আম রপ্তানির বিপুল সম্ভাবনা
বাংলাদেশের সবখানে কমবেশি আম হলেও রাজশাহীর আমের রয়েছে অন্যতম বিশেষত্ব। যে কারণে সেখানকার আমের কদর এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও বিস্তৃত। রাজশাহী জেলায় আমের বাগান রয়েছে প্রায় ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে। এবার (২০১৭) আম এসেছে এক লাখ ২৬ হাজার ৪৮০টি গাছে। এ মৌসুমে দুই লাখ টনের বেশি আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত বছর (২০১৬) উৎপাদন ছিল এক লাখ ৭২ হাজার মেট্রিক টন।
রাসায়নিকমুক্ত, জৈবিক এবং কম ক্ষতির জন্য সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ২৫ মে তারিখের পরে গোপালভোগ আম সংগ্রহ করতে হবে। তা ছাড়া অন্যান্য জাতের আমও ১৫ মে এর আগে উত্তোলন করা যাবে না বলে নিশেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। এতে বিষমুক্ত হিসেবে নিরাপদ আমের মূল্য এমনিতেই ভোক্তাদের কাছে বেড়ে যায়। ভোক্তারা এখন এসব বিষয়ে আগের তুলনায় অনেক বেশি সচেতন। সেজন্য যেখানে কৃষকের কাছে কেজিপ্রতি আমের সাধারণ মূল্য ৬০ টাকা, কিন্তু বিদেশে প্রেরণের জন্য বেপারীরা তা দেড়গুণ থেকে দ্বিগুণ দামে অর্থাৎ ৯০ থেকে ১২০ টাকায় ক্রয় করে থাকে।
এখন মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ যাচ্ছে বাংলাদেশের আম। রাজশাহীতে ২০১৬ সালে মাত্র ৩০ টন আম রপ্তানির মাধ্যমে প্রথমে এ রপ্তানি কার্যক্রম শুরু করা হয়েছিল। এবারে (২০১৭) সেই পরিমাণের তিনগুণেরর বেশি অর্থাৎ ১০০ টন আম রপ্তানির প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। যেসব দেশে রপ্তানি করা সেই দেশগুলো হলো- ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, সুইডেন, ইংল্যান্ড, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়া।
এখন রাজশাহীর পাশাপাশি সাতক্ষীরা, মেহেরপুর থেকেও আম রপ্তানি করা হচ্ছে। কারণ একেক স্থানের একেকটি আমের জাত মাটির গুণাগুণের ওপর ভিত্তি করে প্রসিদ্ধি লাভ করে। যেমন রাজশাহীর গোপালভোগ, মেহেরপুরের হিমসাগর, ল্যাংড়া ইত্যাদি। সব মিলিয়ে এবার ৫০০টন রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। এসব আম নিরাপদে রপ্তানির জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও রাজশাহীর আম গবেষণা কেন্দ্র যৌথভাবে বিষয়টি তদারকি করছে।
আমকে নিরাপদ রপ্তানি উপযোগী করার জন্য চীন থেকে আমদানি করা বিশেষ ধরনের ব্যাগ দিয়ে ব্যাগিং করা হয়েছে যাকে ‘ফ্রুট ব্যাগিং’ বলা হচ্ছে। সেখানে কার্বন সমৃদ্ধ যে বিশেষ ধরনের ব্যাগটি ব্যবহার করা হয় সেটির মূল্য প্রতিটি মাত্র চার টাকা। একবার কিনে নিয়ে কমপক্ষে পরপর দুই বছর তা ব্যবহার করা যায়। আমের বয়স যখন ৪০ থেকে ৪৫ দিন হয় তখন এ পদ্ধতিতে ব্যাগিং প্রয়োগ করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ থেকে আম রপ্তানি করছে এমন কোম্পানি কিংবা উদ্যোক্তার সংখ্যা একেবারেই হাতেগোনা। সারা দেশের রাজশাহী, সাতক্ষীরা ও মেহেরপুরসহ অন্যান্য স্থানের আম বিদেশে রপ্তানির জন্য কাজ করছে মূলত দেশি হিসেবে ইসলাম গ্রুপ এবং বিদেশি হিসেবে ওয়াল মার্ট কোম্পানি। আমরা জানি যেকোনো কাজ শুরু করাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এখন যেহেতু শুরু হয়ে গেছে তাহলে আর পিছনে ফিরে তাকানোর সুযোগ নেই।
আম বিদেশে রপ্তানি করলেই শুধু নিরাপদ হতে হবে এমনটি নয়। দেশে যে লাখ লাখ টন আম আমরা খাচ্ছি সেগুলোও আমাদের জন্য নিরাপদ হওয়া বাঞ্ছণীয়। আর সেজন্য আমের ফ্রুট ব্যাগিংয়ের এ পদ্ধতিটিকে সারাদেশে সবার জন্য প্রয়োগে উৎসাহিত করতে হবে। তা না হলে বিদেশে আমরা ভালো আম পাঠিয়ে আমরা বিষাক্ত আম খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লে চলবে না।
জানা গেছে ব্যাগিংয়ের পদ্ধতিতে আম চাষ করলে কোনো ধরনের খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমে যাচ্ছে। কারণ চার টাকা মূল্যের একটি কার্বন ব্যাগ দিয়ে এক থোকা বা এক গুচ্ছ আমকে আবৃত করে রাখা যায়। আর একবার একটি ব্যাগ কিনলে সেটি ব্যবহারের পর সংরক্ষণ করে রেখে তা পরবর্তী বছরেও ব্যবহার করা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ফল আসার ৪০ থেকে ৪৫ দিন পরে সেখানে আর কোনো কীটনাশক প্রয়োগ করতে হচ্ছে না। সেজন্য কীটনাশক প্রয়োগের জন্য মূল্য ও শ্রম দুটোই কমে গিয়ে উৎপাদন খরচ কমিয়ে দিচ্ছে। কাজেই এখন থেকে বিদেশে পাঠানোর আম থেকে শুরু করে প্রতিটি আমই নিরাপদ করার কোনো বিকল্প নেই। তাহলেই দেশ-বিদেশ সবস্থানেই দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
লেখক : কৃষিবিদ ও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়