অভিমত
রোহিঙ্গা গণহত্যা দূরের-কাছের দায়বদ্ধতা
আজকের বিশ্বে যেকোনো জাতীয় সংকট আন্তর্জাতিকতা পরিগ্রহ করছে। অতীতে ধীরগতিতে ক্রমশ জাতীয় সংকট অঞ্চল এবং বিশ্বকে স্পর্শ করত। এখন দুটো কারণে যেকোনো সাধারণ ঘটনা বৈশ্বিক রূপ ধারণ করছে।
প্রথমত, সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব এবং দ্বিতীয়ত বিশ্বায়ন। সাধারণ বাণিজ্যিক বিষয় থেকে রাজনীতির অসাধারণ ইস্যু—সবকিছুই বিশ্বকে আলোড়িত করছে। আর সন্ত্রাস, সহিংসতা এবং যুদ্ধের মতো বিষয়াবলি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য গুণে আন্তর্জাতিক সমীকরণ সৃষ্টি করছে। রোহিঙ্গা সংকট ও অতি অল্প সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক বলয়ে পক্ষ-বিপক্ষ, শত্রুতা-মিত্রতা এবং বিরোধিতা-বৈরিতা সৃষ্টি করেছে।
বিষয়টির আমানবিকতা, নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা ও ব্যাপকতা সামগ্রিকভাবে মানবজাতিকে আবেগাপ্লুত করেছে। মিয়ানমার সরকারের পরিকল্পিত এই গণহত্যা পৃথিবীর সর্বত্র নিন্দিত হচ্ছে। গরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলো সরকারের নৃশংসতার প্রতিবাদ করছে। পৃথিবীর তাবৎ মানবিক সংগঠন ও সুশীল সমাজ মানবতার বিরুদ্ধে এই অপরাধে মিয়ানমার সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইছে। সাধারণভাবে এটা হচ্ছে একটি স্বাভাবিক চিত্র। কিন্তু এর বিপরীত চিত্রও আছে। রাষ্ট্র বা সরকারগুলো যখন তাদের স্ব-স্ব স্বার্থ ও সুবিধা এবং আঞ্চলিক ও বিশ্ব সম্পর্কের ভিত্তিতে হিসাব-নিকাশ করছে, তখন আমরা সেখানে মানবিক আবেদন উপেক্ষিত এবং ভূলুণ্ঠিত হতে দেখছি।
রোহিঙ্গা সংকটকে যারা মানবিক দৃষ্টি দিয়ে দেখছে, তারা রাষ্ট্রিক তথা অভ্যন্তরীণ যুক্তিকে অগ্রাহ্য করছে। নতুন বিশ্বব্যবস্থায় তথা অনুসৃত আন্তর্জাতিক নীতিমালা এখন আর যেকোনো সরকার তার নাগরিকদের ওপর যথেচ্ছাচারের অধিকার রাখে না। এরা সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা-১৯৪৮, আন্তর্জাতিক অপরাধ-সংক্রান্ত রোম ঘোষণা-১৯৯৮ এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত-২০০২ প্রভৃতি আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার আলোকে সংগতভাবেই রোহিঙ্গা সংকটকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছে।
অন্যদিকে, যারা বিষয়টিকে নেতিবাচকভাবে দেখতে চাচ্ছে, তারা রাষ্ট্রিক শান্তি, স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন ও নিরাপত্তার দোহাই দিচ্ছে। বিশেষ করে ৯/১১-এর পরে কায়েমি স্বার্থবাদ যেকোনো মানবিক ও মুক্তিসংগ্রামের ঘটনাকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ তথা জঙ্গিবাদ বলে চালিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করছে।
জাতিসংঘ সাধারণভাবে নিরপেক্ষা, মানবিকতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে জাতীয় সংকটগুলো, যা মানবতাকে বিচলিত করে, তা তাৎপর্যপূর্ণভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করে। সেখানে অবশ্য জাতিসংঘের নিজস্ব কর্মধারা এবং বৃহৎ শক্তির কার্যব্যবস্থার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান লক্ষ করা যায়। জাতিসংঘের কর্মধারা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিধনের প্রশ্নে প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিবাদের প্রাতিষ্ঠানিকতা প্রদান করে। পরিচালিত কর্মধারা অংশ হিসেবে কফি আনান কমিশন একটি উল্লেখযোগ্য প্রয়াস। ২৫ আগস্ট ২০১৭-এর ব্যাপক নৃশংসতার পরে নিরাপত্তার পরিষদের বৈঠক আহ্বানে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তরিয় গুতেরেসের পদক্ষেপ সর্বত্র প্রশংসিত হয়েছে। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু-সংক্রান্ত সংস্থা ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গা সংকটের প্রথম থেকেই সংবেদনশীলতার সঙ্গে বিষয়টির মোকাবিলা করছে। এ মুহূর্তে সংগঠনের সহকারী কমিশনার জর্জ ওকত ওবু বাংলাদেশ সফর করছেন। এদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকামিশনার জায়েদ বিন রায়াদ আল হুসাইন ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ জেনেভায় মানবাধিকার কাউন্সিলের দেওয়া বক্তব্যে দেওয়া মিয়ানমারের নৃশংস সেনা অভিযানের তীব্র নিন্দা জানান। তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও স্থানীয় আধা-সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে, সেখানে নিয়মিতভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটছে, এমনকি পলাতক বেসামরিক মানুষের ওপর গুলি করা হচ্ছে—এমন অনেক তথ্যও স্যাটেলাইটের ছবি আমাদের কাছে রয়েছে।
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বলেছে, দুই লাখ রোহিঙ্গা শিশু ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিচালক জর্জ গ্রাহাম বলেছেন, ‘মানবিক পরিস্থিতি ভয়াবহ, রোহিঙ্গা শিশুদের দুর্ভোগ চরমে।’ এসব মানবিক আবেদন ও তৎপরতা মিয়ানমার সরকার কর্তৃক মানবিকতা লঙ্ঘনের প্রমাণ। জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত ও স্বীকৃত এসব মানবিক বিষয়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাঁচানোর স্বার্থে মিয়ানমার সরকারকে বাধ্যকরণ। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের নির্বাহী কর্তৃত্বের ধারক নিরাপত্তা পরিষদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ : রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনার জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ জরুরি বৈঠকে বসার কথা। মানবিক সংকট বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাজ্য ও সুইডেনের উদ্যোগে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মিয়ানমারের আরাকানে তথা রাখাইন রাজ্যে গণহত্যা তীব্রতর আকার ধারণ করার পর নিরাপত্তা পরিষদ দ্বিতীয়বারের জন্য এই বৈঠক করছে। একই ইস্যুতে গত সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে নিরাপত্তা পরিষদের আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এদের পরিসংখ্যন অনুযায়ী তিন লাখ ৭০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের গৃহীত ব্যবস্থার ওপর সংকট উত্তরণের বিষয়টি নির্ভর করছে। তাই এ বৈঠককে কেন্দ্র করে দ্বিবিধ সমীকরণ ঘটছে।
বাংলাদেশ সরকার সংগতভাবেই প্রত্যাশা করে যে সংকট সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদ যথার্থ ভূমিকা রাখবে। অন্যদিকে, মূল অপরাধী মিয়ানমার সরকার সর্বতোভাবেই চেষ্টা করছে, যাতে সিদ্ধান্ত তাদের বিরুদ্ধে না যায়। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলো, নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলো বিশেষত স্থায়ী সদস্য (যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ফ্রান্স ও রাশিয়া) এবং অস্থায়ী সদস্য (বলিভিয়া, মিসর, ইথিওপিয়া, ইতালি, জাপান, কাজাখস্তান, সেনেগাল, সুইডেন, ইউক্রেন ও উরুগুয়ে) রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে উভয় পক্ষের জোর তৎপরতা লক্ষণীয়। এরই মধ্যে রোহিঙ্গা সংকটের সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা নিম্নরূপ :
যুক্তরাষ্ট্র : যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রতি সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। ইতোপূর্বে তারা নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ বৈঠক আহ্বান করে। উল্লেখ্য, ২০১১ থেকে মিয়ানমার সরকার ‘বন্ধ দ্বার’ নীতির ব্যতিক্রম ঘটিয়ে বিশ্বের সামনে যখন নিজেদের উন্নমুক্ত করে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব পরিবর্তিত নীতিকে স্বাগত জানায়। মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা রহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হন। তারই ধারাবাহিকতায় আনান কমিশন গঠিত হয়। ওয়াশিংটন থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব সারাহ স্যান্ডার্স বলেন, মিয়ানমারে চলমান সংকটে যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তল্লাশির চৌকিতে হামলার পর কমপক্ষে তিন লাখ লোক তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। আমরা এই হামলা এবং চলমান সহিংসতার প্রতি আবারও নিন্দা জানাচ্ছি।
