সাংবাদিকের চোখে
ঈদ, ছুটি ও ত্যাগ
জাতীয় দৈনিকে আমার প্রথম সংবাদ ছাপা হয় ২০০২ সালের ১০ মার্চ (সম্ভবত)। যার শিরোনাম ছিল ‘মফিজের ছুটি মেলে না’। আমি ওই মাসেই প্রথম আলোর ঝালকাঠি জেলা প্রতিনিধি হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করি।
রিপোর্টের বিষয় ছিল, ঝালকাঠি জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের পিয়ন মফিজুর রহমান মাসের পর মাস ছুটি পান না। কারণ তিনি একই সঙ্গে পিয়ন ও নৈশপ্রহরী। ছুটিতে বাড়িতে গেলে লাইব্রেরি অরক্ষিত। ফলে মফিজ নিজেও তাঁর দায়িত্ববোধ থেকে তাঁর ঊর্ধ্বতনকে ছুটির কথা বলতে সাহস পান না। এমনকি ঈদের বন্ধেও না। কিন্তু সাহস করে কথাটা তিনি আমাকে বলে ফেলেন এবং আমি এ নিয়ে রিপোর্ট করে দিই। এরপর মফিজের ওপর মহলে তোলপাড় শুরু হয় এবং তাঁকে ছুটি দেওয়া হয়। এ নিয়ে মফিজের আনন্দের সীমা থাকে না। ওই ঘটনার পর থেকে আমার এবং প্রথম আলোর প্রতি মফিজুর রহমানের একটা বিশেষ পক্ষপাত তৈরি হয়।
বছর কয়েক আগে একবার ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যেতে পারিনি। তখন এবিসি রেডিওতে কাজ করি। আব্বা ফোন করে বললেন, কবে আসবি? বললাম, এবার আসতে পারব না। অফিসে থাকতে হবে। শিক্ষকপিতা বলেছিলেন, যে চাকরি করলে বাবা-মায়ের সঙ্গে ঈদ করা যায় না, সেই চাকরি না করলে কী হয়! আমি কোনো জবাব দিতে পারিনি।
এবার ঈদেও ঢাকায় থাকছি। টেলিভিশনে চাকরি করি বলে যে কোনো একটি ঈদে ছুটি নিতে হয়। বাই-রোটেশন একটি টিম অফিসে থাকে, আরেকটি টিম ছুটিতে।
কোরবানিতে ছুটি নেব বলে এবার রোজার ঈদে অফিস করছি। এবার অবশ্য বাবা ওই জাতীয় কোনো কথা বলেননি। কারণ কয়েক বছর ধরে তিনি এটা দেখে অভ্যস্ত যে, তাঁর ছেলে এক ঈদে বাড়ি আসে, আরেক ঈদ ঢাকায়।
একবার কোরবানির ঈদের ছুটিতে মজার এক কাণ্ড ঘটে। তখন ব্যাচেলর। যখন যেখানে খুশি যাওয়ার অবাধ স্বাধীনতা। বাড়ি যাওয়ার জন্য ঈদের ঠিক আগের দিন সড়কপথে রওনা হই। মাওয়া ফেরিঘাটে গিয়ে দেখি যানবাহনের দীর্ঘ সারি। গাড়ি কখন ফেরিতে উঠবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে স্পিডবোটে নদী পার হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু বরিশাল রুটের স্পিডবোটের লাইনেও কয়েকশ মানুষ। দেখলাম পাশের আরেকটা লাইনে তেমন ভিড় নেই। জানা গেল, ওটা শরীয়তপুরের লাইন। ঢুকে পড়লাম সেই লাইনে এবং টিকেট কেটে নদী পার হয়ে মোটরসাইকেলে চড়ে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার মহিষার গ্রামের অনিন্দ্যসুন্দর নানাবাড়ি। তখন আমার মোবাইল ফোন নেই। নানি আমাকে দেখে বিস্মিত। ওই বছর ঈদ করলাম নানাবাড়িতেই।
২.
