অভিমত
প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতি কি বদলাবে?
বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে আমাদের শেখানো হয়েছে এবং বিশ্বাস করানো হয়েছে যে বাংলাদেশের সম্ভাব্য শত্রুর নাম ভারত। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবিস্মরণীয় সহযোগিতা এবং এক কোটি শরণার্থীকে ভারত আশ্রয় দেওয়ার পরও বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই এখানে রাজনৈতিক স্বার্থে ভারত বিরোধিতা শুরু হয় এবং এ কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে ওঠে। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে এসে আমরা আবিষ্কার করছি––ভারত নয়, বাংলাদেশের সম্ভাব্য এবং অধিকতর সম্ভাব্য শত্রুর নাম আসলে মিয়ানমার।
আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের এটি একটি বিরাট বিজয়। কেননা, এখন সারা বিশ্বই ব্লু ইকোনমি বা সমুদ্র অর্থনীতির দিকেই বেশি নজর দিচ্ছে। এর কারণ দুটি। এক, সমুদ্রের তলদেশে বিপুল সম্পদ থাকার সম্ভাবনা এবং দুই, আঞ্চলিক নিরাপত্তা। এই নিরাপত্তার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ এরই মধ্যে চীনের কাছ থেকে দুটি সাবমেরিন কিনেছে, যে চীনকে এখন বাংলাদেশের সম্ভাব্য শত্রু মিয়ানমারের সবচেয়ে কাছের বন্ধু হিসেবে ভাবা হচ্ছে। মনে রাখা দরকার, চীনের কাছ থেকে এই সাবমেরিন কেনায় বাংলাদেশের প্রথম বন্ধু বলে পরিচিত ভারত নাখোশ হয়েছিল। আবার প্রতিরক্ষা কৌশলের অংশ হিসেবে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কাছ থেকে ভারী যুদ্ধাস্ত্র কেনা উচিতও নয়। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বা পররাষ্ট্রনীতি ও কৌশল ভবিষ্যতে কেমন হবে বা বিদ্যমান নীতি বদলাতে হবে কি না, তা নিয়ে হয়তো চিন্তাভাবনা এরই মধ্যে শুরু হয়েছে।
তবে এটা ঠিক, রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের কূটনীতি বা পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষানীতির জন্য একটা বড় পরীক্ষা। বিশেষ করে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার যখন একের পর এক বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে যুদ্ধের উসকানি দেয়, তখন ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’––এই পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশের অটল থাকা কঠিন। যদিও সরকারের তরফে এটা স্পষ্টই বলা হয়েছে যে, মিয়ানমারের এই উসকানিতে বাংলাদেশ সাড়া দেবে না। কারণ, অসৎ প্রতিবেশী সব সময়ই পায়ে পড়ে ঝগড়া বাধাতে চায়। সৎ প্রতিবেশী তখন ধৈর্য ধরে; বাংলাদেশ এখন যা করছে।
মিয়ানমার কতটা অসৎ প্রতিবেশী এবং তারা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য কতটা হুমকি, তা রোহিঙ্গা ইস্যুতেই স্পষ্ট। ২৪ আগস্ট গাজীপুরের টঙ্গীতে এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে মিয়ানমার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।’ তিনি বলেন, চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী এ দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে দোলা দিয়েছে।
অস্বীকার করার উপায় নেই, নতুন-পুরোনো মিলিয়ে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গার বোঝা বইতে গিয়ে বাংলাদেশ যে নানাবিধ সামাজিক, অর্থনৈতিক, এমনকি নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকিও নিচ্ছে, তা এখন সারা বিশ্বই স্বীকার করতে বাধ্য। কিন্তু রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যে প্রস্তাব রেখেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ছাড়া সেগুলো বাস্তবায়ন অসম্ভব। কেননা, খোদ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, এ ইস্যুতে মিয়ানমারের আন্তরিকতার যথেষ্ট ঘাটতি আছে এবং বাংলাদেশের ডাকে তাদের সাড়া দেওয়ার হার খুবই হতাশাজনক। সুতরাং বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্যের ওপরই পুরো বিষয়টি নির্ভর করছে। তা ছাড়া জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে গুরুত্বপূর্ণ অনেক দেশের নেতা রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কথা বলেননি, যা আসলে মিয়ানমারের পক্ষেই গেছে। যদিও আশার সংবাদ হলো, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ সাত দেশ।
