আমাদেরও ক্রিকেট আছে
প্রতিবেশী ভারতে প্রায়ই ঋণের জালে জর্জরিত কৃষকের আত্মহত্যার খবর পাওয়া যায়। গরু জবাই নিয়ে বিভিন্ন রাজ্যে যেসব তুলকালাম হয়, তাতে দেশটির সাম্প্রদায়িক চিত্রই ফুটে ওঠে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশ সীমান্তে তাদের সীমান্তরক্ষীদের খুন-খারাবিও আন্তর্জাতিক বিশ্বে খুব ভালো বার্তা দেয় না। এতকিছুর পরও পুরো বিশ্ব যে দুটি জিনিসের কারণে ভারতীয়দের সমীহ করে এবং চেনে, তার একটি ক্রিকেট আরেকটি বলিউড।
আমাদেরও সংকটের শেষ নেই। স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর করের বোঝা চাপানো বাজেট নিয়ে বিতর্ক, রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট নানা দুর্যোগ, জঙ্গিবাদ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গণবিরোধী তৎপরতাসহ নানা বিষয় নিয়ে জন-অসন্তোষ রয়েছে। কিন্তু তার বিপরীতে আমাদের কী আছে?
বছর কয়েক আগেও গুগলে বাংলাদেশ লিখে সার্চ দিলে শুরুতেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর রাজনৈতিক সংঘাতের নানা ছবি সামনে আসত। এর বিপরীতে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত আর দীর্ঘতম মানগ্রোভ, হাজারো নদী, অনিন্দ্যসুন্দর লেক ও পাহাড়ঘেরা এই দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর পর্যটন সম্ভাবনার কথা আসত খুবই কম। কারণ ওই অর্থে বাংলাদেশের পজিটিভ ব্র্যান্ডিংটা কখনোই হয়নি। কিন্তু এখন আমাদের ব্র্যান্ডিং হচ্ছে, সেটির নাম ক্রিকেট। ভারতকে বিশ্ববাসী যে রকম ক্রিকেটের কারণে সমীহ করে, তেমনি এখন বাংলাদেশের নাম শুনলেও তারা বলবে, ওহ ম্যাশ, ওহ তামিম, ওহ সাকিব, ওহ মাহমুদউল্লাহ।
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে শুক্রবার রাতে যখন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৪০ রানে বাংলাদেশ ৪ উইকেট হারাল, তখন বাংলাদেশের খুব মানুষই বোধ হয় বিশ্বাস করছিলেন যে, টাইগাররা এই ম্যাচ জিতবে। কিন্তু মাহমুদউল্লাহ আর সাকিব নেমে যখন উত্তাল সমুদ্রে ভাঙা নৌকার হাল ধরলেন, তখন পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। টিভির স্ক্রিনে তখনো প্রেডিকশনে দেখাচ্ছিল, বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনা ১৮ শতাংশ। অথচ এর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বদলে যায় পুরো দৃশ্যপট। উত্তেজনায় অসংখ্য মানুষ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন রাস্তায় বড়পর্দায় খেলা দেখার জন্য।
সাকিব মাহমুদউল্লাহর প্রতিটি শটের পরে মানুষের যে উল্লাস, চিৎকার, ভালোবাসা, একজন ভ্রাম্যমাণ চা-বিক্রেতার চোখেমুখে যে আনন্দের ঝিলিক, প্যাসেঞ্জার পাওয়ার পরও রিকশাচালক তাঁর গদিতে বসে যেভাবে বড়পর্দার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, সেই দৃশ্য এককথায় প্রকাশ করলে যে শব্দটি উচ্চারণ করতে হবে, তা হলো ‘দেশপ্রেম’।
আমরা রাজনীতিতে দেশপ্রেম দেখাতে পারি না , বাজেটে দেশপ্রেম দেখি না, রাষ্ট্রপরিচালনা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বিচার ব্যবস্থা— প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশপ্রেমের যথেষ্ট ঘাটতি। কিন্তু ক্রিকেটই একমাত্র অনুষঙ্গ, যেখানে আমরা দলমত, পেশা, বয়স নির্বিশেষে সবাই দেশপ্রেমিক। সাকিব চার মারলেই চিৎকার করে উঠি, তামিম আউট হলেই বুকের ভেতরে ধক করে ওঠে। মুস্তাফিজ একটা ভালো ক্যাচ ধরলেই সমস্বরে সাবাস বলে উঠি আবার ক্যাচ মিস হলে একটা গালি দিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিই। এই বলে ওঠা এবং রাগের মাথায় যা খুশি লিখে ফেলা, সবটাই দেশপ্রেম। কেন না, যাকে বেশি ভালোবাসি, রাগও তার প্রতি বেশি।
আমরা স্মরণ করতে পারি, বছর কয়েক আগেও আমরা ভালো খেলার জন্য খেলতাম। অর্থাৎ বাজে ভাবে না হেরে গেলেই আমরা খুশি ছিলাম। কিন্তু সেই দৃশ্যপট এখন আমূল পাল্টে গেছে। এখন আমরা জেতার জন্যই খেলি এবং প্রতিটি ম্যাচে জিতব এই ভরসা এবং প্রত্যাশা থাকে বলেই আমাদের কষ্ট আর ক্ষোভও বেড়েছে। আমরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি পরিণত এবং সে কারণেই বোধ হয় অনেক বেশি রিঅ্যাক্টিভ। একটা খারাপ শট খেললেই আমাদের মেজাজ খারাপ হয়।
আমাদের এই প্রাণখোলা উচ্ছ্বাস আর আবেগের বাঁধভাঙা উল্লাসের একমাত্র অনুষঙ্গ এখন ক্রিকেট। ক্রিকেটের জয় এখন সবচেয়ে বড় উৎসব। আমাদের সবাইকে একই প্লাটফর্মে নিয়ে আসে ক্রিকেট। যদিও আখেরে এটা একটা বড় বাণিজ্য। কিন্তু তারপরও যখন বিদেশের মাটিতে আমরা অন্যকে হারাই কিংবা নিজেদের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের মতো দলকে হোয়াইটওয়াশ করি, তখন সেটা আর স্রেফ বাণিজ্যের মধ্যে থাকে না। সেটা পুরো দেশের সম্মানের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ ক্রিকেট এখন সারা বিশ্বে দুর্যোগ আর রাজনৈতিক প্রতিহিংসার দেশ বলে পরিচিত বাংলাদেশকে নতুন করে চেনাচ্ছে।
ক্রিকেটের মতো যদি আমরা আমাদের দেশের জন্য মঙ্গলজনক সব বিষয়ে দলমত নির্বিশেষে ঐক্য গড়ে তুলতে পারতাম, যদি আমাদের বুদ্ধিজীবীরা দলকানা না হয়ে সবাই দেশের জন্য সত্য কথাটা বলতেন, যদি তাঁরা সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিতেন এবং সরকারও সেসব মতামত ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে নিজেদের সমস্যা ও দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে সমস্যা সমাধানের উপায় বের করত, যদি আমরা নৈতিকতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ একটা জাতীয় চরিত্র গড়ে তুলতে পারতাম, তাহলে ক্রিকেটের এই সাফল্যের চেয়েও সেটি হতো অনেক বড় পাওয়া। সে রকম একটি ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে নিশ্চয়ই আমাদের নতুন প্রজন্ম।
লেখক : সাংবাদিক ও লেখক।