ইয়াবা থিওরির নোংরা খেলা ও কিছু কথা
রাজধানী ঢাকায় যাঁরা পেশাগত বা ব্যক্তিগত কারণে রাত-বিরাতে বাসায় ফেরেন, তাঁদের অনেককেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জেরার মুখে পড়তে হয়। বিশেষ করে যারা রিকশা, মোটরসাইকেল বা পায়ে হেঁটে চলাফেরা করেন। পেশাগত কারণে আমাকেও অনেক সময় মধ্যরাতে বাসায় ফিরতে হয়। এখন অব্দি কোনো বাজে অভিজ্ঞতার মুখে পড়িনি। তবে কিছু ঘটনা নিজের চোখে দেখেছি। কিছু ঘটনা সহকর্মী, বন্ধু ও পরিচিতজনদের কাছ থেকে শুনছি। সেসব ঘটনা রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় এবং প্রধান আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্পর্কে আমাদের মনে কেবল নেতিবাচক ধারণাই তীব্র করে।
বিশেষ করে মধ্যরাতে পুলিশ যদি কোনো নাগরিকের গতি রোধ করে এবং যদি তার কোনো শক্ত পরিচয় না থাকে তাহলে ওই নাগরিকের কপালে বড় ধরনের দুর্ভোগ যে আছে, তা চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়।
কয়েকদিন আগে সাংবাদিক সাঈফ ইবনে রফিক ফেসবুকে লিখেছেন, রাতে শ্যামলী এলাকায় পুলিশ তাঁর গতি রোধ করে এবং তাঁর পকেট সার্চ করতে চায়। এ সময় সাঈফ ওই পুলিশের পকেট চেক করে দেখতে চান তার পকেটে ইয়াবা আছে কি না? এ অবস্থায় ওই পুলিশ সদস্য থতমত খান। কারণ এ রকম পরিস্থিতিতে তিনি নিশ্চয়ই আগে পড়েননি। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে সে যাত্রা সাঈফ বেঁচে যান।
বস্তুত রাতের বেলায় ঢাকায় টহল পুলিশের ভূমিকা অনেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। কয়েকটি উদাহরণে সহজে বোঝা যায়। আমরা দেখতে পাই বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র আবদুল কাদেরকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা বিকাশকে। আর এই তালিকায় সবশেষ যুক্ত হলেন ইংরেজি দৈনিক অবজারভারের ফটোসাংবাদিক আশিক।
আশিক মোহাম্মদের বাবা অসুস্থ প্রবীণ ফটো সাংবাদিক ফরহাদ হোসেন। মা গৃহিনী। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান আশিক ২৭ জুন মধ্যরাতে রাজধানীর রামপুরায় একটি অনুষ্ঠান শেষে বনশ্রীর বাসায় ফিরছিলেন। পথিমধ্যে শান্তিনগর বাজারের বিসমিল্লাহ হোটেলের সামনে তাঁকে আটকায় পল্টন থানার টহল পুলিশ। এরপর পুলিশ তাঁকে তল্লাশি করে। তিনি নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দেন। কিন্তু কিছু না পেলেও পুলিশ তাঁকে আটক করে। স্বজনরা জানান, আশিকসহ ভিন্ন ভিন্ন স্থান থেকে আটক আরো দুজনের বিরুদ্ধে ইয়াবা রাখার অভিযোগ এনে মাদকদ্রব্য প্রতিরোধ আইনে মামলা করে পুলিশ।
মামলা দায়েরের পর এর তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় থানার এসআই মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে। তিনি আসামিদের আদালতে হাজির করে পাঁচদিনের রিমান্ড আবেদন করেন। ওই রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, আসামিরা পল্টন থানাসহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় মাদক ব্যবসা করে। সময়স্বল্পতার কারণে আসামিদের দেওয়া নাম-ঠিকানা, ইয়াবার উৎস, জোগান দাতার নাম-ঠিকানা জানা যায়নি। এ জন্য আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচদিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। কিন্তু আদালত রিমান্ড আবেদন বাতিল করে আসামিদের জেল-হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বর্তমানে তাঁরা কারাগারে রয়েছেন।
আশিকের মা আছিয়া বেগম সাংবাদিকদের বলেন, ফজরের আজানের পরপর তাঁর ছেলে ফোন করে জানান, পুলিশ তাঁকে থানায় নিয়ে গেছে। কী কারণে নিয়ে গেছে তা সে জানে না। তাঁর কাছে এক লাখ টাকা দাবি করছে। না হয় ইয়াবা দিয়ে মামলায় ফাঁসিয়ে দেবে।’
