অভিমত
সংবিধানের ভিত্তি বদলের ক্ষমতা কার—সংসদের, না সুপ্রিম কোর্টের?
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের সর্বোচ্চ আদালত ‘সুপ্রিম কোর্ট অব ইন্ডিয়া’র পঞ্চাশ বছর পার হইবা উপলক্ষে দেশ ও বিদেশের বিচারক, আইন-ব্যবসায়ী ও দিগগজ সংবিধান-বিশেষজ্ঞগণ মিলিয়া একটি সংবর্ধনার বহি প্রকাশ করিয়াছিলেন। বহিটির নাম বড়ই চিত্তাকর্ষক : ‘সবার উপরে তবে ভুলভ্রান্তির উপরে নহে।’ সেই বইয়ের অন্যতম সম্পাদক ও লেখকের নামটিও বেশ : রাজু রামচন্দ্রন। তিনি ঐ আদালতের একজন জ্যেষ্ঠ আইন-ব্যবসায়ীও বটেন। আমার এই অতি সামান্য নিবন্ধে আমি তাঁহার নিবন্ধ হইতে দুইটি কথার কর্জ লইব।
বিজ্ঞ রাজু রামচন্দ্রন মহাশয় তাঁহার নিবন্ধে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের একটা সিদ্ধান্তের নজিরও উল্লেখ করিয়াছিলেন। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত ইংরেজি ১৯৮৯ সালে ‘আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ’ নামা এক মামলায় একপ্রস্ত যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মামলার মূল বয়ান অনুসারে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ (ওরফে ‘পার্লামেন্ট’) এই সিদ্ধান্তের আগের বছর ‘সংবিধান (অষ্টম সংশোধন) আইন, ১৯৮৮’ প্রণয়ন করেন। এই সংশোধন আইন বলে জাতীয় সংসদ—অন্যান্যের মধ্যে—সংবিধানের ১০০ নম্বর অনুচ্ছেদটিরও সংশোধন করিয়াছিলেন। এই সংশোধনের মর্মানুসারে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের নিচের বিভাগের (অর্থাৎ হাইকোর্ট বিভাগের) বিদ্যমান এখতিয়ার কিছুটা পরিবর্তিত হইয়াছিল।
মামলার বাদীর দাবি অনুসারে ‘সংবিধান (অষ্টম সংশোধন) আইন, ১৯৮৮’ খোদ সংবিধানের ভিত্তি বা আদি গঠনের (ইংরেজি জবানে ‘বেসিক স্ট্রাকচার’) লঙ্ঘন করিয়াছে। তিনি দেখাইয়া দিয়াছিলেন, খোদ সংবিধানের ১ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে ‘বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র’। আনোয়ার হোসেন চৌধুরী নামের এই নাগরিকটি দাবি করিতেছিলেন, ‘একক প্রজাতন্ত্র’ কথাটির অর্থ এই যে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের (সুতরাং তাহার অন্তপাতী হাইকোর্ট বিভাগের) ক্ষমতা এই দেশের সর্বত্রগামী অর্থাৎ অবিভাজ্য।
বাদীর দাবি অনুসারে ‘সংবিধান (অষ্টম সংশোধনী) আইন, ১৯৮৮’ এই সর্বত্রগামী বিচারের ক্ষমতার (বা প্লেনারি জুডিশিয়াল পাওয়ারের) পরিবর্তন বা ক্ষুণ্ণতাসাধন করিয়াছে। বাদী কিন্তু সেখানেই থামেন নাই। অধিক আগাইয়া তিনি বলিয়াছিলেন, হাইকোর্ট বিভাগের সর্বত্রগামী বিচারের ক্ষমতাটি কিন্তু খোদ সংবিধানের ভিত্তি বা মূল গঠনের অংশবিশেষ। সুতরাং এই ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটাইবে বা ক্ষতি করিবে এমন কোন বিধান প্রবর্তন বা সংশোধন করা যাইবে না। আদালতেও তাহা গ্রাহ্য হইতে পারে না।