উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন বলেছেন, তিনি বোমা মেরে জাপান ডুবিয়ে দেবেন। আর আমেরিকাকে ছাইভস্মে পরিণত করবেন। উত্তরে জাতিসংঘে মার্কিন দূত বলেছেন, তাঁরা উত্তর কোরিয়াকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করবেন।

বস্তুত পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তেজনাকর অবস্থা কোরিয়া উপদ্বীপে। সাম্প্রতিক সময়ে থার্মোমিটারের পারদের মতো ওঠানামা করছে কোরীয় সংকটের বাস্তবতা। মাসখানেক আগে বোঝা যাচ্ছিল, যুদ্ধ লাগে লাগে অবস্থা। কিন্তু যুদ্ধ লাগেনি। বোঝা যাচ্ছে, উভয় পক্ষ বাগযুদ্ধে যতটা আগ্রহী, আসল যুদ্ধে ততটাই অনাগ্রহী। তার কারণ, যুদ্ধ যে কারো জন্যই মঙ্গল বহন করে না, এটা সবাই বোঝে। তবে পাগল বা আধপাগলের বুঝের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। মার্কিনিরা পাগলের হাতে আগুনের গোলা দিয়েছে। আর কোরিয়ার কিম জং- উন বংশানুক্রমে আগুনের গোলা নিয়ে উত্তর কোরিয়ায় জবরদখলের শাসন চালাচ্ছেন। উভয়ের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ। আসলেই কি যুদ্ধ আসন্ন? বিবেক দিয়ে, বুদ্ধি দিয়ে যদি বিশ্লেষণ করা হয় তাহলে ‘যুদ্ধ দূরঅয়স্ত’। আর যদি জেদ নির্বুদ্ধিতা ও অপরিণামদর্শিতা দ্বারা চিন্তা করা যায়, তাহলে যেকোনো সময় যুদ্ধ বেধে যেতে পারে।

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, গত সপ্তাহে বৈশ্বিক সমীকরণে কিছুটা পরিবর্তন, পরিমার্জন ও পরিবর্ধন লক্ষ করা যায়। উত্তর কোরিয়ার পাগলামিতে ত্যক্ত-বিরক্ত চীন ও রাশিয়া নিস্পৃহ মনোভাব দেখাচ্ছিল। এমনকি চীন এ কথাও বলেছিল যে, উত্তর কোরিয়ার ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু এখন যখন মার্কিন হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা জোরদার হয়েছে, তখন চীন কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলছে, ‘কোরীয় উপদ্বীপে বিশৃঙ্খলা ও যুদ্ধ হতে দেওয়া হবে না,’ অন্যদিকে রাশিয়া সতর্ক করে বলছে, উত্তর কোরিয়ার মধ্যে সামরিক হস্তক্ষেপ ‘বৈশ্বিক বিপর্যয়’ ডেকে আনবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের যুদ্ধাকাঙ্ক্ষা চেপে দোষটি উত্তর কোরিয়ার ঘাড়ে চাপাতে অগ্রসর হয়েছে। জাতিসংঘে মার্কিন দূত নিকি হেলি বলেছেন, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন দেশটির সর্বশেষ ও সবচেয়ে শক্তিশালী পরমাণু বোমার পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ‘যুদ্ধে লিপ্ত হতে চাইছেন’। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ চাইছে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তাদের ধৈর্য সীমাহীন। উল্লেখ্য, যুদ্ধের আগে উত্তর কোরিয়াকে নিঃস্ব করে দিতে চাইছে মার্কিন প্রশাসন। আরো বাড়তি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে কার্যত সব রপ্তানি বন্ধ করে দিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।

এবারের নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়েছে পিয়ংইয়ংয়ের কয়লা, লোহা, সিসা, মাছ ও সামুদ্রিক খাদ্যপণ্য। এ ছাড়া কিম জং-উন ও উত্তর কোরিয়ার সরকারের সম্পদ জব্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। সেই সঙ্গে কিম ও তাঁর দেশের অন্য শীর্ষ পদাধিকারীদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপেরও পরামর্শ দিয়েছে ওয়াশিংটন। দেশের বাইরে উত্তর কোরিয়ার শ্রমিকদের কাজের সুবিধাও বাতিল করার পরামর্শ রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের খসড়ায়। ১১ সেপ্টেম্বর এ নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক নির্ধারিত রয়েছে। পিয়ংইয়ংয়ের মিত্র বলে পরিচিত বেইজিং ও মস্কো ওই নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে একমত হয়েছে। তবে এর প্রয়োগ অনেকটাই নির্ভর করে চীনের ওপর। কারণ পিয়ংইয়ংয়ের ৯০ শতাংশ বাণিজ্যই বেইজিংয়ের সঙ্গে। এসব নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন খোলাখুলি তাঁদের আপত্তির কথা জানিয়েছেন। রাশিয়া ও চীন এখন নতুন করে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন গত সপ্তাহে বলেছেন, পিয়ংইয়ংয়ের পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে কঠোর অবরোধ আরোপিত হলে ‘হিতে বিপরীত হতে পারে’। তিনি আরো বলেন, সামরিক হস্তক্ষেপ এ অঞ্চলে ‘বৈশ্বিক বিপর্যয়’ ডেকে আনবে।

চীনে অনুষ্ঠিত ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন শেষে ভ্লাদিমির পুতিন উত্তর কোরিয়া ইস্যুতে নতুন সংকট সৃষ্টির জন্য মার্কিন কূটনীতির সমালোচনা করেন। পুতিন বলেন, পিয়ংইয়ং তার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানো ততক্ষণ বন্ধ করবে না, যতক্ষণ তারা নিরাপদ অনুভব করে। পুতিন যুক্তি দেখান, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে তা হবে অকার্যকর ও অদক্ষতার পরিচায়ক। রুশ নেতা সংকট সমাধানে সংলাপের জন্য উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘তা না হলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে আর তাতে বিশ্ব বিপর্যয় নেমে আসবে। এতে বহু লোক বিপদগ্রস্ত হবে।’

