প্রতিক্রিয়া
রোহিঙ্গা সংকটের প্রলম্বিত ভবিষ্যৎ
মঙ্গলবার দিনটি নানা কারণে রোহিঙ্গা ইস্যুতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এমনিতেই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশন শুরুর জন্য এ দিনটি নির্ধারিত। সেপ্টেম্বরের তৃতীয় মঙ্গলবার সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়।
এই মঙ্গলবারে মিয়ানমারের নেত্রী নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চি তাঁর দেশের জনগণের উদ্দেশে ভাষণ দেবেন বলে আগে থেকেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন। তাঁর ভাষণে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো সে দেশের সেনাবাহিনীর গণহত্যার ইস্যুতে কী বক্তব্য আসে সেদিকে নজর ছিল গোটা দুনিয়ার।
আবার এদিন জতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের উদ্বোধনী বক্তব্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উত্তর কোরিয়া বিষয়ে কী বলেন আর রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কিছু বলেন কি না সেদিকেও বিশ্ববাসীর একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল। তবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে এ দিনটি আরেকটু বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে আরো দুটি ঘটনায়। এর একটি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকার; আরেকটি হলো জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্বোধনী ভাষণ।
প্রথমেই অং সান সু চির ভাষণের বিষয়ে আসি। বাংলাদেশের জন্য এই ভাষণের তাৎপর্য অনেক। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ সামনের দিনগুলোতে কীভাবে পা ফেলবে তার জন্য কিছু বার্তা সু চির ভাষণে আছে। খেয়াল রাখতে হবে, সু চি তাঁর এই ভাষণ ইচ্ছে করলে রাখাইনে সামরিক অভিযান শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যেও দিতে পারতেন। বা নিদেনপক্ষে দু সপ্তাহ পর তো দিতেই পারতেন, যখন সারা বিশ্ব তাঁর সমালোচনায় মুখর হয়েছে। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি এই ভাষণের জন্য সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের এই মঙ্গলবারকেই বেছে নিয়েছেন এবং সকাল বেলা চা পানের পর ঠান্ডা ও পরিষ্কার মাথায় তিনি ভাষণটি দিয়েছেন।
সবচেয়ে বড় চমক ছিল, তিনি ইংরেজি ভাষায় জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন; বার্মিজ ভাষায় নয়। জাতির উদ্দেশে ভাষণ তো নিজের দেশের ভাষায় দেওয়া হয়। তাহলে সু চি কেন ইংরেজিতে ভাষণ দিলেন? একটু চিন্তা করে দেখলে বোঝা যাবে ১৯ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার সকালবেলা ইংরেজিতে ভাষণ দেওয়ার পেছনে কী কারণ আছে। প্রথমত, এদিন তাঁর ভাষণের কয়েক ঘণ্টা পরেই জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন বসবে। সুতরাং তিনি যা বলবেন তা যেন সাধারণ পরিষদে বক্তব্য রাখতে যাওয়া বিশ্ব নেতাদের কাছে পরিষ্কার হয় সেজন্য তিনি ভাষণটি ইংরেজিতে দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, তাঁর বক্তব্য থেকে বিশ্ব নেতারা যেন পরিষ্কার একটা বার্তা পান এবং সে অনুযায়ী রোহিঙ্গা ইস্যুতে কে কোনদিকে যাবেন তা যেন ঠিক করতে পারেন।
সু চির বক্তব্যে যে সে দেশের সেনাবহিনী এবং চীনের মতামতের একটি প্রতিফলন পাওয়া যাবে তা অনেকে আগে থেকেই অনুমান করছিলেন। তারপরও শান্তিতে নোবেল বিজয়ী এ নেত্রীর কাছ থেকে কিছু একটা প্রত্যাশা করেছিল পৃথিবীর তাবৎ শান্তিকামী মানুষ। সাবেক নোবেল বিজয়ীরা তাঁকে এ বিষয়ে পত্র দিয়ে বুঝিয়েছেনও।
