রোহিঙ্গা সংকট
মিয়ানমারে কেন নিষেধাজ্ঞা আরোপ নয়?
উত্তর কোরিয়ার ওপর আবারও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত ওই নিষেধাজ্ঞার খসড়া সোমবার পাস হয়। এবার টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় পিয়ংইয়ংয়ের বিরুদ্ধে। ২০০৬ সাল থেকে এ নিয়ে নবমবারের মতো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলো যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দক্ষিণ কোরিয়ার এই শত্রুরাষ্ট্রের ওপর। অথচ গণহত্যা চালিয়ে একটি পুরো জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করলেও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এখনো এ রকম কোনো ব্যবস্থা নেয়নি জাতিসংঘ।
এটি না বোঝার কোনো কারণ নেই যে উত্তর কোরিয়ার ওপর বারবার এই অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রধান কারণ দক্ষিণ কোরিয়ার সুরক্ষা। দক্ষিণ কোরিয়ার সুরক্ষা কেন প্রয়োজন? কারণ, ভূরাজনীতির হিসাব আর ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের খবরদারি নিশ্চিত করা। উত্তর কোরিয়া যেহেতু দক্ষিণ কোরিয়ার আতঙ্কের কারণ, অতএব যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের স্বার্থেই উত্তর কোরিয়াকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র গণ্য করে নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে বারবার নিষেধাজ্ঞার কবলে ফেলে। আর বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রের হুমকিতে থাকলে পাল্টা হুমকি দেওয়ার জন্য উত্তর কোরিয়াও একের পর এক পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়। বলা বাহুল্য নয় যে, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র আর পারমাণবিক অস্ত্রবাহী ক্ষেপণাস্ত্র না থাকলে দেশটিকে অনেক আগেই হয়তো ইরাক, সিরিয়া বা লিবিয়ার পরিণতি বরণ করতে হতো।
কিন্তু মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিধনে যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি কোনো স্বার্থ নেই, তাই সেখানে গণহত্যা বন্ধে পশ্চিমাদের শক্ত কোনো পদক্ষেপ নেই। নিয়মিত তারা বিবৃতি দিচ্ছে, সোমবারও হোয়াইট হাউস উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদ রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয়। তা ছাড়া নিরাপত্তা পরিষদে যদি মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব ওঠে, সে ক্ষেত্রে পরিষদের স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়ার ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে সংশয় আছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র নিজেও এই প্রস্তাবের পক্ষে থাকবে কি না, তা বলা মুশকিল। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী বাকি দুই সদস্য রাষ্ট্র যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স নিষেধাজ্ঞা আরোপের পক্ষে থাকতে পারে বলে ধারণা করা যায়।
চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ১৯৮৯ সাল থেকে মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল মার্কিন প্রশাসন। অবশেষে গত বছরের অক্টোবরে দেশটির ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। মনে রাখা দরকার, ওই মাসেই রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর নতুন করে গণহত্যা শুরু করে মিয়ানমার সরকার। আগে সামরিক শাসকরা যে কাজ করত, সেই একই কাজ একই কায়দায় শুরু করে মিয়ানমারের কথিত গণতান্ত্রিক সরকার; অলিখিতভাবে যে সরকারের প্রধান, দেশটির স্টেট কাউন্সিলর শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চি।
ষাটের দশকের শুরু থেকেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলমানদের জাতিগতভাবে নির্মূলের রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সে দেশের সেনাবাহিনী। আশা করা হয়েছিল, গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম হলে রোহিঙ্গাদের সুদিন আসবে। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের জন্য লড়াই করে শান্তিতে নোবেল পেলেও রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় ব্যর্থ অং সান সু চি। অবশ্য তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) মিয়ানমারের রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলেও ক্ষমতার একটা বড় অংশই নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনী। ফলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চির আদৌ কিছু করার আছে কি না, সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যম বা অনুষ্ঠানে যেসব কথা বলেছেন, সেগুলো বস্তুত সেনাবাহিনীর কথারই প্রতিধ্বনি।
রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে বলা যায়, সারা বিশ্বেই একটা প্রবল জোয়ার তৈরি হয়েছে। শান্তিতে নোবেলজয়ী সু চির বিরুদ্ধে কথা বলছেন অন্য দেশের নোবেলজয়ীরাই। জাতিসংঘ বলছে, সেখানে গণহত্যা চলছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বিশ্বের কোনো উদ্বেগই পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাচ্ছে না। বরং প্রতিদিনই হাজার হাজার রোহিঙ্গা প্রাণভয়ে পালিয়ে আসছে বাংলাদেশে। গত অর্ধমাসে এই সংখ্যা তিন লাখ ছাড়িয়েছে। তাহলে সমাধান কোথায়?