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ১৯৮৯ সালের ঐ মামলার যুগান্তকারী রায়যোগে ৩ : ১ সংখ্যায় বিভক্ত হইয়া ‘সংবিধান (অষ্টম সংশোধন) আইন, ১৯৮৮’ আংশিক বাতিল ঘোষণা করিয়াছিলেন। এই বাতিল ঘোষণা করিতে বসিয়া তাঁহারা নতুন একটি যুক্তির প্রয়োগও ঘটাইলেন। এই নতুন যুক্তির নাম সংবিধানের ‘ভিত্তি বা আদি গঠন’। এই যুক্তির সমর্থনে তাঁহারা বিশেষ জোরের সহিত ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একটি মোকদ্দমার নজির দিয়াছিলেন। এই মামলার নাম কেশবানন্দ ভারতী বনাম কেরালা রাজ্য (১৯৭৩)। প্রকাশ থাকে যে ‘সংবিধান (অষ্টম সংশোধন) আইন, ১৯৮৮’ সংবিধানের আরো অনেক বিধান সংশোধন করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহা লইয়া কেহ মামলা-মোকদ্দমা বিশেষ রুজু করেন নাই। সুপ্রিম কোর্টও তাঁহাদের স্বতপ্রণোদিত এখতিয়ার প্রয়োগ করিতে চাহেন নাই। অথচ সেইসব সংশোধনেও সংবিধানের ‘ভিত্তি’ বলিয়া গণ্য হইতে পারে এমন বস্তু পরিবর্তিত হইয়াছিল।
সমস্যার মধ্যে মাত্র দুইটি কথা আমরা এখানে তুলিতে চাই। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তটিও কি ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে উঠিয়াছিল? রাজু রামচন্দ্রন মহাশয় তাঁহার নিবন্ধে দেখাইয়াছিলেন, সংবিধানের ‘ভিত্তি বা আদি গঠন’ নামক মতবাদটি আদিতে গণতন্ত্র বলিতে আমরা যাহা বুঝিয়া থাকি সরাসরি তাহার বিরুদ্ধেই দাঁড়ায়। এই মতবাদ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতানুসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ পদ্ধতিরও বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। ‘সংবিধানের ভিত্তি বা আদি গঠন’ মতবাদ প্রয়োগ করিয়া ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারকগণ নিজেদের ক্ষমতাই নিরংকুশ করিয়াছিলেন—একথা অস্বীকার করার উপায় নাই। বিচারকরা সঠিকভাবেই বলিয়াছিলেন সংবিধানই সর্বোচ্চ আইন কিন্তু সংবিধান যে প্রকৃত প্রস্তাবে কি বস্তু তাহা শুদ্ধমাত্র বিজ্ঞ বিচারকরাই বলিতে পারিবেন, অন্য কেহ নয়।
সকলেই জানেন, এই সিদ্ধান্ত প্রণীত হইবার দুই বছরের মাথায়—মোতাবেক ১৯৭৫ সালে—ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। জরুরি অবস্থা উপলক্ষে ভারত সরকার কয়েক দফা সংবিধান সংশোধন আইনও প্রণয়ন করিয়াছিলেন। নৈসর্গিক কারণেই সেই সকল সংশোধন বড় একটা জনপ্রিয় হয় নাই। ফলে সর্বোচ্চ আদালতের এই নতুন খুঁজিয়া পাওয়া ‘ভিত্তি বা আদি গঠন’ যুক্তিটি জনপ্রিয় হইয়া উঠিয়াছিল। রাজু রামচন্দ্রন ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের পঞ্চাশ বছরপূর্তি উপলক্ষে নতুন করিয়া প্রশ্ন তুলিয়াছিলেন, এই নতুন যুক্তিটি কি ভারতের মতন জটিল একটি দেশে ভবিষ্যতে যে সকল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হইবে তাহাদের পথেও প্রতিবন্ধক হইয়া দাঁড়াইবে না?