কিন্তু সু চি পৃথিবীর সব শান্তিবাদিদের মুখে চুনকালি দিয়েছেন। তিনি তাঁর ভাষণে সামরিক বাহিনীর বক্তব্যেরই সারমর্ম তুলে ধরেছেন। একজন শান্তি পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে শান্তির পক্ষে একটি শব্দও তাঁর মুখ থেকে বের হয়নি। যা বের হয়েছে তা ছিল মেকি। গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গাদের নাম পর্যন্ত তাঁর ভাষণে আসেনি; তাদের দুঃখ-দুর্দশা তো পরের কথা। নারী হয়ে তিনি একটি বার উচ্চারণ করেননি ধর্ষিত রোহিঙ্গা নারীদের কথা।
সু চি বলেছেন, ‘রাখাইনে তেমন একটা সহিংসতা হয়নি, যেমনটা বলা হচ্ছে। অর্ধেকের বেশি মুসলিম রোহিঙ্গা এখনো রাখাইনে আছে। কেন অন্যরা সেখান থেকে পালিয়ে গেছে তা আমার জানা নেই; আমরা তা খুঁজে দেখব। ৫ সেপ্টেম্বরের পরে রাখাইনে কোনো দমন অভিযান চলেনি। নব্বইয়ের দশকে করা প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী আমরা যাচাই-বাছাই করে তাদের ফেরত আনব।’
সু চির এই বক্তব্য সারা পৃথিবীর মানুষকে চরমভাবে হতাশ করেছে। তিনি এমনকি মিথ্যাচারও করেছেন ভাষণে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং বিবিসি তাঁর ভাষণে মিথ্যাচারের বিষয়টি প্রকাশ্যে বলেছে। বিবিসির সাংবাদিক জোনাথান হেড বাংলাদেশের কয়েকটি গণমাধ্যমকে বলেছেন- ‘৫ সেপ্টেম্বরের পর অভিযান হয়নি’ কথাটা ডাহা মিথ্যা। তিনি নিজে অন্তত ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাখাইনে সহিংসতা দেখতে পেয়েছেন।
আগেই বলেছি, সু চির বক্তব্যে সেনাবাহিনীর মতামতের প্রতিফলন থাকবে এটাই স্বাভাবিক, তবে তা যে এত নির্লজ্জ মিথ্যাচার হবে তা ছিল অনেকের চিন্তার বাইরে। সে যাই হোক, আমাদের চিন্তা করতে হবে সু চি বাংলাদেশের জন্য এখানে কী বার্তা দিয়েছেন। আমরা প্রথমত পরিষ্কার যে বার্তাটি এখান থেকে পেলাম তা হলো, মিয়ানমার খুব সহসা এবং বিনা চাপে (সামরিক ও রাজনৈতিক) একটি রোহিঙ্গা পরিবারকেও ফেরত নেবে না এবং এবারের রোহিঙ্গা সংকট অনেক প্রলম্বিত হবে; তা কতটা, কেবল সময়ই বলতে পারবে। দ্বিতীয়ত, সু চির ভাষণের মাধ্যমে মিয়ানমারের প্রকৃত শাসকরা (সামরিক বাহিনী ও উগ্রবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা) এই বার্তা দিয়েছে যে, বাংলাদেশ যতই দৌড়-ঝাঁপ করুক না কেন, হালে পানি পাবে না। এমনকি এই ইস্যুতে বিশ্বের অনেকের চাপে তারা ভীতও নয়।
কেন তারা এমনটি মনে করছে? কারণ, আঞ্চলিক সব বৃহৎ শক্তি- চীন-রাশিয়া-ভারত আজ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেনি। বরং উল্টোটা হয়েছে। গণহত্যার মতো বিষয়টি মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পরও নির্লজ্জভাবে তারা এই সংকটে মিয়ানমারের পক্ষে আছে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এমনকি মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানও গণহত্যার নিন্দা জানায়নি। পাকিস্তানের সঙ্গে মিয়ানমারের সামরিক চুক্তিও আছে একাধিক। সবেচেয়ে বড় বিষয় হলো, মিয়ানমার বিশ্বাস করে, চীন তাকে কখনো ফেলে দেবে না। সুতরাং বাকি বিশ্ব তাকে চেপে ধরলেও কেবল চীন যদি তার পাশে থাকে, তাহলেই চলবে।
রাখাইনে এরই মধ্যে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেছে চীন। গ্যাসের পাইপলাইন পর্যন্ত নির্মাণ হয়ে গেছে। তাই সারা পৃথিবী ‘মানবতা মানবতা’ বলে চিৎকার দিলেও চীন বলবে- ‘ব্যবসা ব্যবসা’। এমনিতে চীনাদের ইতিহাসও বলে, তারা কখনোই মানবিক ইস্যুতে অগ্রগামী হয়নি, কথা বলেনি। একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এই আচরণ করেছে চীন। অতএব রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশ অন্তত চীনকে কোনোভাবেই পাশে পাবে না- এই বার্তা আরেকবার দিয়েছেন সু চি।
