অভিমত
কাদের জোট, কেন জোট?
ভোট এলেই জোট বাড়ে। শুরু হয় নয়া মেরুকরণ। যদিও শেষতক ঘুরেফিরে সেই আওয়ামী লীগ-বিএনপি। এ দুই দলের বাইরে যে জোটই হোক না কেন, তা নিয়ে গণমাধ্যমে কিছু সংবাদ শিরোনাম হলেও আখেরে যে লাউ সেই কদু।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি এখনো প্রায় ১৬ মাস। অর্থাৎ বর্তমান সংবিধানের আলোকে যদি সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে যদি নির্বাচন হয়। আর যদি কোনো কারণে আগামী বছরের ডিসেম্বরে সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়, তাহলে ভেঙে দেওয়ার পরবর্তী ৯০ দিন, অর্থাৎ ২০১৯ সালের মার্চের মধ্যেও ভোট হতে পারে।
ডিসেম্বরে অথবা মার্চে––ভোট যখনই হোক, সেটি দেশের দুটি বড় দলের অন্যতম বিএনপিকে ছাড়াই, অর্থাৎ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির আদলে হবে নাকি বিএনপির অংশগ্রহণে, সেটিই এখন আগ্রহের বিষয়। বিশেষ করে যখন ভোটের অনেকটা সময় বাকি থাকতেও মাঝেমধ্যেই নানা রকম জোট গঠন বা গঠনচেষ্টার খবর গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে––তখন এ নিয়ে ভাবনাচিন্তার অবকাশ আছে।
সবশেষ এই জোট গঠনপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হলো সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর উদ্যোগ। ২ আগস্ট রাতে রাজধানীর বারিধারায় তাঁর বাসায় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার যে বৈঠক হয়েছে, সেটি আগামী দিনের রাজনীতিতে একটা নতুন মেরুকরণ তৈরি করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, জেএসডি সেক্রেটারি আবদুল মালেক রতন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন; যেখানে বিশেষ আমন্ত্রণে যোগ দেন জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান এবং দলের চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের ছোট ভাই জি এম কাদের। বৈঠক শেষে বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ছেলে এবং বিকল্পধারার নেতা মাহী বি. চৌধুরী অতিথিদের যে হাস্যোজ্জ্বল বদনে বিদায় দেন, সেই ছবি টেলিভিশনের খবরে দেশবাসী দেখেছে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া নেতারা সাংবাদিকদের বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য গড়ে তোলার যে প্রক্রিয়া চলছে, তারই অংশ হিসেবে এই বৈঠক। সুব্রত চৌধুরীর ভাষায়, দেশের মানুষ বিএনপিকে নিয়ে হতাশ হয়েছে, সরকারে ওপরও আস্থা হারিয়েছে। এ কারণে এ দুই দলের নেতৃত্বাধীন জোটের বাইরে একটি বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর আগে গত ১৩ জুলাই আ স ম আবদুর রবের বাসায় বিকল্প জোট গঠন নিয়ে যে বৈঠক হয়েছিল, সেখানে পুলিশি তৎপরতার খবরও সংবাদ শিরোনাম হয়েছে।
বি. চৌধুরীর বাসায় এ বৈঠককে প্রধান দুই দলের শীর্ষ নেতারা বেশ ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, গণতন্ত্রের শত ফুল ফুটছে, এটা ভালো। তবে এই জোট কতদূর যায়, তা দেখতে হলে নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, অনৈতিক এবং অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে কেউ উদ্যোগ গ্রহণ করলে বিএনপি তাতে সমর্থন জানাবে।
আমরা স্মরণ করতে পারি, গত ৭ মে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে সম্মিলিত জাতীয় জোট নামে এইচ এম এরশাদ তাঁর দল জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে একটি নতুন জোটের ঘোষণা দিয়েছিলেন, যেখানে অধিকাংশ দলই ধর্মভিত্তিক। ৫৮টি দলের মধ্যে ৫৬টির কোনো নিবন্ধনই নেই। অধিকাংশ দলের নাম দেশের মানুষ জানেই না। ভোট তো দূরে থাক, সাধারণ মানুষের মধ্যে এসব দলের কোনো গ্রহণযোগ্যতাও নেই।
ভোট এলেই যে জোট গঠনের তোড়জোর শুরু হয়, তার আরো অনেক উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। যেমন ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি এইচ এম এরশাদ, জামায়াতের তৎকালীন আমির গোলাম আযম ও ইসলামী ঐক্যজোটের তখনকার চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হককে সঙ্গে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠন করেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল চারদলীয় জোটের আকার বেড়ে হয় ১৮ দলীয় জোট। এরপর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে শেখ শওকত হোসেন নিলুর নেতৃত্বে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) বেরিয়ে গেলে ভাঙন ধরে জোটে। আর গত বছরের ৭ জানুয়ারি বেরিয়ে যায় ইসলামী ঐক্যজোট।