আশিকের এই খবরের লিংকে রজতকান্তি বর্মণ নামে গাইবান্ধার এক স্থানীয় সাংবাদিক ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমাকেও নকল ইয়াবা দিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
(২)
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গত ৬ জুলাই পুলিশের বিরুদ্ধে এক যুবককে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর অভিযোগে ফরিদপুরের সদরপুর থানা ঘেরাও করে স্থানীয়রা। স্থানীয়দের অভিযোগ, শ্রাবণ ইসলাম (৩৪) নামের এক যুবককে সদরপুর থানার এসআই আজিজ, এএসআই সোহেল ফোর্স নিয়ে আটক করেন। এ সময় তাঁর কাছ থেকে ইয়াবা পাওয়া গেছে বলে দাবি করে পুলিশ। শ্রাবণের পরিবার যোগাযোগ করলে তাদের কাছে মোটা অংশের টাকা দাবি করা হয়। টাকা না দিলে মামলা দিয়ে কোর্টে চালান করা হবে বলে জানানো হয়। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে সদরপুর থানার সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করে স্থানীয় শত শত মানুষ। তাদের দাবি, শ্রাবণ ইয়াবা ব্যবসায়ী নন। বরং পুলিশ তাঁর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার জন্য তাঁকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়েছে।
এর আগে গত ১৬ জুন যশোর সদর উপজেলার কাজী নজরুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক জাহিদুল ইসলাম বিপ্লবকে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টার অভিযোগে এক এসআইকে থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়। অভিযোগ, সন্ধ্যার দিকে কলেজ থেকে মুরাদগড়ের বাসায় ফিরছিলেন ওই শিক্ষক। পথে যশোর-ঝিনাইদহ সড়কের কাজী শাহেদ সেন্টারের সামনে পুলিশ তাঁর গতি রোধ করে। এ সময় এসআই শামীমের সঙ্গে থাকা তাঁর এক সোর্স তাঁর পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। আর শামীম তাঁকে আটকের চেষ্টা করেন। কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে স্থানীয়রা জড়ো হলে এসআই শামীম পিছু হটেন।
(৩)
কলেজশিক্ষক, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে পুলিশের এই ইয়াবা থিওরির কবল থেকে খোদ সাংবাদিকেরও মুক্তি নেই।
শিক্ষক, লেখক ও গবেষক আফসান চৌধুরী পুলিশের এই ইয়াবা সন্ত্রাসের বিষয়ে ফেসবুকে লিখেছেন : I am learning only now how powerless we media workers are. Even a constable is more powerful than the entire community. Never been as helpless in 45 years as we are now. (আমি দেখছি আমরা গণমাধ্যমকর্মীরা এখন কতটা অসহায়। এমনকি একজন পুলিশ কনস্টেবলও এখন পুরো সাংবাদিক কমিউনিটির চেয়ে বেশি শক্তিশালী। গত ৪৫ বছরে আমরা এতটা অসহায় ছিলাম না।)
পুলিশের এই ইয়াবা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় মানুষ যেভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে, সেটা ইতিবাচক। কিন্তু অন্যদিকে এই প্রবণতা বন্ধ না হলে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় এবং প্রধান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের পারদ এতটাই নিচে নামবে যে, মানুষ একসময় তাদের ঘৃণা করতে শুরু করবে। সুতরাং ইয়াবা দিয়ে ফাঁসানোর এই নোংরা খেলা বন্ধে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া দরকার। কারণ যে বাহিনীর কাছে বিপদগ্রস্ত মানুষ সাহায্যের জন্য যাবে, তারাই যদি ইয়াবা নিযে নোংরা খেলায় লিপ্ত হয়, এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে?
লেখক : সাংবাদিক।