একইদিন জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেজ সাধারণ পরিষদের উদ্বোধনী ভাষণ দিয়েছেন। সেখানে তিনি মিয়ানমারের কড়া সমালোচনা করেছেন এবং তাদের সেনাবাহিনীকে অবিলম্বে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে অভিযান বন্ধ করতে বলেছেন। তিনি পরিষ্কারভাবে উচ্চারণ করেছেন ‘মাস্ট এন্ড’, অর্থাৎ অবশ্যই বন্ধ করতে হবে এবং এও বলেছেন, যত রোহিঙ্গা প্রাণভয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তাদের সবাইকে ফেরত নিতে হবে।
এই বক্তব্য বাংলাদেশের জন্য এবং রোহিঙ্গাদের জন্য বেশ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আমার বিশ্বাস। মনে রাখতে হবে তিনি জাতিসংঘ মহাসচিব। একবার যেহেতু তিনি এমন অবস্থান নিয়েছেন সহসা এই বিষয়ে মত পাল্টাবেন না। যদিও আমরা জানি, বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় সাধারণ পরিষদের খুব একটা কার্যকর ভূমিকা থাকে না। নিরাপত্তা পরিষদই মূখ্য ভূমিকা নেয়। তথাপি সাধারণ পরিষদ যদি কোনো প্রস্তাব পাস করে তার একটা মূল্য আছে। মহাসচিবের এমন বক্তব্যের পর বাংলাদেশ এখন আশা করতেই পারে, এবারের অধিবেশনে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রস্তাব পাস হবে। আরেকটি বিষয় হলো, সু চির ভাষণের কোনো প্রভাব জাতিসংঘ মহাসচিবের ওপর পড়েনি।
এদিকে মঙ্গলবার গোটা বিশ্বকে অনেকটা চমকে দিয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম রয়টার্সকে তিনি বলেছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের খুব একটা কিছু চাওয়ার নেই। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ট্রাম্প শরণার্থী ইস্যুতে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমেরিকা কোনো শরণার্থীকে জায়গা দেবে না। আর তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথাই বলতে চাননি। সুতরাং তাঁর কাছে আর কী চাওয়ার আছে?
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনে হলো, অন্তত বক্তব্যটা যেভাবে প্রচার হয়েছে তা থেকে, কোথাও যেন একটা গলদ হচ্ছে। আমরা কি রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমেরিকার আর কোনো ভূমিকাই প্রত্যাশা করি না? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিন্তু সবসময় প্রেসিডেন্টই সবকিছু নয়। সেখানকার কংগ্রেস ও সিনেট অনেক ভূমিকা রাখে বিশ্ব ব্যবস্থায়। চাইলেই ট্রাম্প কংগ্রেস ও সিনেটের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারবেন না। রোহিঙ্গা সংকটে এর আগে সে দেশের স্টেট ডিপার্টমেন্ট বিবৃতি দিয়েছে। তারা মিয়ানমারের সমালোচনাও করেছে। সু চিকে বিষয়টা দেখতে বলেছে। তাহলে আমরা কেন এখনই প্রচার করছি যে আমেরিকাকে আমাদের দরকার নেই? সামনের দিনগুলোতে তাদের তো প্রয়োজন হতেও পারে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যটা আমিও শুনেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে তাঁর সাক্ষাৎকারে আবেগের প্রতিফলন আছে। হতে পারে তিনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে ব্যক্তিগতভাবে বেশ চিন্তিত। এর সমাধানে তিনি বেশ মরিয়া। হতে পারে ট্রাম্পের সঙ্গে আলাপের সময় তিনি রোহিঙ্গা বিষয়টি ওঠানোর পরও ট্রাম্প এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি বলে তাঁর খারাপ লেগেছে।
আবার ট্রাম্প তাঁর বক্তব্যে উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপের হুংকার দিলেও পৃথিবীর এক কোণে যে মানবতার চরম লঙ্ঘন হচ্ছে সে বিষয়ে কোনো কথাই বলেননি। সব ঠিক আছে। কিন্তু এখানেই কি সব শেষ? পথ তো আরো অনেক খোলা আছে। একটা দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের চেষ্টা তো নেওয়াই যায়। কূটনৈতিক পর্যায়ে অনেকভাবেই আলোচনা জিইয়ে রাখা যায়। তার আগেই রয়টার্সের মতো আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম যদি রিপোর্ট করে- বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ে কোনো ভূমিকা প্রত্যাশা করেন না, তা মার্কিনিদের ভুল বার্তা দেয় কি না সে আশঙ্কা রয়েই যায়।