এক্ষণে আমি আরো একটি কথার অবতারণা করিতে চাহিব। এই নিবন্ধটি লিখিতেছি তথাকথিত সাধারণ মানুষের জন্য। তবে আইন ব্যবসায়ী, পণ্ডিত কিংবা বিচারকরা পড়িলেও আমি ঠেকাইতে পারিব না। ভারতের কেশবানন্দ ভারতী (১৯৭৩) কিংবা বাংলাদেশের আনোয়ার হোসেন চৌধুরী (১৯৮৯)—এই দুই মামলা সামনে রাখিয়াই আমার কথাটি বলিতেছি। কথার সপক্ষে আমি আরেকজন ভারতীয় আইন বিশারদ রামস্বামী আয়ারের নামও লইব।
ভারত আর বাংলাদেশ—দুই দেশেরই—সর্বোচ্চ আদালত একটা বিষয়ে একমত হইয়াছেন যে সংবিধানকে দুই অংশে ভাগ করা চলে—অর্থাৎ প্রকারান্তরে এই তাঁহাদের বক্তব্য দাঁড়ায়। সংবিধানের একাংশ যদি হয় তাহার ‘ভিত্তি’ তো অন্য একটি অংশকে ‘উপরিকাঠামো’ বলিতে হইবে। সমস্যা হইতেছে এক জায়গায় : খোদ সংবিধান প্রণেতারা তো এমন কোন কথা পরিষ্কার করিয়া কোথায়ও বলেন নাই। ভারতের সংবিধানের ৩৬৮ অথবা বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ এই বিষয়ে নীরবই রহিয়াছে। তাঁহারা কোথায়ও নির্দেশ করিয়া বলেন নাই সংবিধানের কোন কোন অংশ সংশোধনের অতীত বা অযোগ্য। তাহা হইলে সুপ্রিম কোর্ট এই কথা বলেন কিসের ভিত্তিতে?
সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক গৃহীত ‘ভিত্তি’ মতবাদের মর্মানুসারে সংবিধানের কোন কোন অংশ (অর্থাৎ শব্দ, অনুচ্ছেদ, বা ভাগ) সংশোধন করিবার ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে নাই। যদি তাহাই সত্য হয় তাহা হইলে মানিতে হইবে সর্বোচ্চ আদালত প্রচলিত অর্থের অতিরিক্ত আরো এক অর্থে ‘সর্বোচ্চ’ হইয়া উঠিয়াছেন। প্রচলিত অর্থ অনুসারে ‘সুপ্রিম কোর্ট’ হইতেছেন মাত্র রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ বা আদালতসমষ্টির উপরে সর্বোচ্চ। আর নতুন পাওয়া অর্থ অনুসারে বলিতে হইবে, নির্বাহী বিভাগ আর আইনসভার উপরেও বিচার বিভাগ—এই অর্থেও সুপ্রিম কোর্টই ‘সর্বোচ্চ’। আর এই অর্থটা যদি সত্যসত্যই সত্য হয় তো বলিতে হইবে সংবিধানের মূল বা ‘ভিত্তি’ই পরিবর্তিত হইল। রামস্বামী আয়ার এই বলিয়া রসিকতা করিয়াছেন : এই যুক্তিতেও যদি কেহ ‘ভিত্তি’ মতবাদের সমালোচনা করেন (অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট আইনসভার উপরে বসিতে পারেন না একথা বলেন) তো তাহাকে আগেভাগে সংবিধানের ‘ভিত্তি’ ও ‘উপরিকাঠামো’ নামক নতুন মতবাদের যৌক্তিকতাটা অজ্ঞাতসারেই মানিয়া লইতে হইতেছে।
ইহাকেই না বলে ‘না বলা বাণীর কূটাভাস’? আপনি যদি মনে করেন সংবিধানের কোন ভিত্তি বা উপরিকাঠামো ভেদ বলিয়া কোন কিছু নাই—ঝামেলা হইল না। কিন্তু যদি কবুল করেন ঐ ধরনের ভেদ আছে তো আপনাকেই বলিতে হইবে ‘ভিত্তি’ কোনটা আর কোনটা ‘উপরিকাঠামো’। ১৯৮৯ সালের ‘আনোয়ার হোসেন চৌধুরী’ মামলায় বাংলাদেশের বিচারকরাও এই প্রশ্নে একমত হইতে পারেন নাই। এমনকি যে তিনজন এক প্রশ্নে একমত হইয়াছিলেন তাহারাও ‘ভিত্তি’ বলিতে সকলে এক জিনিশ বোঝেন নাই।
