ডিপ্লোম্যাটিক ক্যামোফ্লাজ
‘ভালো অর্থ বহন করা কথাবার্তা ও কূটনৈতিক শব্দ ব্যবহারের সময় শেষ হয়ে গেছে। আমাদের এখন মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর হামলা চালানো নিরাপত্তাকর্মীদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে হবে।’ গত ২৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের দূত নিকি হেলির এ বক্তব্য এতটাই আশাব্যঞ্জক যে মনে হচ্ছে, তিনি বাংলাদেশেরই প্রতিনিধি অথবা তিনি যেন বাংলাদেশের লিখে দেওয়া বক্তব্যই পাঠ করেছেন। অর্থাৎ আমাদের মনের কথাই তিনি বলেছেন। কিন্তু একজন সাবেক কূটনীতিক আমাকে একবার বলেছিলেন, Don’t believe the diplomat’s word, but see what they do, অর্থাৎ ‘কূটনীতিকরা কী বলে, তা বিশ্বাস করো না; বরং দেখো তারা কী করে।’
১ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ৬৮তম জাতীয় দিবস উপলক্ষে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত মা মিং চিয়াংয়ের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে প্রথম আলো, যেখানে চিয়াং চীন ও বাংলাদেশের মধ্যকার বর্তমান সম্পর্ক নিয়ে খুবই সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘চীন যেমন প্রমাণ করেছে তারা বাংলাদেশের ভালো বন্ধু, বাংলাদেশও একইভাবে প্রমাণ করেছে যে তারা চীনের ভালো বন্ধু। দুই দেশের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক বিদ্যমান।’
আমরা স্মরণ করতে পরি, গত বছরের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় জলবায়ু পরিবর্তন, নিরাপত্তা, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ক্ষেত্রে সহযোগিতাসহ ২০টির বেশি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সরকারি ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে প্রায় চার হাজার কোটি ডলারের প্রাথমিক বিনিয়োগ চুক্তি হয়। রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘চীন বাংলাদেশে আরো বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন চীন বাংলাদেশের এক নম্বর বিনিয়োগকারী দেশে পরিণত হবে।’ রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি বলেন, ‘চীন কখনো বাংলাদেশের সঙ্গে বড় ভাইসুলভ আচরণ করে না। বাংলাদেশ এখন যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সে ব্যাপারেও আমরা বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল।’ আর সবার মতো চিয়াংও মনে করেন, রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসা উচিত।
প্রশ্ন হলো, চীন কি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বাইরে? বরং এই ইস্যুতে চীন যদি বাংলাদেশ বা মিয়ানমার কোনোপক্ষে না থেকে অন্তত নিরপেক্ষ থাকত, সেটিও পরিস্থিতি উত্তরণে সহায়ক হতো। কিন্তু জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের আলোচনায় জাতিসংঘে চীনের উপরাষ্ট্রদূত য়ু হাইতাও বলেন, মিয়ানমার সরকার যে জটিল চ্যালেঞ্জের মুখে আছে, তা নিরপেক্ষ দৃষ্টি ও ধৈর্য নিয়ে বিবেচনা করা উচিত। তিনি বলেন, রাখাইনের উত্তেজনাকর পরিস্থিতি দীর্ঘসময় ধরে সৃষ্টি হয়েছে এবং চট করে এই সংকটের সমাধান হবে না। এ বক্তব্য স্পষ্টতই ‘ডিপ্লোম্যাটিক ক্যামোফ্লাজ’ বা কূটনীতিক ধোঁয়াশা, যা প্রকারান্তরে মিয়ানমারের পক্ষেই গেছে। অর্থাৎ মিয়ানমার যে রাখাইনে পরিকল্পিতভাবে জাতিগত নিধন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে, সেটির পক্ষেই বরং ওকালতি করলেন মি. হাইতাও।
ওই আলোচনায় রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভাসিলি নেবেনজিয়ার বক্তব্যও মিয়ানমারকে উৎসাহিত করবে। রাখাইনে জেনোসাইড বন্ধের কোনো আহ্বান না জানিয়ে তিনি বরং সবাইকে সতর্ক করে বলেন, মিয়ানমার সরকারের ওপর ‘অত্যধিক চাপ’ প্রয়োগ করলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মিয়ানমারের বর্বর গণহত্যাকে চীন ও রাশিয়ার সমর্থন করা দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেন। এমনকি এই ইস্যুতে চীনের অবস্থানকে তিনি ‘দ্বিচারিতা’ বলেও উল্লেখ করেন।