প্রায় বছরই গণমাধ্যমের একটা কমন শিরোনাম চোখে পড়ে, ছুটির ফাঁদে দেশ। গত বছরও ঈদুল ফিতরে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী আদেশে টানা নয়দিন ছুটি ভোগ করেছিলেন সরকারি কর্মকর্তারা। এবারও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ঈদের ছুটি শুরু হয়ে গেছে ১৮ জুন থেকে। ১৬ দিন বন্ধ থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাকাডেমিক সব কার্যক্রম। ৫ জুলাই পুনরায় কার্যক্রম শুরু হবে। শবে কদর, জুমাতুল বিদা এবং ঈদুল ফিতর উপলক্ষে দুই ধাপে এই ছুটি। কর্তৃপক্ষ বলেছে, নৈশপ্রহরী এবং নিরাপত্তা প্রহরীরা বন্ধকালীনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, অবকাঠামোসহ সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন।
তার মানে হলো, ছুটির এই আনন্দ বা ছুটির ফাঁদ সব পেশার এবং সব পদের মানুষের জন্য নয়। এই ফাঁদে পা দেওয়ার সৌভাগ্য কেবল সরকারি কর্মকর্তাদের। আমাদের মতো যাঁরা ২৪ ঘণ্টা চালু থাকা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, যাঁরা হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির মতো জরুরি ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন, তাঁদের কাছে ছুটি মানে বাই-রোটেশন এবং ওই ফাঁদে পা দেওয়ার সুযোগ নেই। বরং ঈদের ছুটি বড়জোর তিনদিন। চতুর্থ দিনেই অফিসে হাজির।
সরকারি লোকজনের জন্য ছুটির ফাঁদ তৈরি হলেও এটা পরিপূর্ণ মাত্রায় ভোগ করেন আসলে কর্মকর্তারা। কেননা, অফিসে কর্তাবাবু না এলেও পিয়ন ও লিফটম্যানকে আসতে হয়। ঝাড়ুদারকে আসতে হয়। গাড়ির চালককেও কর্তাবাবুর সঙ্গে সঙ্গে থাকতে হয়। ঈদের দিনেও তাঁর ছুটি মেলে কি না সন্দেহ। কারণ আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে কর্তাকে নিয়ে যেতে হয়। সুতরাং ছুটি বলতে যা বোঝায় তা ওই ওপরওয়ালাদেরই। তবে যে বছর কর্তারা ঈদ করতে দেশের বাইরে যান, সে বছর ছুটি ভোগ করার সুযোগ হয়তো হয় কর্তার ড্রাইভারের।
কিন্তু আমরা যারা পুরো দেশ ও বিশ্বে কী হচ্ছে বা হয়েছে সেই খবর জানাতে ত্রস্ত থাকি, ঈদযাত্রায় কত লোকের প্রাণ গেল, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে দুর্ভোগের মাত্রা কোথায় গিয়ে ঠেকল, বৃষ্টি নামলে ঈদের প্রধান জামাত কোথায় এবং কখন হবে ইত্যাদি খবর জানার জন্য মানুষ যেমন উন্মুখ থাকে, তেমনি ঈদের ছুটির ফাঁদকে আরো আনন্দদায়ক করার জন্য আমাদের বাড়তি বিনোদনের খোরাক জোগাতে হয়। ফলে দর্শকের আনন্দ নিশ্চিত করতে, অর্থাৎ তাদের ছুটিগুলো আরো উপভোগ্য করার স্বার্থে আমরা নিজেদের ছুটি জলাঞ্জলি দিই। ঈদের সকালে সেমাই খাওয়ার সময়ও যদি কোথাও আগুন লাগার খবর আসে, তাহলে সেমাইয়ের বাটি রেখেই দৌড় দিতে হয় ফায়ার সার্ভিসকর্মীদের। ঈদের দিন সকাল দুপুর রাতেও চিকিৎসা দিতে হয় ডাক্তার ও নার্সদের। সুতরাং একটি বড় জনগোষ্ঠীর ছুটি ভোগ করার স্বার্থে একটি ছোট অংশের এই যে ত্যাগ, তা হয়তো বড় অংশের লোকেরা ভাবেই না বা সেই ভাবনাটা তাঁদের মাথায়ও আসে না।
লেখক : সাংবাদিক ও লেখক।