আন্তজার্তিক
কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা এবং 'প্যানডোরার বাক্স’
স্পেনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল কাতালোনিয়ায় স্বাধীনতার প্রয়াস স্পেন রাজতন্ত্রের সংহতির প্রশ্নে এক বড় ধরনের সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করেছে। স্বাধীনতাকামী দেশটির নব্বই শতাংশ স্পেন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে সমর্থন জানিয়েছে। স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার এ গণভোটকে অবৈধ ঘোষণা করে এর ফলাফল মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। স্পেনের রাজা ষষ্ঠ ফিলিপ পরিস্থিতিকে ’অত্যন্ত গুরুতর’ বলে আখ্যা দিয়ে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন।
জাতির উদ্দেশে দেওয়া টেলিভিশন ভাষণে রাজা বলেন, কাতালান নেতারা গণভোটের আয়োজনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রতি তাদের অশ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। তাঁরা আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ভেঙ্গেছেন। তা সত্ত্বেও কঠিন সময় থেকে স্পেন উতরে যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাহই গৃহীত গণভোটকে 'গণতন্ত্রের পরিহাস’ বলে মন্তব্য করেছেন। এদিকে কাতালোনিয়াজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে কেন্দ্রীয় সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীকে সরিয়ে নেওয়ার দাবি তোলা হয়। কাতালোনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনার সড়কে প্রায় সাত লাখ মানুষ সমবেত হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকমহল মনে করেন ’বাধা দিলে বাধবে লড়াই’। এ লড়াই স্পেনে গৃহযুদ্ধের সূচনা করতে পারে।
ভৌগোলিক পরিচয় : কাতালোনিয়া অঞ্চলটি তুলনামূলকভাবে অপরিচিত ছিল। সাম্প্রতিক কালে স্বাধীনতার দাবি তুলে অঞ্চলটি আন্তর্জাতিক আলোচনায় স্থান পেয়েছে। ভৌগোলিকভাবে এটি স্পেন ও পর্তুগাল নিয়ে গঠিত আইবেরীয় উপদ্বীপে অবস্থিত। এ উপদ্বীপটির অরবীয় নাম আন্দালুসিয়া। স্পেনের পূর্ব প্রান্তে ভূমধ্যসাগর ঘিরে এর অবস্থান। অঞ্চলটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এর রাজধানী বার্সেলোনা স্পেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। ইউরোপে এর স্থান সপ্তম। ইতিহাসের অনেক বাঁক অতিক্রম করে অবশেষে কাতালোনিয়া স্পেন সাম্ররাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এর উত্তর সীমান্তে ফ্রান্স এবং অ্যান্ডোরা, পূর্বে অবারিত ভূমধ্যসাগর, দক্ষিণ-পশ্চিমে স্পেন। সরকারি ভাষা কাতালান এবং স্প্যানিশ।
ইতিহাস : অষ্টম শতাব্দীতে ফ্রাংকিশ রাজবংশ অঞ্চলটিকে সংঘঠিত করেন। পিরিনিজ পর্বতের পূর্ব পাদদেশে তখনকার অগ্রসরমান মুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে এ অঞ্চলকে প্রতিবন্ধক হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস নেওয়া হয়। ১১৩৭ সালে কাতালোনিয়া আরাগন রাজবংশের অধীনে সম্প্রসারণশীল হয়ে ওঠে। ভূমধ্যসাগরে তাদের নৌশক্তি বৃদ্ধি পায়। ফ্রান্স-স্পেন যুদ্ধের সময়ে (১৬৩৫-১৬৫৯) কাতালোনিয়া ফরাসি সমর্থনে নিজেদেরকে প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করে। পরবর্তী সময়ে ফ্রান্সই ১৬৫৯ সালে সম্পূর্ণ কাতালোনিয়া দখল করে নেয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কাতালোনিয়া নেপোলিয়নীয় যুদ্ধ দ্বারা বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে একটি বাস্তব শিল্পায়ন সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক অঞ্চল হিসেবে এটি আত্মপ্রকাশ করে। দ্বিতীয় স্পেনীয় প্রজাতান্ত্রিক সময়ে (১৯৩১-১৯৩৯) কাতালোনিয়া স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্পেন রাজতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত হয়। পরবর্তীকালে স্পেনের স্বৈরশাসক ফ্রাংকোর আমলে কাতালোনিয়া জাতিগত