শ্রদ্ধাঞ্জলী
অধ্যাপক মমতাজুর রহমান তরফদার একজন জ্ঞান সাধক
‘যে জন শুনেছে সে অনাদি ধ্বনি
ভাসায়ে দিয়েছে হৃদয় তরণী
জানে না আপনা জানে না ধরণী
সংসার কোলাহল।’
সংসার কোলাহলের মাঝখানেও এমন কিছু মানুষ থাকেন, যাঁরা ধ্যানীর মতো একান্তে বসে নিজের কাজ করে যান সারাটি জীবন ধরে। সাধকের মতো এসব মানুষ হন পার্থিব জগতের প্রতি উদাসীন আর আপন ভোলা। এমনই একজন জ্ঞান সাধক ছিলেন অধ্যাপক মমতাজুর রহমান তরফদার (১৯২৮ - ১৯৯৭)। তিনি ছিলেন ইতিহাসবিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন ১৯৫২ সাল থেকে তাঁর প্রয়াণ দিবস পর্যন্ত। বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চা এবং গবেষণায় মূল্যবান অবদানের জন্য এদেশের ইতিহাসবিদরা আজও তাঁকে স্মরণ করেন শ্রদ্ধার সঙ্গে।
ইতিহাস চর্চা, শিক্ষকতা ও গবেষণা তাঁর সাধনার মূল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হলেও একই সঙ্গে তিনি বাংলা সাহিত্য ও শিল্পের ধারাটিকেও আত্মস্থ করেছিলেন। ইতিহাসবিদ তরফদারের গবেষণা থেকে আমরা পেয়েছি Husain Shahi Bengal, ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাস ও ঐতিহাসিক... এরকম অনেক মূল্যবান গ্রন্থ। আবার সাহিত্যপ্রেমি এই ইতিহাসবিদের কলম থেকেই আমাদের হাতে এসেছে কবিতার বই ‘চতুষ্ক’ এবং ‘বাংলা রোমান্টিক কাব্যের আওয়াধী-হিন্দি পটভূমি’ নামের গবেষণাধর্মী সাহিত্য।
সাহিত্যের প্রতি তাঁর এই ভালোবাসার সূচনা হয় কলেজ জীবন থেকে। বগুড়া আযিযুল হক কলেজে পড়ার সময় তিনি বিখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর সান্নিধ্যে এসেছিলেন। সেই সময়টা ছিল ১৯৪৯ সালে ভাষা আন্দোলনের উষালগ্ন। কলেজ বার্ষিকীতে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে একটি লেখা ছাপা হয়। যার কারণে বার্ষিকীটি বাজেয়াপ্ত করে সেই সময়ের পাকিস্তানি সরকার। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তরফদার ছিলেন সেই বার্ষিকীর সম্পাদক। অধ্যক্ষ মুজতবা আলী ছিলেন উপদেষ্টা। এই ঘটনার জের বহুদূর গড়ায়। পুলিশের দৃষ্টি এড়ানোর জন্য তরফদার আত্মগোপন করেন। আর গ্রেপ্তার এড়াতে বরেণ্য সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীকে রাতের অন্ধকারে বগুড়া ছেড়ে কলকাতায় চলে যেতে হয়। তবে তরুণ ছাত্র তরফদারের ওপর তিনি গভীর প্রভাব রেখে যান। তারই প্রেরণায় পরবর্তীকালে অধ্যাপক তরফদার বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। যার সুফল হিসেবে আমরা একজন ইতিহাসবিদের কলম থেকে পাই কবিতার বই।
নিবেদিত শিক্ষক এবং একাডেমিশিয়ান অধ্যাপক তরফদার ছিলেন একজন প্রগতিশীল মানুষ। বাংলাদেশের রাজনীতির উত্থান পতনের ক্রান্তিলগ্নে তাঁর এই প্রগতিশীল ভূমিকা আমরা বারবার দেখেছি। উনসত্তরের গণআন্দোলনের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামসুজ্জোহাকে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। পরের দিন ঢাকায় কারফিউ ছিল। কারফিউয়ের ভিতরেই অধ্যাপক তরফদার এবং আরো কয়েকজন শিক্ষকের উদ্যোগে ফুলার রোড আবাসিক এলাকায় একটি শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাক্তার মোর্তজার ফ্ল্যাটের পাশে বসেছিল সভাটি। তদানীন্তন ইকবাল হলের ছাত্ররা তাতে যোগ দেয়। সভার বক্তাদের বক্তব্য শেষ হলে অধ্যাপক তরফদার একটি মৌনমিছিল করার প্রস্তাব দেন। কারফিউ ভঙ্গ করে আবাসিক এলাকার বাইরে গেলে ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনে পাহারারত সৈন্যরা গুলি করতে পারে। তাই তাঁর প্রস্তাব ছিল মৌন মিছিলটি ফুলার রোডের ভিতরেই রাস্তা প্রদক্ষিণ করবে। কিন্তু নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সভার সভাপতি প্রস্তাবটি বাতিল করে দেন।