গত বছরের অক্টোবরে যখন রাখাইনে নতুন করে গণহত্যা শুরু হয়, তখন বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের সুপারিশ করেছিলেন। তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞা আরোপ ছাড়া মিয়ানমার সরকারের বোধোদয় হবে না। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, পরমাণু অস্ত্র নিয়ে জাতিসংঘ ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। সিরিয়া, ইরাকসহ বিভিন্ন দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এখন মিয়ানমারের ওপর যদি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, তাহলে সম্ভবত তাদের বোধোদয় হবে। নইলে হবে না।
রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধে সোমবার রাতে জাতীয় সংসদে যে প্রস্তাব পাস হয়, সেই আলোচনায় সংসদ সদস্যরাও মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগে জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানান। আশার কথা হলো, রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে একটি বিরল চিঠি লিখেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টনিও গ্যুতেরেস। সেই চিঠিতে তিনি রাখাইনে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় তৈরি হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন।
যুক্তরাজ্যের অনুরোধে গত ৩০ আগস্ট নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। জোরালো কোনো সিদ্ধান্ত না নিলেও মিয়ানমার পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ইইউসহ অনেক দেশ। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে মিয়ানমারের গণহত্যার বিষয়টি তোলার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এ অধিবেশনে যোগ দিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুটি তুলবেন।
তবে রাখাইনের সহিংসতার জেরে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যাতে কোনো ধরনের অবরোধ আরোপ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে মিয়ানমারও কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে। রাজধানী নেইপিদোতে এক সংবাদ সম্মেলনে মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা থং তুন বলেন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী দুই সদস্য চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে তাঁরা যোগাযোগ করছেন, যাতে রাখাইন সংকটের জেরে পরিষদে জাতিসংঘের যেকোনো ধরনের অবরোধ আরোপের প্রস্তাব ঠেকানো যায়। তিনি বলেন, ‘চীন আমাদের বন্ধু এবং রাশিয়ার সঙ্গেও আমাদের একই ধরনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। সুতরাং নিরাপত্তা পরিষদে এই বিষয়টিকে নেওয়া সম্ভব হবে না।’
বাস্তবতা হলো, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের যে অবস্থান, তাতে তার সঙ্গে মিষ্টি কথায় আর চিড়া ভিজবে না। শুধু বিবৃতি দিয়ে কিংবা উদ্বেগ জানিয়ে এই জাতিগোষ্ঠীকে রক্ষা করা যাবে না। ওষুধ একটাই, তা হলো আন্তর্জাতিক চাপ তথা নিষেধাজ্ঞা আরোপ। অর্থাৎ যখন রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকবে, তখন পরিস্থিতি বদলাতে পারে। আর সেটি সম্ভব না হলে জাতিসংঘ নিজেদের তত্ত্বাবধানে রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের জন্য একটি সুরক্ষা অঞ্চল গড়ে তুলতে পারে, যার নিরাপত্তা ও তদারকির দায়িত্বে থাকবেন আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষীরা । এ ছাড়া রোহিঙ্গা সংকটের আপাতত কোনো সমাধান আছে বলে মনে হয় না।
আমীন আল রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক।