এনটিভি সময়ের সাথেই থাকুক
গণমাধ্যমের কাজই হলো সময়ের সাথে থাকা এবং মানুষকে আগামীর পথ দেখানো। সময়ের সাথে থাকা মানে বর্তমান সময়ের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা। সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলা। সাদার ওপরে বাড়তি রং চড়িয়ে অর্ধসত্যকে সত্য কিংবা মিথ্যায় পরিণত করা গণমাধ্যমের কাজ নয়। গণমাধ্যম মূলত ঘটনাপ্রবাহের তথ্যদাতা। সেই তথ্য বিকৃত করা বা অতিরঞ্জিত করলে মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। বরং মানুষ চায়, বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ এবং সঠিক সংবাদ।
এ রকম বাস্তবতায় এনটিভির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে যখন একটি নিবন্ধ লেখার আমন্ত্রণ পাই, তখন একবাক্যেই রাজি হই। কারণ, আমি নিজে একটি সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেলে কাজ করলেও মিশ্র চ্যানেল এনটিভির প্রতি আমার একটা পক্ষপাত বরাবরই।
গত ২৪ মে আমার কর্মস্থল চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতেও এনটিভি অনলাইনে বাংলাদেশের গণমাধ্যম হিসেবে টেলিভিশনের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে লিখেছিলাম। সেখানে কিছু প্রশ্ন তুলেছিলাম এ রকম যে, আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কতটা পেশাদার, মানে এখানে জব সিকিউরিটি বা চাকরির নিশ্চয়তা কেমন? এখানে কর্মীদের মূল্যায়নে তাঁদের যোগ্যতাই কি প্রধান বিবেচ্য, নাকি অন্য কোনো গোপন যোগ্যতাও থাকতে হয়? টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় আর্থিক সুবিধা (বেতন, বোনাস, ওভারটাইম, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি ইত্যাদি) এবং মানবসম্পদ নীতি বা এইচআর পলিসি কতটা সাংবাদিক বা শ্রমিকবান্ধব? নারী সহকর্মীদের জন্য কতটুকু স্বস্তির নিশ্চয়তা দিতে পারছে আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো? এর জবাব নিশ্চয়ই খুব আশাপ্রদ নয়। কিন্তু অনেক হতাশার ভিড়েও হাতেগোনা যে দু-চারটি টেলিভিশন চ্যানেল উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর ইতিবাচক জবাব দিতে পারে, এনটিভি শুধু তাদের অন্যতমই নয়, বরং বাইরে থেকে যতটুকু এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে শুনি এবং সহকর্মীদের কাছ থেকে জানি, তাতে মনে হয়, জব সিকিউরিটি, আর্থিক নিশ্চয়তা/স্বাচ্ছন্দ্য এবং কর্মীবান্ধব মানবসম্পদ নীতিতে টেলিভিশনগুলোর মধ্যে এনটিভি এখন পর্যন্ত শীর্ষে। এ কারণে এনটিভি থেকে সাংবাদিকদের চাকরি ছাড়ার প্রবণতাও যথেষ্ট কম। আমরা অনেক সময় এনটিভিকে রসিকতা করে সরকারি প্রতিষ্ঠান বলি। কেননা, লোকে এখানে একবার চাকরি পেলে আর ছাড়তে চায় না।
সংবাদে বরাবরই একটা ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করে এই টেলিভিশন চ্যানেল। মিশ্র চ্যানেল হিসেবে এর একটি বড় অংশজুড়েই যেহেতু বিনোদনমূলক নানা অনুষ্ঠান থাকে, সেখানেও যথেষ্ট রুচিবোধের পরিচয় মেলে। মিশ্র চ্যানেলের সবগুলোই ধারাবাহিক নাটক বা বিদেশি সিরিয়াল প্রচার করে। কিন্তু এনটিভির ধারাবাহিক নাটক বরাবরই মানসম্মত এবং অনেক সিরিয়ালই এখানে বেশ দর্শকপ্রিয়তা পায়। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় আমরা এনটিভিকে দেখিনি। অনুষ্ঠান নির্মাণ ও প্রচারে এনটিভি বরাবরই যে রুচির পরিচয় দেয়, এটি তার একটি উদাহরণ।
কোন টেলিভিশন দর্শক হিসেবে আপনাকে টানবে, তার অনেকটাই নির্ভর করে স্ক্রিনের স্বচ্ছতা, রং ও রংবিন্যাসের ওপরে। একটি টেলিভিশন চ্যানেল যত ভালো সংবাদ বা অনুষ্ঠান নির্মাণ করুক না কেন, যদি তাদের স্ক্রিন স্বচ্ছ না হয় এবং রঙের বিন্যাস যদি ভারসাম্য ও যুক্তিপূর্ণ এবং দৃষ্টিনন্দন না হয়, তাহলে সেই টেলিভিশন দর্শককে টানে না। সেখানেও এনটিভিকে এগিয়ে রাখতে হয়। এর মূল রং সবুজ, যা বাংলার রূপ প্রকৃতিরই প্রতিনিধিত্ব করে। এনটিভির শব্দমান বা সাউন্ড কোয়ালিটিও যথেষ্ট ভালো। ফলে ভালো কনটেন্টের পাশাপাশি স্ক্রিনের স্বচ্ছতা, রং ও শব্দমানও এনটিভিকে অন্য যেকোনো চ্যানেলের চেয়ে এগিয়ে রাখে। অর্থাৎ দর্শককে যদি আপনি এগিয়ে রাখতে চান, তাহলে আপনার নিজেকে এগিয়ে রাখতে হবে অন্যের চেয়ে।
তবে এটা ঠিক, দেশে-বিদেশে যখন সংবাদযোগ্য বড় কোনো ঘটনা ঘটতে থাকে, যেমন—বড় সন্ত্রাসী হামলা/অভিযান (যেমন হলি আর্টিজান), কোনো মানবিক ঘটনা (যেমন—রাজধানীর শাহজাহানপুরে পাইপের ভেতরে পড়ে শিশু জিহাদের মৃত্যু) , কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ (যেমন—ঘূর্ণিঝড়, পাহাড় ধস), কোনো দুর্ঘটনা (যেমন—লঞ্চডুবি) ইত্যাদি ক্ষেত্রে এখন দর্শকের চোখ থাকে সংবাদভিত্তিক টেলিভিশনের পর্দায়। কেননা, মিশ্র চ্যানেলগুলো তাদের বিজ্ঞাপন ও অনুষ্ঠানের স্বার্থে অনেক সময় বড় ঘটনাও দীর্ঘ সময় লাইভ বা সরাসরি সম্প্রচার করতে পারে না। অনেক বড় ঘটনার সময়ই দেখা যায় মিশ্র চ্যানেলে বাংলা সিনেমা বা অন্য কোনো বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান চলে। বিষয়টা এমনও হতে পারে যে মিশ্র চ্যানেলগুলো সংবাদভিত্তিক চ্যানেলের সঙ্গে এই প্রতিযোগিতায়ই যেতে চায় না বা সেই প্রয়োজনও তাদের নেই; বরং সব সময় ঘটনার সঙ্গে থাকার প্রতিযোগিতাটা সংবাদভিত্তিক চ্যানেলের মধ্যেই প্রকট। এসব চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজের নামেও একধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলে। কিন্তু এনটিভিকে অন্তত এ ধরনের প্রতিযোগিতায় কখনো নামতে দেখা যায়নি। এনটিভি সময়ের সাথেই থাকুক এবং মানুষকে আগামীর পথ দেখাক—জন্মদিনে এই শুভকামনা।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।