যুক্তরাজ্য : সংকটের প্রথম থেকেই যুক্তরাজ্য পরিচালিত নৃশংসতার নিন্দা করেছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব প্রদান এবং বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সোচ্চার। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, যুক্তরাজ্য ও সুইডেন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের চলমান বৈঠকটি আহ্বান করেছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা প্রশ্নে বৈশ্বিক জনমত গঠনে বিবিসি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
চীন : বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু চীন। বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ রয়েছে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময়ে সম্পর্কের উচ্চতার কথা বলা হয়। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাংলাদেশের বড় ধরনের এই সংকটে চীন বাংলাদেশের সঙ্গে নেই। মিয়ানমার এর জাতীয় নিরাপত্তা প্রধান দাবি করে আসছিল যে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের দৃঢ় সমর্থন দেবে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মোহা. শহিদুল হক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছিলেন, ‘ভারত ও চীন দুটিই আমাদের ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ। অতীতের মতো এবারও তারা আমাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে এই সমস্যা সমাধানে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।’ (প্রথম আলো, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭) কিন্তু পরবর্তীকালে চীন রাখাইনে ‘শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় মিয়ানমারের প্রয়াসের প্রতি সমর্থন জানায়’।
রাখাইনে মিয়ানমার সরকারের এই চেষ্টায় চীন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চেয়েছে। রাখাইনের রোহিঙ্গা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটায় যখন নিরাপত্তা পরিষদ রুদ্ধদ্বার বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ঠিক তখনই চীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিল। উল্লেখ্য, নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য চীন যেকোনো সিদ্ধান্ত বাতিলের পক্ষে ‘ভেটো’ (আমি মানি না) দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, বেইজিংয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জেং শুয়াং নিয়মিত ব্রিফিংয়ে রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত হামলার নিন্দা জানাই। রাখাইনের শান্তি ও স্থিতিশীলতা রাখতে মিয়ানমারের প্রয়াসের প্রতি আমাদের সমর্থন রয়েছে। আমরা মনে করি, জাতীয় উন্নয়ের স্বার্থে স্থিতিশীলতা সুরক্ষায় মিয়ানমারের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন থাকা উচিত।’ বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু চীনের এ অবস্থানে বাংলাদেশের মানুষ স্বাভাবিকভাবেই হতাশ ও ক্ষুব্ধ। চীনের এ ভূমিকার কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৯৪৮ থেকে ২০১১ সালের ‘মুক্তদ্বার নীতি’ পর্যন্ত চীনই ছিল মিয়ানমারের একমাত্র অভিভাবক। চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। মিয়ানমারের অফুরন্ত সম্পদের প্রতি চীনের রয়েছে বিশেষ আকর্ষণ। বর্তমানে রাখাইন রাজ্যে চীনের অর্থায়নে কয়েকটি বড় বড় প্রকল্প রয়েছে। বার্মার আমদানি দ্রব্যের ১৮ শতাংশ চীন থেকে আগত। মিয়ানমারকে কেন্দ্র করে চীন পূর্ব ও পশ্চিমে সড়ক ও সমুদ্রপথে বাণিজ্য সম্প্রসারণে পরিকল্পনা আটছে। মিয়ানমারের বৃহৎ অবয়বের পাশাপাশি বাংলাদেশের অবস্থান নিতান্তই অকিঞ্চিৎ বৈকি! তবে শান্তি ও স্বাধীনতার নীতি অনুসরণের যে কথা চীন জোরেশোরে বলে আসছে তাদের এ বিচ্যুতি যে কাউকে আহত করবে।