তো অবস্থাটা কি দাঁড়াইতেছে? কোন মানুষ যদি আপনার কাছে হাজির হইয়া বলে, ‘আমি যাহা বলিব মিথ্যাই বলিব’ তো আপনি তাহার বাক্য হইতে কোন অর্থ উদ্ধার করিবেন? তিনি তাহার প্রকাশ্য কথামতো যদি সত্যসত্য ‘মিথ্যাই বলিলেন, তো তিনি মোটেও মিথ্যা বলেন নাই। কেননা তিনি মিথ্যা বলিবেন এই কথাটাও তো মিথ্যা। আর তিনি যদি তিনি মিথ্যা কথা না বলিয়া থাকেন তো তাহার ঘোষণাটি আদপেই মিথ্যা নহে। অর্থাৎ আমাদের ধরিয়া লইতে হইবে ঘোষণার প্রস্তাব মিথ্যা না হইল তো তিনি প্রকৃত প্রস্তাবে মিথ্যাই বলিয়াছেন। আমরা একটা কঠিন অবস্থার মধ্যে আসিয়া পড়িলাম—নয় তো কি?
আমি যদি বলি সংবিধানের সবকিছুই সংবিধান—তাহার মধ্যে ইতরবিশেষ নাই সুতরাং কোন কিছুই পরিবর্তন বা সংশোধন করা যাইবে না—তবে অন্যায় হইবে। আর যদি বলি সবই সংশোধন করা যাইবে তাহাও ন্যায়পরায়ণ কথা হইবে না। সুপ্রিম কোর্টের যুক্তির ভিত্তি এইখানেই। প্রশ্ন হইতেছে রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টই সর্বোচ্চ—সবার উপরে—এই কথা বলা মানে কি সংবিধানের ভিত্তি আমূল বদলাইয়া ফেলিবার শামিল নহে? সংবিধানের ভিত্তি পরিবর্তনের ক্ষমতা যদি জাতীয় সংসদের হাতে না থাকিয়াই থাকে তো সে ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের কাঁধে থাকিবে কি করিয়া?
এই সমস্যা—যুক্তিশাস্ত্রের ইতিহাসে—বহু পুরাতন, হাজার বছরের পুরাতন সমস্যা। একশত বছরও হয় নাই, ১৯৩১ সাল নাগাদ ইহার একটি গাণিতিক সমাধান বাতলাইয়াছিলেন অস্ট্রিয়া নামক দেশের বিখ্যাত গণিতজ্ঞ কুর্ট গোয়ডেল। কিন্তু এখানে তাহার আলোচনার অবকাশ নাই। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ প্রাচীন গণিতজ্ঞ বিচারকের নাম মাথায় তুলিয়া বলিব সুপ্রিম কোর্ট মাথার উপরে আর যাহাই নিন সম্ভবত গণিত শিখাইবার ভারটা আর লইতে পারিবেন না।
দোহাই
১. Ramaswamy R. Iyer, ‘Some Constitutional Dilemmas,’ Economic and Political Weekly, vol. 41, No. 21 (May 27-June 2, 2006), pp. 2064-2071.
২. Raju Ramachandran, ‘The Supreme Court and the Basic Structure Doctrine,’ in B. N. Kirpal et al (eds.), Supreme But Not Infallible: Essays in Honour of the Supreme Court of India (New Delhi: Oxford University Press, 2000), pp. 107-133.
(বি.দ্র: এই রচনার শিরোনাম লেখক দিয়েছিলেন ‘সংবিধানের ভিত্তি ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট’, কিন্তু আমরা বিশেষ বিবেচনায় সেটা পরিবর্তন করেছি। - ফিচার সম্পাদক)