কোরিয়া পরিস্থিতিতে চীনের মনোভাবের যে উত্তর কোরিয়া অনুকূল পরিবর্তন হয়েছে, তা বোঝা যায় জাতিসংঘে নিযুক্ত চীনের কূটনীতিক লো জেই-এর বক্তব্যে। তিনি আলোচনায় ফেরার জন্য সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, কোরীয় উপদ্বীপে বিশৃঙ্খলা ও যুদ্ধ হতে দেবে না চীন। উল্লেখ্য, উত্তর কোরিয়ার প্রধান মিত্র ও প্রতিবেশী চীনের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে বলে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল বিশ্বাস করে। তবে তারা উত্তর কোরিয়াকে ব্লাঙ্ক চেক দিতে নারাজ। উত্তর কোরিয়ার পক্ষে শক্ত মন্তব্য করার পাশাপাশি চীন এও বলেছে, উত্তর কোরিয়া আবারও পরমাণু পরীক্ষা চালিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যাপক আপত্তিকে উপেক্ষা করেছে।

উল্লেখ্য, উত্তর কোরিয়া মাঝেমধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে কোরীয় পরিস্থিতিকে আরো উত্তেজনাকর করে তুলছে। গত দুই মাসে উত্তর কোরিয়া দুবার আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের (আইসিবিএম) সফল পরীক্ষা চালিয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন দ্বীপ গুয়ামে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার হুমকি দিয়েছে দেশটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ওয়াশিংটনের অস্ত্রও প্রস্তুত রয়েছে। তবে তার প্রশাসন বারবার বলে এসেছে, উত্তর কোরিয়াকে নিরস্ত্র করতে সামরিক অভিযানের বিষয়টি ‘বিবেচনায় থাকা বিকল্পগুলোর একটি’। বার্তা সংস্থার খবরে বলা হয়েছে, আরো ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে উত্তর কোরিয়া। এর আগে ৩ সেপ্টেম্বর উত্তর কোরিয়া সফলভাবে হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষা চালিয়েছে বলে দাবি করে। এই বোমা পরমাণু বোমার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। এটি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রে ব্যবহার করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা উত্তর কোরিয়ার হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণের দাবি সম্পর্কে নিশ্চিত নন। কিম জং-উনের বাগাড়ম্বরতার অংশ হিসেবে তারা এ দাবিকে বিবেচনা করছেন।

আমরা আগেই বলেছি, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সর্বশেষ কোরীয় পরিস্থিতির আলোকে মার্কিন পক্ষ-বিপক্ষ সমীকরণ ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। দক্ষিণ কোরিয়ার ইয়নহাপ নিউজ এজেন্সির খবরে বলা হয়, তাদের নৌবাহিনী এরই মধ্যে লাইফ নৌ-মহড়া চালিয়েছে। সেই সঙ্গে উত্তর কোরিয়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে যে উত্তর কোরিয়া প্ররোচিত করলে ‘আমরা তাৎক্ষণিক পাল্টা আক্রমণ করব।’ যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ‘থাড-টার্মিনাল হাই অল্টিচুড এরিয়া ডিফেন্স’ মোতায়েন সম্পন্ন করার ঘোষণা দিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। চীন একই সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা ও দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন সমরাস্ত্র মোতায়েনের বিরোধিতা করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপের পর জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল বলেন, তিনি পিয়ংইয়ংয়ের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের কঠোর অবরোধ আরোপে চাপ দেবেন।

এসব যুদ্ধাবস্থা এবং আন্তর্জাতিক সমীকরণ সত্ত্বেও শান্তিপূর্ণ উপায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের প্রয়াশও লক্ষণীয়। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শান্তিপূর্ণ উপায়ে কোরীয় সংকটের সমাধান সম্পর্কে নিরাপত্তা পরিষদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সম্পর্কে তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নেওয়া নতুন যেকোনো পদক্ষেপের লক্ষ্য হওয়া উচিত উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ করা। উত্তর কোরিয়ার যুদ্ধংদেহী আচরণের কারণে বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ দেশটিতে সামরিক অভিযান পরিচালনার পক্ষে কথা বলছেন। বিশেষ করে ডোনাল্ড প্রশাসনের হোয়াইট হাউসভিত্তিক কর্মকর্তারা গরম গরম কথা বলছেন। কিন্তু সমরবিদরা বলছেন, অন্তত এ মুহূর্তের জন্য সামরিক হস্তক্ষেপ অসম্ভব।

ট্রাম্পের সাবেক প্রধান কৌশলবিদ স্টিভ ব্যানন ত্রৈমাসিক সাময়িকী দি আমেরিকান প্রসপেক্টাসে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে চলমান সংকট সমাধান সম্ভব নয়। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জিম ম্যাটিস সাংবাদিকদের বলেছেন, কূটনৈতিক সমাধান অসম্ভব নয়। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন বারবার বলে আসছেন, পিয়ংইয়ংকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসার ব্যাপারে তিনি আশাবাদী। এমন প্রেক্ষাপটে সুইজারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট লইতহার্দ শান্তি আলোচনার ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালনের প্রস্তাব দিয়েছেন। যুদ্ধ অথবা শান্তির বিষয়টি এখনো আপেক্ষিক। শিগগিরই একটা সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে আন্তর্জাতিক মহল আশাবাদী। আর সে আশা শান্তির পক্ষেই।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।