ব্যঙ্গ রঙ্গ
মৌসুমি নৌকা শোরুম
আমার সেই রাজনীতিবিদ মামাতো ভাইয়ের কথা মনে আছে তো?
একবার আওয়ামী লীগ, একবার বিএনপি এভাবে কয়েকবার দল পাল্টিয়েছেন। আমার নানা তাঁর এই গুণধর নাতির নাম রেখেছিলেন পল্টি তরফদার। এলাকায় তাঁকে নিয়ে মজার মজার ঘটনা চালু আছে। বয়স পঞ্চান্ন। বিয়েশাদি করেননি। নানার একটা মার্কেট আছে, ওখানে সময় কাটান। দোকান ভাড়া ওঠান। আর মার্কেট দেখাশোনা করেন।
আমার বাসায় এর আগেরবার আসার উদ্দেশ্য ছিল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সম্মিলিত জাতীয় জোটে যোগ দেবেন। যেহেতু সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত, তাই কোনোভাবে যদি আমার মাধ্যমে এরশাদের ওই জোটে নাম লেখাতে পারতেন, আর কী। তাঁর দলের নাম একাই ১০০। আমি তাঁকে এরশাদ সম্পর্কে কিছু কথা বলায় আর আমার সঙ্গে কোনো রাজনীতিবিদের পরিচয় নেই বলায় রাগ করে ওই রাতের কোচেই নিজ বাড়ির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছিলেন।
সেই ভাই এবার এসেছেন নতুন এক প্রস্তাব নিয়ে। আমি বাসায় ফিরে খাওয়া শেষ করে টেলিভিশন দেখছি, এমন সময় মামাতো ভাই কাশি দিয়ে আমার পাশে এসে বসেন।
‘আজকে একটু আগেই আসলা মনে হয়?’ আমাকে বলল।
‘জি ভাই। কাজ কম ছিল, আর তা ছাড়া আকাশের অবস্থা খারাপ দেখে আগেই বেরিয়ে পড়েছি। বৃষ্টিতে চলে এলে কমসে কম দুই ঘণ্টা লাগত। এখন এলাম মাত্র ৩০ মিনিটে।’
এ কথা বলা শেষ না হতেই আমার মুখোমুখি সোফায় এসে বসে পড়লেন। বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছে তাঁকে। সোফায় দুই পা তুলে বসেই বলা শুরু করলেন, ‘আমি এবার এসেছি তোমার সঙ্গে এই বৃষ্টি নিয়াই কথা বলতে।’
আমি তো অবাক! মামাতো ভাই কি আমাকে পানি বা বৃষ্টি বিশেষজ্ঞ ভাবছেন নাকি?
ভাই বললেন, ‘বৃষ্টি এলে রাস্তা কি ডুইবা যায় না?’
আমি আস্তে করে বললাম, ‘হ্যাঁ তা তো ডুবেই। কোমরপানি হয়ে যায় ঢাকা শহরের কোথাও কোথাও।’
‘আরে কয়দিন আগে পত্রিকায় দেখলাম, ঢাকায় বৃষ্টির মধ্যে একটা রিকশা উল্টে গেছে, ভেতরে একজন মহিলা ছিল। আহারে কী কষ্ট!’