এটা ঠিক যে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে সারা বিশ্ব বাংলাদেশের পাশে আছে তার উদারতা আর মানবিকতার কারণেই। পুরো বিশ্ব দেখছে, কীভাবে একটি রেসিস্ট ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র থেকে বিতাড়নের শিকার হওয়া লাখ লাখ মানুষকে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ নিজেই জনসংখ্যার চাপে ন্যুব্জ এবং বিবিধ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করছে। কিন্তু তারপরও মানবিকতার প্রশ্নে বাংলাদেশ যে পরীক্ষা দিয়েছে, তাতে নিঃসন্দেহে তার বিজয় হয়েছে এবং ভবিষ্যতে, বিশেষ করে মিয়ানমারে ২০২০ সালের নির্বাচনে যদি আবার কোনো সামরিক কর্মকর্তা প্রেসিডেন্ট হন এবং তখন যদি রোহিঙ্গা ইস্যুতে আরো বড় কোনো সংকট বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক চূড়ান্ত খারাপ হয়ে যায়, তখন সারা বিশ্ব বিবেককে বাংলাদেশ তার পাশে পাবে বলে আশা করা যায়।
২০২০ সালের জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের সমর্থন নিয়ে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রধান মিন অং যে ক্ষমতায় যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন, তা এরই মধ্যে স্পষ্ট। আবার কথিত ‘আরসা’ নামে যে সংগঠন নির্মূলের নামে গত আগস্ট থেকে রাখাইনে তাণ্ডব চালাচ্ছে মিয়ানমারের সেনারা, সেই আরসা আসলে রোহিঙ্গাদের উৎখাতে তাদের নিজেদের সৃষ্টি কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। কেননা, আইএসকে মদদ দিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব কীভাবে ইরাক ও সিরিয়া ধ্বংস করে দিয়েছে, সেই উদাহরণ আমাদের সামনেই আছে। সুতরাং ভবিষ্যতে রোহিঙ্গাদের পুরোপুরি নির্মূলের কৌশল হিসেবে বাংলাদেশে আরসা তৎপর—এমন অভিযোগও মিয়ানমার আনতে পারে। তখন সেই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষানীতি কী হবে?
২০১১ সালের ৪ জুন রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এশিয়া প্যাসিফিক শান্তি সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, অন্যায়-অবিচার ও বঞ্চনার শিকার অভিবাসী, শরণার্থী, স্থানচ্যুত, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাহায্যে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সন্ত্রাস, সহিংসতা ও আগ্রাসনের পথ পরিহার করতে হবে। জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
তবে সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের যে শান্তিপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশ তার জন্মলগ্ন থেকে লালন করে আসছে, সারা বিশ্বে বাংলাদেশ একটি শান্তিপূর্ণ ও শান্তিপ্রিয় রাষ্ট্র হিসেবে নিজের যে পরিচয় প্রতিষ্ঠিত করেছে, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ সম্বন্ধে বিশ্ববাসীর অনেক ভুল ধারণা ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু তারপরও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে যে শিগগিরই বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নত হচ্ছে না এবং রোহিঙ্গাদের বোঝা যে বাংলাদেশকে আরো বহু বছর বইতে হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ কম। সুতরাং মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা নীতি কী হবে––তা নিয়ে চিন্তাভাবনার সময় এসেছে। সম্প্রতি সীমান্তে মিয়ানমার নতুন করে যে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে এবং তাতে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়েছে, সেটি নেতুন করে কিছু সংশয় ও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক ও লেখক।