ভারত : বাংলাদেশের আরেক ‘মহান প্রতিবেশী’ ভারত ও হতাশ করেছে বাংলাদেশকে। চীন ও ভারত পরস্পর বৈরী হওয়া সত্ত্বেও রোহিঙ্গা নিধনে চীন ও ভারতের সমর্থন অভিন্ন হওয়ায় বিস্মিত হয়েছেন অনেকে। উল্লেখ্য, মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি ভারতের পূর্বাঞ্চরীয় রাজ্যসমূহ ‘সপ্তকন্যা’য় প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু ভারত সরকার পরিষ্কার বলে দিয়েছে তাদের তারা কোনোক্রমেই আশ্রয় দেবে না। ইতোপূর্বে এসব রাজ্যে আশ্রয়প্রার্থীরা হিন্দু হলে আশ্রয় পাবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে। কূটনীতিক সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে দিল্লিকে ঢাকার প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়েছে। গত ১০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক এবং ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলার মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ওই আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়। উল্লেখ্য, রোহিঙ্গাদের প্রতি চলমান সহিংসতার মধ্যেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার সফর করেন। তিনি প্রকারান্তরে রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের পরিচালিত নিগ্রহের প্রতি ভারতের সমর্থন জ্ঞাপন করেন। কূটনৈতিক ভাষার মারপ্যাঁচে এ সমর্থন ব্যক্ত করা হয়। বাংলাদেশ সরকার তার এ নীতিভঙ্গিতে আহত হলে ৯ সেপ্টেম্বর দিল্লি থেকে একটি দায়সারা গোছের বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। অথচ বাংলাদেশ ভারতে পরিচিত বন্ধু হিসেবে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন আশা করেছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, মিয়ানমার নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে অদৃশ্য প্রতিযোগিতা চলছে। ভারতের করপোরেট পুঁজির প্রতিনিধি নরেন্দ্র মোদি পৃথিবীর সর্বত্র স্বার্থ সুবিধা খুঁজছেন। মিয়ানমারের বিপুল সম্পদ ও সম্ভাবনা ভারতের জন্যও একটি বড় লাভের জায়গা। মানবিকতার পরিবর্তে যেখানে স্বার্থ ও সুবিধা অগ্রাধিকার পাওয়ায় বাংলাদেশের মানুষ বিস্মিত হয়েছে। চীনের মতো ভারতেরও মিয়ানমার এবং বিশেষত আরাকান রাজ্য তথা রাখাইন স্টেটে বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। ভারতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো জয়িতা ভট্টাচার্য ইতোমধ্যে বিবিসিকে বলেছেন, ‘ভারতের অবস্থাটা আসলে খুব জটিল।’ একদিকে বাংলাদেশ, অন্যদিকে মিয়ানমার—দুই দেশের সঙ্গেই ভারতের সম্পর্ক খুব ভালো। দুই দেশকেই ভারতের দরকার। কিন্তু এই রোহিঙ্গা প্রশ্নটি এমন একটি ইস্যু, যাতে এই দুই সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাটা ভারতের পক্ষে খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মিয়ানমারে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকাতে ভারতের মরিয়া হয়ে চেষ্টা।
তুরস্ক : মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে তুরস্কের ভূমিকা প্রথম থেকেই জোরালো ছিল। রোহিঙ্গা ইস্যুর প্রতি মানবিক সমর্থনের পাশাপাশি তুরস্ক মুসলিম বিশ্বের ভূমিকা সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সফরের আগে তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিন এরদোয়ান এবং তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির পরিদর্শন প্রশংসনীয় বিবেচিত হয়েছে। নৈতিক সমর্থনের পাশাপাশি তারা বিপুল ত্রাণ ও অর্থ সাহায্য প্রদান করেছে। তুরস্কের এই ভূমিকাকে মিয়ানমার পক্ষের লোকেরা এবং বাংলাদেশে তাদের এজেন্টরা নেতিবাচকভাবে দেখবেন এটাই স্বাভাবিক। গোটা বিশ্বে যেখানেই মানবতার বিপর্যয় ঘটছে, সেখানেই এরদোয়ান সরকার সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। ইতোপূর্বে তারা সাইপ্রাস ও গাজায় ত্রাণ জাহাজ পাঠিয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, এরদোয়ান সরকার বিলুপ্ত গৌরবময় উসমানীয় সালতানাতের উত্তরাধিকার বহন করতে চায়। বিলুপ্ত ‘খলিফাতুল মুসলিমীন’-এর প্রতিনিধি হিসেবে মুসলিম বিশ্বের প্রতি তারা হয়তো দায় অনুভব করেন।