আমি মামাতো ভাইয়ের এই বৃষ্টির বিষয়ে উদগ্রীব হওয়ার কারণটা বুঝতে পারছি না।
‘তোমাদের ঢাকা শহরের কোনো মা-বাপ আছে বলে মনে হয় না। মানুষের কী কষ্ট! বিশেষ করে শিশু আর মহিলাদের!’ মামাতো ভাই আবার বললেন।
আমার কেবলই মনে হচ্ছে, মামাতো ভাই কি এবার ঢাকার মেয়র হওয়ার কোনো খায়েশ নিয়ে এসেছেন? বলা যায় না কিছু। তাঁর কখন কী মাথায় আসে, কিছু ঠিক নাই।
‘আচ্ছা তোমরা লিখে কিছু তো করতে পারতাছ না এই জলাবদ্ধতা নিয়ে, তাই না?’ আমাকে বলল।
‘না, কম তো লেখা হচ্ছে না। আসলে ওসব লেখা কেউ পড়ে না। সবার গায়ের চামড়া মোটা হয়ে গেছে। ঢাকা মহানগরের পানিনিষ্কাশন-ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। পানি সরবে কোথায়? সব তো ভরাট হয়ে গেছে। ঢাকা ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, ডেসা, তিতাস গ্যাস—এসব সংস্থা বিভিন্ন দায়িত্বে থাকলেও তাদের কাজে কোনো সমন্বয় নেই। যখন যাদের খুশি রাস্তা কাটছে। আবার ভরাট করছে। আবার কাটা হচ্ছে। এভাবেই চলছে।’
‘সরকার তো…। যারা ভরাট করে ফেলছে, তাদের তো কিছু করতে পারছে না।’
আমার চিন্তা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। মামাতো ভাই কি ঢাকার জলাবদ্ধতা নিয়ে কিছু লিখেটিখে আনল নাকি আবার। আমাকে হয়তো অনুরোধ করবেন লেখাটা ছাপানোর।
মাথায় নানা প্রশ্ন এলোমেলো করে দিচ্ছে। ঠিক ধরতে পারছি না, ভাইয়ের ঢাকা আসার এবারকার মিশন আসলে কী?
‘ভাই, আপনার রাজনীতির কী খবর?’ বলেই ফেললাম।
‘না, রাজনীতি থেকে আপাতত দূরে আছি।’
‘কেন?’
‘এখন ব্যবসার দিকে মন দিয়েছি।’
‘ভালো, খুব ভালো। যে অবস্থা রাজনীতির, না করাই ভালো।’
‘আইচ্ছা বৃষ্টি যখন টানা চার-পাঁচ ঘণ্টা হয়, তখন ঢাকায় কতক্ষণ পানি জমে থাকে।’
আমি কতক্ষণ চুপ মেরে গেলাম। ব্যাপার কী? মামাতো ভাই বৃষ্টি আর জলাবদ্ধতা নিয়ে এত চিন্তিত কেন? ভাবছি। ঠিক এমন সময় আবার প্রশ্ন ছুড়ে মারলেন, ‘আইচ্ছা কতটুকু জায়গা ডুবে থাকে সেই চার-পাঁচ ঘণ্টা? এই ধরো তিনশ গজ, চারশ গজ নাকি আরো বেশি জায়গা ডুবে থাকে?’
আমি মহাচিন্তায় পড়ে গেলাম। কারণ, এতটা সঠিক পরিসংখ্যান দেওয়া আমার পক্ষে দুষ্কর।
‘কী, বলতে পারতাছ না?’
আমি তোতলাতে তোতলাতে বলে ফেললাম, ‘তা তো হবেই, চার-পাঁচশ গজ তো হবেই।’
‘যাক ভালো, ব্যবসা ভালোই হবে।’ বললেন ভাই।
‘জি মানে কিসের ব্যবসা ভাই? কে করবে ব্যবসা?’
‘নৌকার ব্যবসা।’
‘আপনাদের দলের প্রতীক না ওটা?’
‘আরে তুমি কিসের মধ্যে কী টানতাছ?’
‘তা হলে ব্যবসা করবেন যে বললেন?’
‘আমি বর্ষার এই মৌসুমে ঢাকার কয়েকটি গাড়ির শোরুমের পাশে কোষা নৌকার শোরুম দিতে চাই। ব্যবসা একেবারে খারাপ হবে না, কী বলো?’
আমি সামনের টেবিল থেকে গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিলাম। পানি খাবার পর চোখের সামনে শুধু পানিই দেখতে লাগলাম। থইথই পানি। বৃষ্টির পর ঢাকার বেশ কয়েকটা স্থানে কোমরপানি দেখা যাচ্ছে। আমার মামাতো ভাই গাড়ির শোরুমের পাশে নৌকার শোরুম দিয়ে বসেছেন। বেশ ভালোই নৌকা বিক্রি হচ্ছে। মানুষ পানিতে তলিয়ে যাওয়া রাস্তায় নৌকা চালাচ্ছে। বেশ একটা উৎসব উৎসব পরিবেশ।
মামাতো ভাইয়ের শোরুমের নামটাও সুন্দর ‘মৌসুমি নৌকা শোরুম’।
লেখক : ছড়াকার ও সাংবাদিক।