওয়ার ঝুঁকি নেননি।
একবার আওয়ামী লীগ, একবার বিএনপি এভাবে কয়েকবার দল পাল্টিয়েছেন। আমার নানা তাঁর এই গুণধর নাতির নাম দিয়েছেন পল্টি তরফদার। এলাকায় তাঁকে নিয়ে মজার মজার ঘটনা ঘটনা চালু আছে। বয়স পঞ্চান্ন। বিয়েশাদি করেননি। নানার একটা মার্কেট আছে, ওখানে সময় কাটান। দোকান ভাড়া ওঠান। আর মার্কেট দেখাশোনা করেন।
যা হোক, আমার সঙ্গে তাঁর সন্ধ্যায় কথা হয়েছিল। গত রাতে কথা হয়নি। উনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আজ একটু আগেই বাসায় ফিরেছি। তাই আমার ঘরে এসে ওনার সঙ্গে কথা হলো। আমি নিশ্চিত, আজ আমাকে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে হবে। উনি যা যা বললেন, শুনে আমার মাথা পুরো আউলাইয়াই গেছে।
ওনার আর আমার কথা হুবহু তুলে দিলাম।
‘ভাইজান কেমন আছেন?’
‘ভালোই। তুমি কেমন আছো? সাংবাদিকতা আর তো আগের মতো নাই। সবাই শুধু ধান্দাবাজি করে।’
‘কেমন ধান্দাবাজি ভাইজান?’
‘আমাদের উপজেলায় যারা আছে, সবই ধান্দাবাজ। টাকা ছাড়া কোনো সংবাদ ঢাকায় পাঠায় না। আমি কত বক্তৃতা দিই। কোনোদিন আমার ছবি তো দূরের কথা, নামও পত্রিকায় আসে না।’
‘খুব খারাপ কথা।’
‘আরে তুমিই কও আমি কি আজকে থেকে রাজনীতি করি?’
‘না।’
‘তাহলে আমার নামটা ছাপলে ওদের কী সমস্যা? এইবার আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সাহেবের সাথে জোট বাঁধব।‘’
‘মানে কী?’
‘আরে তুমি সংবাদপত্রের মানুষ, দেখো নাই এরশাদ সাহেব অনেকগুলা দল নিয়ে ‘সম্মিলিত জাতীয় জোট বানাচ্ছেন।’
‘দেখেছি। কিন্তু আপনি কোন দলের হয়ে জোট বাঁধবেন? আর উনি যাদের সাথে জোট বেঁধেছেন, তারা নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দল।’
‘তোমরা সাংবাদিকদের এই এক সমস্যা, খালি রাজনৈতিক নেতাদের ভুল খুঁজে বেড়াও। ওইসব ফালতু কথা বলবা না। আমি তোমার সাহায্য চাই।’
‘মানে কী?’
“তুমি সাংবাদিক মানুষ। তোমার সাথে এরশাদের সাথে ওঠবস করে এমন কারোর নিশ্চয়ই যোগাযোগ আছে। তার কাছে আমাকে নিয়ে যাবা। আমি তার ‘সম্মিলিত জাতীয় জোটে’ ঢুকতে চাই, এটা বলবা। প্লিজ তুমি আমার এই উপকারটা করবা। কথা দেও।”
‘ভাইজান আপনি কোন দল করেন এখন?’
“আমি এখন কোনো দলে নাই। নিজেই একটা দল করছি। অফিসও নিছি। নানার মার্কেটের নিচতলায় অফিস। দলের নাম ‘একাই ১০০’। একশ কিন্তু অঙ্কে ১০০। মানে এক আর দুইটা শূন্য।”
‘মানে কী? একাই ১০০ দলে কে কে আছেন?’
‘তুমি শিক্ষিত মানুষ। দলের নাম শুনেও বুঝলা না। আমি একাই। কেউরে নিলে গেঞ্জাম লাগিয়ে ফেলবে। তাই একাই ১০০ দলে আমি একাই সদস্য।’
‘ভাইজান সত্যি বলছি, আমার সাথে এমন কারো যোগাযোগ নাই। আর যোগাযোগ থাকলেও আমি আপনাকে তার কাছে নিয়ে যেতাম না।’
‘কেন?’