মধ্যপ্রাচ্য : মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো তথা ওআইসির কার্যব্যবস্থায় যথার্থ সন্তুষ্ট নন সাধারণ মানুষ। যদিও ওআইসির মহাসচিব ঘটনার শুরুতে বাংলাদেশস্থ রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির পরিদর্শন করেছেন, তবুও ওআইসির তরফ থেকে যে শক্ত অবস্থান ও সহায়তা বাংলাদেশের মানুষ আশা করেছিল, তা পূরণ হয়নি। সৌদি আরব ১৯৭৮ সালে রোহিঙ্গাদের পাশে শক্তভাবে দাঁড়িয়েছিল। তখন বেশকিছু রোহিঙ্গাকে তারা আশ্রয় দিয়েছিল। এবারে যদিও তারা সহায়তার হাত প্রসারিত করেছে, তবুও তা যেন পূর্ণতা পায়নি এ রকম মন্তব্য আশান্বিত মানুষের। গৃহযুদ্ধ বিক্ষুব্ধ মধ্যপ্রাচ্য অবশ্য যথার্থ সহায়তা প্রদানের অবস্থানে নেই। অবশ্য ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লা ওজমা খামেনি রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমার সরকারের বর্বর গণহত্যা ও ভয়াবহ দমনপীড়নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মুসলিম দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ১২ সেপ্টেম্বর তিনি বলেছেন, গণহত্যা বন্ধে মিয়ানমার সরকারকে বাধ্য করার জন্য মুসলিম বিশ্বের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা। সরকারের দূরতম প্রতিবেশী পাকিস্তান সরকারের ভূমিকাও প্রত্যাশার চেয়ে অনেক দুর্বল।
ফ্রন্টলাইন স্টেট : বাংলাদেশ যেমন রোহিঙ্গা সমস্যায় যথার্থভাবে আক্রান্ত, তেমনি মিয়ানমার সন্নিহিত মুসলিম দেশ মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া- উভয় দেশ কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এসব দেশেও বেশ কিছু রোহিঙ্গা মুসলমান স্থলে ও নৌপথে আশ্রয় নিয়েছে। ইন্দোনেশীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা সফর তাদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার প্রমাণ দেয়। মলয়শিয়া সরকারের বক্তৃতা, বিবৃতিও বিপন্ন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জীবন, সম্পদ ও সম্মান রক্ষার জন্য বিভিন্ন দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যথার্থ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসসহ আরো কয়েকজন নোবেল বিজয়ী রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর হামলার প্রতিবাদে একটি যৌথ আবেদন নিরাপত্তা পরিষদে পেশ করেন। আরেক নোবেল বিজয়ী ডেসমন্ট টুটু অং সান সু চিকে লেখা এক খোলা চিঠিতে রোহিঙ্গা নিধন থেকে বিরত থাকা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্বের প্রধান প্রধান চ্যানেল ও পত্রিকা বিষয়টিকে অতিগুরুত্বপূর্ণ হিসেবে নানা ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছে।
প্রারম্ভেই বলা হয়েছে, বর্তমান বিশ্ব পরস্পর নির্ভরশীল। একের সমস্যা অন্যের জন্য বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করছে। প্রয়ই বলা হয়, আমরা গ্লোবাল ভিলেজে বসবাস করছি। ‘ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী’। এই বাস্তবতার আলোকে রোহিঙ্গা সমস্যা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সাধারণ্যে গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। আমরাও বিশ্বাস করি, রোহিঙ্গা জনগণ বিশ্ব জনমতের চাপে একদিন না একদিন সম্মানজনক সমাধানে পৌঁছাবে। এ ক্ষেত্রে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে বৈশ্বিক সমীকরণ কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাবে। ৱ
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।