তবে এটা ঠিক যে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে উন্মুক্ত আলোচনায় জাতিসংঘ মহাসচিবসহ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ বেশির ভাগ দেশের প্রতিনিধি যেভাবে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন, সেটি বাংলাদেশের এক ধরনের বিজয়। কিন্তু চীন ও রাশিয়ার ক্যামোফ্লাজ রোহিঙ্গা সংকটের আশু সমাধানকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। অর্থাৎ রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধন আপাতত মুলতবি করা হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে যে দীর্ঘ সময় লাগবে, তা স্পষ্ট হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলিয়া বিশপ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, যদি রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আইএসের মতো জঙ্গিগোষ্ঠী মাথাচাড়া দিতে পারে। এই আশঙ্কা আরো অনেকেই করেছেন। কেননা, যে লোক চোখের সামনে তার বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-পরিজনকে নির্মমভাবে খুন হতে দেখেছে, ধর্ষিত হতে দেখেছে, তার ভেতরে যে একটা চরম প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধপরায়ণতা তৈরি হবে, সেটিই স্বাভাবিক। সুতরাং যেকোনো প্ররোচনায় সাড়া দেওয়ার জন্য তার মন এখন আকুপাকু করবে।
জাতিসংঘ মহাসচিবও নিরাপত্তা পরিষদের আলোচনায় বলেছেন, মানবাধিকার সংকট থেকেই ‘ব়্যাডিক্যালাইজেশন’-এর মতো বিষয়ের শুরু হয়। এ ছাড়া ভুক্তভোগীদের মধ্যে চোরাচালানসহ অন্যান্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
এই বাস্তবতা জেনেই ১ অক্টোবর কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে বলেছেন, বাংলাদেশে কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদীর জায়গা হবে না এবং রোহিঙ্গারা যাতে কোনো প্ররোচনায় বিভ্রান্ত না হয়, সেই অনুরোধ তিনি রেখেছেন।
কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে বিপন্ন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ একদিকে যেমন মানবিকতার উদাহরণ দেখিয়েছে, তেমনি কিছু বিপদও ডেকে এনেছে, যা সামাল দেওয়া খুব কঠিন। শুধু জঙ্গিবাদ বা চরমপন্থা নয়, এ পর্যন্ত একাধিক রোহিঙ্গার শরীরে এইচআইভি শনাক্ত হয়েছে। সুতরাং আরো কত লোক এ রকম মরণব্যাধি এইডসের জীবাণু বহন করছে, তা নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। আবার আক্রান্ত লোকের মাধ্যমে যদি আরো অনেকে আক্রান্ত হয় এবং সেটা যদি বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে ছড়ায়, সেটা জঙ্গিবাদের চেয়ে কম বিপদ নয়।
আবারও সেই সাবেক কূটনীতিকের কথায় ফিরি। অর্থাৎ কূটনীতিকরা কী বলেন, তা বিশ্বাস না করে বরং আমাদের দেখা উচিত তাঁরা কী করেন। বলা হচ্ছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ আসলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং মিয়ানমারের ভূ-কৌশলগত অবস্থানের দুষ্টচক্রে পড়ে গেছে। যে কারণে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের বন্ধুরাও যেন এই ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে ঠিক বন্ধুসুলভ আচরণ করতে পারছে না। অনেক সময়ই সরকারের তরফে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন একটি অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের ভূমিকা নিয়ে নানা মহলেই সমালোচনা হয়েছে।
যদিও ৬ অক্টোবর পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকের উদ্ধৃতি দিয়ে বিবিসির এক খবরে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের ভূমিকায় বাংলাদেশ খুশি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার চাইছে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রশ্নে ভারত সরকার আরো বলিষ্ঠ ভূমিকা নিক। কিন্তু এ বিষয়ে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ সুনির্দিষ্ট কোনো আশ্বাস পেয়েছে কি না, তা স্পষ্ট হয়নি বলে বিবিসির ওই খবরে বলা হয়েছে। অর্থাৎ একটা ক্যামোফ্লাজ রয়েই গেছে। চীনের রাষ্ট্রদূতও বললেন যে চীন বাংলাদেশের এক নম্বর বিনিয়োগকারী দেশে পরিণত হবে। কিন্তু তারপরও রোহিঙ্গা ইস্যুতে কেন এই ডিপ্লোম্যাটিক ক্যামোফ্লাজ? তাহলে কি বন্ধুত্ব কেবলই অর্থনৈতিক স্বার্থে?
বাণিজ্যিক স্বার্থে অনেকেই বন্ধু হবেন এটা যেমন ঠিক, তেমনি বাংলাদেশ বিপদে পড়লে সেই বন্ধুদের কতজন এগিয়ে আসেন, সেই অভিজ্ঞতটা আরো বেশি জরুরি ছিল––যা বোধ হয় রোহিঙ্গা ইস্যুতে কিছুটা অর্জিত হলো। কেননা, বিপদের সময়ই প্রকৃত বন্ধু চেনা যায়। আবার একবারের বন্ধু মানেই যে কেউ চিরকালের বন্ধু নয়, আবার একদার শত্রুও যে ভবিষ্যতে বন্ধু হবে না, তা হলফ করে বলা কঠিন। বরং আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে বন্ধুত্ব অনেক সময়ই শর্তসাপেক্ষ। অর্থাৎ নিঃশর্ত বন্ধুত্ব বলে কিছু নেই। তাই ভারত, চীন ও রাশিয়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে কী বলল, তার চেয়ে আমাদের দেখা উচিত তারা কাজটা কী করে...।
লেখক : সাংবাদিক।