‘কারণ এরশাদ লোকটা ভালো না। উনি স্বৈরাচার ছিলেন। আরো অনেক সমস্যা ওনার।’
‘কী কী সমস্যা বলো আমাকে?’
‘আপনি বড় ভাই, সব সমস্যা বলতে চাই না। শুধু এটুকু বলি, উনি ভালো না। উনি আসলে পল্টিবাজ মানুষ। উনি ইসলামী মহাজোটের ৩৪ ও বাংলাদেশ জাতীয় জোটের ২২টি দল নিয়ে সম্মিলিত জাতীয় জোট করেছেন। তাই না?’
‘হ্যাঁ। তাতে কী হয়েছে?’
‘আপনি কি জানেন, এগুলোর কোনো রাজনৈতিক নিবন্ধন নেই?’
‘হ্যাঁ, আমারটারও তো নিবন্ধন করি নাই। তাতে কী হয়েছে? আরে শোনো আসল কথা বলি, এখন যারা সম্মিলিত জাতীয় জোটে আছে, আগামী নির্বাচনের সময় এরশাদ সাহেব এই দলগুলারে নিয়া আওয়ামী লীগের সাথে দামাদামি করার সুযোগ নিবে। তখন আমারও একটু দাম বাড়বে। এলাকায় আমাকে সম্মান দিব আওয়ামী লীগের মানুষেরা।’
‘আচ্ছা ভাইজান, আপনি কি বলতে পারেন এরশাদ সাহেবকে পল্লীবন্ধু খেতাব কারা দিয়েছিল?’
‘না তো, জানি না। কেন কী হয়েছে তাতে?’
‘আসলে ওনাকে দেওয়া দরকার ছিল অন্য খেতাব। উনি যেভাবে পল্টি দিয়ে যাচ্ছেন একের পর এক। আর ওনাকে নিয়ে মহাজোট সরকারও নানাভাবে খেলছে। দেখলেন এক এক করে উনি মামলা থেকে খালাস পেয়ে যাচ্ছেন।’
‘আরে উনি ভালো মানুষ বলেই তো খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। ওনাকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত কি খামোখাই বানানো হয়েছে?’
‘আচ্ছা ভাইজান, এরশাদ সাহেবকে এবার পল্টিবন্ধু খেতাব যাতে দেওয়া হয়, সেই জন্য একটা লেখা আমি লিখতে চাই। কী বলেন?’
‘এসব করো না। একজন ভালো মানুষকে যা তা বলা আল্লাহ নারাজ হন।’
‘উনি ভালো মানুষ—এই সার্টিফিকেট কে দিল আপনাকে?’
‘তোমার সাথে আমার কথা বলার ইচ্ছা নাই। ভাবছিলাম, কটা দিন তোমার বাসায় থাকব। এরশাদ সাহেবের সাথে দেখা করে তার সাথে জোট বাঁধব। তা আর হলো না। আজ রাতের বাসেই চলে যাব।’
—বলেই আমার মামাতো ভাই চলে গিয়েছেন আমার ঘর থেকে। তারপর রাতের খাবার খেয়ে ১০টার কোচ ধরেছেন বাড়ি যাওয়ার জন্য।
এই হচ্ছে আমাদের দেশের রাজনীতির চরম দুর্দশার চিত্র। একজন সামরিক শাসক দেশের ক্ষমতায় থেকে কি না করেছেন। আর এখন যা করছেন, তা চলচ্চিত্রের ক্লাউনকেও হার মানায়। ‘ঢাউস’ জোট করার ‘হাউশ’ হয়েছে পল্টিবন্ধু এরশাদ সাহেবের।
কালে কালে আরো কত কী যে দেখতে হবে!
লেখক : ছড়াকার ও সাংবাদিক।