ঘটনাক্রমে আমি সেদিন ছিলাম সেই মিটিংয়ে। সভা শেষে সবাই চলে যাচ্ছে। দু’জন ছাত্র ফিরে যাচ্ছে হলে। আমি শুনলাম এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে বলছে, ‘যাই বলিস, তরফদার স্যার দেখতে ওরকম হালকাপাতলা হলে কি হবে, স্যারের সাহস আছে!’ বন্ধুটি কি উত্তর দিল, তা আর আমি শুনতে পাইনি। তবে নিজের পিতা সম্পর্কে এ রকম প্রশংসা বাক্য শুনে সেদিন গর্বিত হয়েছিলাম এ কথা আজও মনে আছে।
এরপর এলো মুক্তিযুদ্ধ। পঁচিশে মার্চ গণহত্যার রাত পার হলে পরের দিন ছাব্বিশে মার্চ সকালে ফুলার রোডে ঢুকে পাকিস্তানি সৈন্যরা শিক্ষকদের হত্যা করে। নিজের বাড়ির জানালায় দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখেছিলেন অধ্যাপক তরফদার। সেদিন তাঁকে বিচলিত হতে দেখেছি কিন্তু ভীত হতে দেখিনি।
তাঁর ছাত্ররা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। যুদ্ধের পুরোটা সময় ধরে তিনি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। রাতের অন্ধকারে মুক্তিযোদ্ধা ছাত্ররা আসত তাঁর কাছে। তিনি গোপনে অর্থ সংগ্রহ করে তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। শীতকালে গরম কাপড়, সোয়েটার জোগাড় করে দিয়েছেন। ফুলার রোডের অবাঙালি শিক্ষকদের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল পাকিস্তানি আর্মি অফিসারদের। যদি পাকিস্তানপন্থী শিক্ষকরা জানতে পারত, তাহলে তাদের মাধ্যমে খবর চলে যেত সামরিক অফিসারদের কাছে। সেই সময় এই কাজের শাস্তি ছিল বিনাবিচারে সরাসরি গুলি করে হত্যা। এর ভিতরেই অধ্যাপক তরফদার দেশের জন্য যুদ্ধরত ছেলেদের সহায়তা করে গেছেন পুরো নয়মাস ধরে।
একদিন তিনি একটি চিরকুট পেলেন। ইংরেজিতে টাইপ করা ছিল চিরকুটটি। তাতে তাঁকে জীবনের হুমকি দেওয়া হয় এই বলে যে পাকিস্তানের শত্রুদের সহায়তা করার কারণে তাঁকে হত্যা করা হবে। হঠাৎ করেই ফ্লোলার রোডের আঠারো নম্বরের ফ্ল্যাট বদল করে কুড়ি নম্বর বিল্ডিংয়ে চলে যান অধ্যাপক তরফদার। এই সিদ্ধান্তই তাঁর জীবন বাঁচিয়ে দেয়।
দেখতে দেখতে ডিসেম্বর মাস এসে গেল। ঢাকার আকাশে দেখা দিল মুক্তিযোদ্ধা পাইলটদের চালানো মিগ-২১ প্লেন। তারা এয়ারপোর্টে বোম ফেলল। পাকিস্তানি প্লেনের সঙ্গে তাদের আকাশযুদ্ধ হলো। কারফিউয়ের ভিতর ফুলার রোডে ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে এলো আলবদর বাহিনীর মাইক্রোবাস। একে একে তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শিক্ষকদের তুলে নিল তাদের মাইক্রোবাসে। অধ্যাপক তরফদার প্যান্ট শার্ট পরে প্রস্তুত হয়ে বসে থাকলেন তাঁর বসার ঘরে। দরজাটা খুলে নিষ্কম্প চোখে তিনি তাকিয়ে থাকলেন দরজার দিকে- ঘাতকরা এলে তাদের সঙ্গে চলে যাবেন। কিন্তু ঘাতকরা এলো না। তারা তাঁকে আঠারো নম্বর বিল্ডিংয়ের পুরোনো ফ্ল্যাটে খুঁজে না পেয়ে চলে গেল। ধরে নিয়ে গেল কয়েকজন শিক্ষক আর ডাক্তার মোর্তজাকে। স্বাধীনতার পরে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে পাওয়া যায় তাঁদের লাশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের থিয়েটার বিল্ডিংয়ে যদি কেউ যায়, চারতলায় দেখতে পাবে ‘উচ্চতর মানব বিদ্যা গবেষণা কেন্দ্র’। এই কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক তরফদার। এখানে তাঁর নামে যে সেমিনার কক্ষটি আছে, তাতে দেশ-বিদেশের জ্ঞানী গুণী অধ্যাপক, গবেষক এবং একাডেমিশিয়ানরা আসেন, বক্তৃতা দেন। মানব বিদ্যার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এখানে আলোচনা হয়। এই ছিল তাঁর স্বপ্ন, তাঁর সাধনা।
তাঁর সুযোগ্য ছাত্রী এবং সহকর্মী ডক্টর পারভিন হাসান অধ্যাপক তরফদার সম্পর্কে বলেছেন He was a scholar, a humanist and a patriot- all in one.
এই তিনটি বিশেষণ দিয়েই এই মহান ইতিহাসবিদকে পরিপূর্ণভাবে চেনা যায়। তিনি ছিলেন মানবতাবাদে দীক্ষিত একজন স্কলার, দেশের প্রতি ছিল যাঁর অসীম ভালোবাসা।
লেখক : মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার, অনুবাদক