শোনা যাচ্ছে, আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট থেকে খেলাফত মজলিস ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামকে নিজেদের জোটে ভেড়ানোর চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ। আর এই ইসলামী দল দুটিকে আওয়ামী লীগের পক্ষে নিয়ে আসতে কাজ করছে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দল হেফাজতে ইসলাম।
জাতীয় নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই আলোচনায় আসছে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপ, নানা দলের জোট-উপজোট, নির্বাচনে বিএনপি যাবে কি যাবে না এবং নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার নিয়ে তাঁদের দাবি আদায় ইত্যাদি। তবে ভোট সামনে রেখে এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন যে সংলাপ শুরু করেছে, তার ফলাফল নিয়েও সংশয় আছে। কেননা সুষ্ঠু ভোটের জন্য বিশিষ্টজন যেসব সুপারিশ দিয়েছেন এবং দেবেন, তার কতটা গ্রহণ করা ইসির পক্ষে সম্ভব হবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ না করার কোনো কারণ নেই। আর যেসব জোট হচ্ছে, সেগুলো রাজনীতি ও ভোটের মাঠে কিছু আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিলেও আখেরে ভোট হবে ওই বড় দুই দলের মধ্যেই।
তবে যদি বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে না আসে বা আসতে না পারে, তখন এই বিকল্প জোট বা কথিত তৃতীয় শক্তির একটা সম্ভাবনা আছে। তখন হয়তো এই তৃতীয় শক্তি বা বড় কোনো জোট সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসতে পারে। সে ক্ষেত্রে এরশাদের জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচন করবে নাকি আলাদা, সেটিও একটা বিবেচনার বিষয় হবে। যদিও এরশাদ সাহেব এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, এমনকি সরকারে তিনি নিজেসহ দলের আরো তিনজন নেতা (আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুজিবুল হক চুন্নু, মশিউর রহমান রাঙ্গা) বেরিয়ে যাবেন বলেও একাধিকবার ঘোষণা দিয়েছেন। সেই ঘোষণার বাস্তবায়ন অবশ্য এখনো দেখা যায়নি। আবার আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবে বলেও এরশাদ যে ঘোষণা দিয়েছেন, তারও বাস্তব ভিত্তি কতটুকু এবং বৃহত্তর রংপুর ছাড়া দেশের অন্য আসনগুলোয় জাতীয় পার্টির কী গ্রহণযোগ্যতা–সেটিও প্রশ্ন। ফলে আগামী নির্বাচন নিয়ে জাতীয় পার্টির আসলেই কী পরিকল্পনা, তার ওপরে অনেকটা নির্ভর করছে বিকল্প জোটের ভবিষ্যৎ।
বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রেখে অথবা সহায়ক সরকার কিংবা সবার জন্য সমান সুযোগ বা লেভের প্লেয়িং ফিল্ড নেই দাবি করে বিএনপি যদি একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেয়, তখন ভোট ও জোটের সমীকরণ পাল্টে যাবে। আবার বিএনপি নির্বাচনে যদি অংশ নেয় এবং যে তৃতীয় শক্তি বা জোট গঠনের উদ্যোগ আমরা দেখছি, সেই জোট বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয় কি না, সেটিও দেখার বিষয়। ফলে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এ রকম জোট ও ভোটের নানা সমীকরণ তৈরি হবে।
যদিও দেশের মানুষ এখনো পরীক্ষিত দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকেই বোঝে। এ দুই দলকে তারা উঠতে বসতে গালি দেয়, আবার ভোটও দেয় তাদের। এ দুই বৃহৎ দল বা জোটের বাইরে গিয়ে নতুন কাউকে ক্ষমতায় নিয়ে আসার মতো সচেতনতা যেমন দেশের মানুষের মধ্যে এখনো তৈরি হয়নি, তেমনি মানুষের মধ্যে সেই আস্থাও তৈরি করতে পারেনি বিকল্প কোনো দল। ফলে কোনো দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির চেয়ে নিজেদের উত্তম বলে প্রমাণ করতে না পারার এই ব্যর্থতাই মূলত ঘুরেফিরে নৌকা-ধানের শীষের লড়াই তৈরি করে।
লেখক : সাংবাদিক।