বিশেষ করে আরেকটু ভেবে দেখা প্রয়োজন আছে এজন্য যে, বাস্তবিক অর্থে শেষ পর্যন্ত রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বাংলাদেশকে কোনো না কোনো বৃহৎ শক্তির সমর্থন নিতেই হবে; সাহায্য লাগবেই। সেই বৃহৎ শক্তিটা কে হবে? রাশিয়া? আমার মনে হয় না। তবে আমি জানি না, বাংলাদেশের কূটনীতিকরা সেই রকম কোনো ইঙ্গিত পেয়েছেন কি না, যেখান থেকে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার প্রভাবিত হয়ে থাকতে পারে। কিংবা ভারতের তরফে কোনোকিছু ভরসা দেওয়া হয়েছে কি না। তাও কূটনীতিকরাই জানবেন।
তবে খোলা চোখে অতীতের আন্তর্জাতিক কিছু সংকটের দিকে তাকালে এখানে আমেরিকার অংশগ্রহণটাই বেশি করে প্রত্যাশিত হতে পারে। গত শতাব্দীর শেষ দশকে বসনিয়া সংকটের সময় এমনকি নিরাপত্তা পরিষদকে পাশ কাটিয়েও যুগোশ্লাভিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে মার্কিনিরা। যেখানে রাশিয়া শতভাগ সার্বদের পক্ষে ছিল। মার্কিন ওই অভিযানের ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যুগোস্লাভ সেনাবহিনীকে পর্যুদস্ত করা হয় এবং কসভো নামে স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। এখন বলকান অঞ্চলে সবচেয়ে বিশ্বস্ত মার্কিন মিত্র হলো কসভো।
সেখানে তাদের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্বার্থ যেমন কাজ করেছে তেমনি মানবতাও কাজ করেছে। স্লোবেদান মিলেশোভিচকে বলকান অঞ্চলে গণহত্যার দায়ে বিচারের মুখোমুখিও করেছে মূলত মার্কিনিরাই। সুতরাং মানবতা আর স্বার্থের মিশেলে আরাকানেও মার্কিনিদের যুক্ত হওয়া বা করানোর একটা সম্ভাবনা থাকেই। মার্কিন জনগণ এবং কংগ্রেস ও সিনেটকে প্রভাবিত করতে পারলে মানবতা রক্ষায় তারা এগিয়ে আসতেও পারে। স্বার্থ তো আছেই।
আর এই মিয়ানমার দিনে দিনে এমন সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হয়ে উঠছে যে প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশকে সবসময় তটস্থ থাকতে হচ্ছে। সামনে আরো হবে। এত দিন তো সীমান্তে কেবল রোহিঙ্গারা ছিল। এরা বাংলাদেশের সঙ্গে অতীত সম্পর্কের কারণে সীমান্তের ওপারে নিরাপদ জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত। মিয়ানমারের মূল জনগোষ্ঠী এবং শাসকগোষ্ঠীর লোকদের মাঝে এরা আমাদের সঙ্গে একটা বাফার অঞ্চল হিসেবে কাজ করেছে। এখন যদি রোহিঙ্গারা পুরোপুরি উচ্ছেদ হয় তাহলে সীমান্তের ওপারেই ভয়ংকর, দুর্বৃত্ত টাইপের একটা জনগোষ্ঠীর অবস্থান থাকবে। যা বাংলাদেশের জন্য মোটেই ভালো হবে না।
শুরুতেই বলেছি, সু চির বক্তব্যে পরিষ্কার হয়েছে- সামরিক বা রাজনৈতিক কঠোর কোনো পদক্ষেপ ছাড়া চীনের ছায়াতলে লালিত দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র মিয়ানমারকে কোনোভাবেই গণহত্যা বা মানবতাবিরোধী অপরাধ থেকে রোখা যাবে না। পালিয়ে আসা শরণার্থীদেরও নরম কথায় ফেরত নেবে না মিয়ানমারের সামরিক জান্তা। তারা কালক্ষেপণ করবে এবং রাখাইনে রোহিঙ্গা তাড়িয়ে খালি করা জায়গায় তাদের মিত্রদের যে অর্থনৈতিক স্বার্থ আছে তা হাসিলের চেষ্টা করবে। তাই এবারের রোহিঙ্গা সংকট যে দীর্ঘস্থায়ী হতে যাচ্ছে এ বিষয়ে সন্দেহ থাকারও কোনো সুযোগ নেই।
এ সংকট কতটা দীর্ঘ হবে তা হয়তো সময় বলে দেবে। তবে অন্তত কয়েক বছর যে ১০ লাখের ওপর রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করবে তা মোটামুটি নিশ্চিত। সুতরাং কূটনীতির মাঠে এবং ব্যবস্থাপনার কাজে সংকটের ভবিষ্যৎ মাথায় রাখতে হবে। এ জটিল পরিস্থিতিতে সাবেক এবং বর্তমান কূটনীতিকদের পরামর্শ নিতে হবে। পা ফেলতে হবে খুব সাবধানে। আবেগ বা ব্যক্তিগত ইগো নয়, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা মাথায় রেখে চাল দিতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক, আরটিভি