বৈরিতার সম্মুক্ষীন হয়। অঞ্চলটির খনিজ সম্পদ, আঞ্চলিক বৈচিত্র্য এবং সমুদ্র সমীপতার কারণে ১৯৫০-১৯৭০ সময়ে এটি দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। ১৯৭৫-১৯৮২ সালে স্পেনের গণতন্ত্রে উত্তরণ সময়কালে কাতালোনিয়ায় শিক্ষা, পরিবেশ, সংস্কৃতি সর্বোপরি রাজনৈতিক পর্যায়ে যথেষ্ট স্বকীয়তা তথা স্বায়ত্তশাসন অর্জন করে। এভাবে এটি স্পেনের সবচেয়ে সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অঞ্চলে পরিণত হয়। ১৯৯২ সালে বার্সেলোনায় গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কাতালোনিয়ার সমৃদ্ধি অনুমান করা যায়। ২০০৬ সালে কাতালোনিয়া একটি গণভোটের মাধ্যমে আরো সম্মান, স্বাতন্ত্র্য ও স্বায়ত্তশাসন অর্জন করে। স্পেনীয় সমাজের রক্ষণশীল অংশ এর বিরোধিতা করে। ফলে ২০১০ সালে স্পেনীয় আদালত অর্জিত স্বায়ত্তশাসনের অধিকাংশই খর্ব করে। পূর্বেকার ঘোষণায় কাতালোনিয়ার পৃথক জাতিসত্তার স্বীকৃতি ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের এ ধরনের আচরনে কাতালোনীয় জনগোষ্ঠী অধিকতর ক্ষুদ্ধ হয়।এতে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার দাবি যৌক্তিকতা অর্জন করে।
স্বাধীনতার আন্দোলন : ২০১৪ সালে গৃহীত এক গণভোটে দেখা যায় কাতালোনিয়ার শতকরা ৯২ ভাগ মানুষ একটি স্বতন্ত্র, স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষে।৭৫ লক্ষ জনঅধ্যূষিত এ অঞ্চলের ৮০ ভাগ মানুষ ওই গণভোটে অংশগ্রহণ করে। ২০১৫ সালের ৯ নভেম্বর কাতালোনিয়ার প্রাদেশিক পরিষদ স্পেন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ৭২-৬৩ ভোটে এ পরিকল্পনা গৃহীত হয়। ভোটাভুটি থেকে বোঝা যায় যে স্পেনের পক্ষেও বেশ ভালো জনমত রয়েছে। স্পেনের সাংবিধানিক আদালত এ পরিকল্পনা স্থগিত করে। কিন্তু কাতালোনিও নেতৃত্ব বলছে এতদসত্ত্বেও তারা পরিকল্পনামাফিক অগ্রসর হবেন। ২০১৭ সালের ৯ জুন তাঁরা ঘোষণা করে যে স্বাধীনতার পক্ষে চূড়ান্ত গণভোট অনুষ্ঠিত হবে এ বছরের ১ অক্টোবর। স্পেনের সাংবিধানিক আদালত পরিকল্পিত গণভোটকে বেআইনি ঘোষণা করে। কাতালোনিয়ার কেন্দ্রীয় সরকার সমর্থিত আইনি কর্তৃপক্ষ গণভোট সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম ও ভোট সরঞ্জামাদি বাতিল করার চেষ্টা করে। গত ২০ সেপ্টেম্বর ঘোষিত গণভোটের ১১ দিন আগে কেন্দ্রীয় সরকারের সিভিল গার্ড বাহিনী গণভোটের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রাদেশিক কর্মকর্তাদের আটক করে। এমনকি প্রাদেশিক মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদেরও গ্রেপ্তার করা হয়।
স্বাধীনতার দিনলিপি : ক. নভেম্বর, ২০১৪ : স্বাধীনতার প্রশ্নে প্রতীকী ভোট। খ. সেপ্টেম্বর, ২০১৫ : আঞ্চলিক নির্বাচনে স্বাধীনতাকামীদের জয়লাভ। গ. নভেম্বর, ২০১৫ : কাতালোনিয়া প্রাদেশিক পরিষদে গণভোটের প্রক্রিয়া শুরুর প্রস্তাব ও স্পেনের সাংবিধানিক আদালত কর্তৃক তা বাতিল। ঘ. জানুয়ারি , ২০১৬ : দীর্ঘদিনের স্বাধীনতাকামী নেতা কার্লোস পুজেমন কাতালোনিয়ার আঞ্চলিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ঙ. ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ : আঞ্চলিক পার্লামেন্ট কর্তৃক গণভোটের আহ্বান। চ. ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ : স্পেনের সাংবিধানিক আদালত কর্তৃক গণভোটের আদেশ স্থগিতকরন।ছ. ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭: গণভোটের পক্ষে প্রচারনা শুরু ও মাদ্রিদের সঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধি। জ. ১ অক্টোবর, ২০১৭: স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোটের দিন নির্ধারিত।
১ অক্টোবরের গণভোট : কেন্দ্রীয় সরকারের বিধি নিষেধ এবং গ্রেপ্তারী সত্ত্বেও কাতালোনীয় গণভোট গ্রহনে বদ্ধপরিকর থাকে। কাতালোনিয়ার নাগরিকদের গণভোটে প্রশ্ন করা হয় যে, ’আপনি কি প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বাধীন রাষ্ট্র কাতালোনিয়ার আত্মপ্রকাশকে সমর্থণ করেন? প্রকাশিত পরিসংখ্যান মোতাবেক ২ লাখ ২০ হাজার ভোটার স্বাধীনতার পক্ষে এবং এক লক্ষ ৭৭ হাজার বিপক্ষে ভোট প্রদান করে। কাতালোনিয়া কর্তৃপক্ষ বলছে যে, আরো সাত লাখ ৭০ হাজার ভোট কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে বাতিল হয়ে গেছে। স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি দাবি করছেন যে তারা গৃহীত ভোটের ৯১.৯৬ শতাংশ ভোট লাভ করেছেন। অপরদিকে স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি বলছেন ভোটে অনিয়ম এবং জালিয়াতি হয়েছে। ভোটের আগে ও পরে বার্সেলোনাসহ বিভিন্ন এলাকায় স্বাধীনতার স্বপক্ষে বড় বড় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে লাখ লাখ লোক অংশগ্রহণ করে। কাতালান নেতা কার্লোস পুজেমন বলেছেন, স্পেন থেকে স্বাধীনতা পেতে গণভোটের আয়োজন করায় তাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। এতে তিনি ভয় পান না বলেও জানান।গণভোট চলাকালে কেন্দ্রীয় পুলিশের বাধাদানে প্রায় ৯ শত লোক আহত হয়। এ সময়ে ৩৩ জন পুলিশ সদস্য আহত হন বলে বার্তা সংস্থার খবরে বলা হয়।
সমঝোতা প্রস্তাব : স্বাধীনতার দাবি থেকে যাতে কাতালোনিয়া ফিরে আসে সেজন্য কেন্দ্রীয় সরকার সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে। এজন্য কাতালোনিয়ার কর কমানো এবং সাংবিধানিক সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তবে সেই সাথে একথা ও বলে দেয়া হয়েছে যে সবকিছুই হতে হবে আইনের পথে। উল্লেখ্য যে, স্পেনের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে কাতালোনিয়া অধিকতর সম্পদশালী। মোট জনসংখ্যার ১৬ ভাগ এখানেই বাস করে। জিডিপির ১৯ শতাংশ আর রপ্তানির এক-চতুর্থাংশ তাদের। পর্যটন প্রশ্নেও কাতালোনিয়ার পাল্লা ভারী। সুতরাং স্পেনের জাতীয় স্বার্থে যেকোনো ভাবে তারা সমঝোতায় আসতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক।
ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া : গণভোট প্রসঙ্গে ইউরোপীয় কমিশনের বিবৃতিতে বলা হয়, ’কাতালোনিয়ায় যা হচ্ছে তা স্পেনের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’।এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন কাতালান নেতা কার্লোস। এদিকে ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান মন্তব্য করেছে যে, সম্প্রতি কাতালোনিয়ার গণভোট ঠেকাতে স্পেন কর্তৃপক্ষের শক্তিপ্রদর্শন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি দেশটির প্রতিশ্রুতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ৪২ বছর আগেই দেশটির স্বৈরশাসক ফ্রান্সিসকো ফ্রাংকোর মৃত্যুর পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এগোচ্ছিল স্পেন। সেটির উপর আঘাত এলো এ ঘটনায়। পত্রিকাটি সতর্ক করে দেয় যে, এই গণভোটের প্রভাব স্পেনেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। এর ঢেউ আছঁড়ে পড়তে পারে স্পেনের বাইরেও।
মূল্যায়ন : সামপ্রতিক সময়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা উন্নত এবং অনুন্নত দেশগুলোর জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি ইন্দোনেশিয়া থেকে ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। বিশেষত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন তথা স্নায়ু যুদ্ধের অবসানে জাতি-রাষ্ট্রসমূহে ভাঙ্গনের সুর বেজে উঠে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে ১৫টি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। যুগোস্লাভিয়া খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে অবশেষে সাতটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়। এমনকি অপেক্ষাকৃত ছোট চেকোস্লোভাকিয়া এক থাকতে পারেনি। চেক এবং স্লোভাকিয়া নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ধারণ করা গিয়েছিল যে, এ ভাঙন সাবেক সমাজতান্ত্রিক বলয়ে সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু স্কটল্যান্ড যখন ব্রিটেন থেকে বেরিয়ে যেতে চায়, ক্যালিফোর্নিয়া যখন বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা বলে তখন বিস্মিত হতে হয় বৈকি।কানাডা থেকে কুইবেকের বিচ্ছিন্নতার প্রয়াস আর একটি উদাহরণ। তবে উন্নত বিশে^ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন একেবারে নতুন কিছু নয়। দীর্ঘকাল ধরে উত্তর আয়ারল্যান্ডে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি-আই আর এ ব্রিটেন থেকে স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। খোদ স্পেনে যেখানে এখন কাতালোনিয়ার জনগণ স্বাধীনতার দাবিতে সংগ্রাম করছে, সেখানে বাস্ক গেরিলারা দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় ছিল। এই সেদিন ২০১০ সালে অস্ত্র বিরতিতে যায় তারা। কাতালোনিয়ার মতো ইউরোপের আরো কয়েকটি স্থান রয়েছে যারাও স্বাধীনতা চায়। ইতালির উত্তরাঞ্চলে নর্দান লিগ বিচ্ছিন্নতার দাবিতে উচ্চকিত হচ্ছে।জার্মানির দক্ষিণাঞ্চলের রক্ষণশীল বাভারিয়ান জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার প্রবণতা রয়েছে। এসব প্রবণতার সাথে কাতালোনিয়ার একটি মিল রয়েছে। ইউরোপের ওইসব অঞ্চলে স্বাধীনতার দাবি ছড়িয়ে পড়তে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের প্রস্থান সেটিও এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা। তাই সংগতভাবেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করতে চায় না। এ ধরনের প্রবণতা নিঃসন্দেহে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঐক্যের চেতনাকে বাধাগ্রস্ত করবে।
আর তৃতীয় বিশ্বের অবস্থা খুবই নাজুক। ইন্দোনেশিয়ার বুক চিড়ে বেরিয়ে গেছে পূর্ব তিমুর। বৃহৎ সুদানকে হারাতে হয়েছে তার দক্ষিণ অঞ্চল। কাশ্মীরসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন প্রবল রয়েছে। বেলুচিস্তান পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হতে চায়। এভাবে ফিলিপাইনের মিন্দানাও, থাইল্যান্ডের পাত্তানি এবং মিয়ানমারের আরাকানসহ অন্যত্র জাতিগত বিরোধ ও বিচ্ছিন্নতা চরম পর্যায়ে রয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের হাজার মাইল বিচ্ছিন্ন পূর্বাঞ্চল বাংলাদেশ নামে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।১৯৬৯ সালে নাইজেরিয়ার বায়াফ্রা প্রদেশ বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেষ্টা করে। শ্রীলংকার উত্তরাঞ্চলে তামিল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ ব্যর্থ হয়। দেখা যাচ্ছে ভূমি সংলগ্নতা আছে এ রকম ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতা সম্ভব নয়। সুতরাং প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্যে এধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সফল হওয়া বেশ কঠিন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইমারসন নতুন স্বাধীন জাতিসমূহকে অভিহিত করেছেন, ’ নেশনস ইন হোপ’ বা আশান্বিত জাতি বলে। রাষ্ট্র গঠনে তৃতীয় বিশ্বের ব্যর্থতা বোঝা সহজ। কিন্তু উন্নত বিশ্বে কাতালোনিয়ার মতো বিচ্ছিন্নতাবাদ বোঝা কঠিন। বস্তুত গোটা পৃথিবীতে বিশ্বায়ন তরঙ্গের বিপরীতে আর একটি নেতিবাচক প্রবণতা যে সক্রিয় রয়েছে তা কাতালোনিয়া থেকেই বোঝা যায়। এই বিচ্ছিন্নতাবাদ এখন শাখের করাত। যদি কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাকে স্বীকার করা না হয়, সেখানে গৃহযুদ্ধের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। অপরদিকে এ ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদকে যদি উৎসাহিত করা হয় তাহলে উন্নত কিংবা অনুন্নত-সকল জাতির জন্য ’প্যানডোরার বাক্স’ খুলে দেওয়া হবে। তাই রাজনৈতিক নের্তৃত্বকে কনফেডারেশন ধরনের সমঝোতায় পৌঁছে ’জাতীয় রাষ্ট্র’ কে রক্ষা করতে হবে।এটাই বোধ হয় কুশলী রাজনীতিবিদদের জন্য উৎকৃষ্ট উপায়।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়