রোহিঙ্গা সংকট
‘মাকে নিয়ে নো-ম্যানস ল্যান্ড পার হচ্ছি’
জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গার পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। গ্রাম থেকে শহরে কিংবা মসজিদ থেকে বিদ্যালয়ে। কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে থাকা বিপন্ন রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তার উদ্যোগ নিয়েছে দেশের সর্বস্তরের মানুষ। বিষয়টি বিশ্ব মিডিয়ার নজর এড়ায়নি। বাংলাদেশের এমন পদক্ষেপ প্রশংসিত হচ্ছে বিশ্বের সর্বত্র।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১০ লাখ শরণার্থীর মধ্যে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয়, খাদ্য, পানি, পয়োনিষ্কাশন এবং অন্যান্য জীবনরক্ষাকারী সামগ্রীর জন্য মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভর করছে। এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং ত্রাণ সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা নিশ্চিতে কিছুটা সাহায্য করে যাচ্ছে। তবে সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি বসে নেই বাংলাদেশের মানুষও। তারাও বিপন্ন মানবতার প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়েছে।
তাই তো বিশ্বজুড়েই চলছে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের মহানুভবতার বন্দনা। নিপীড়িত ও নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের সাহায্য করতে এ দেশের অনেক মানুষ ব্যক্তি উদ্যোগেও এগিয়ে আসছে। সাধারণ মানুষের পাশাপশি সরকারি কর্মকর্তারা নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। রোহিঙ্গাদের সেবায় নিজের আত্মনিয়োগ তাঁরা যেমন নিজেরা প্রশংসা কুড়াচ্ছেন, তেমনি বিশ্ববাসীর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন—এ দেশের মানুষ জানে কীভাবে নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয়। মানবতার সেবাই যে বড় ধর্ম, তার নজির স্থাপন করে চলছে এ দেশের মানুষ।
শুরুটা হয়েছিল গত ২৪ আগস্ট। ওই দিন দিবাগত রাতে মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংস ঘটনার পর সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে আসতে শুরু করে। কোনোরকম বাঁধা ছাড়াই বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দেয়। এ ছাড়া সীমান্ত পরিস্থিতি সামলানোর জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে নিয়ে আসা হয়। একইভাবে সিলেটে কর্মরত বিজিবির অতিরিক্ত পরিচালক মেজর আশিকুর রহিমকেও ডেপুটেশনে উখিয়ায় নিয়ে আসা হয়।
সেই ২৪ আগস্ট থেকেই রোহিঙ্গারা সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে শুরু করে। ঢল নামতে থাকে বাংলাদেশের উখিয়ার পালংখালী সীমান্তে। বিভিন্ন সংস্থার তথ্যমতে, ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্যে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের আঞ্জুমানপাড়া সীমান্তে সম্প্রতি আবারও রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। গত ১৪ থেকে ১৬ অক্টোবর ওই সীমান্ত দিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আঞ্জুমানপাড়াসহ বিভিন্ন সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ডে হাজার হাজার রোহিঙ্গা আটকা পড়েছিল।
মিয়ানমারের রাখাইনে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হেঁটে আসায় তাঁদের অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সীমান্তে নিয়োজিত বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম), ইউএনএইচসিআর, এমএসএফ, দেশি-বিদেশি এনজিওসহ দেশের বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা রোহিঙ্গাদের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসা এক বৃদ্ধ রোহিঙ্গা নারীকে কোলে করে সীমান্ত পার করিয়ে দেন বিজিবির মেজর মো. আশিকুর রহিম। তাঁর এই মানবিক দৃষ্টান্তের ছবি বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রশংসা কুড়িয়েছে।
বিজিবির মেজর মো. আশিকুর রহিম প্রথম যেদিন কাজ শুরু করেন, সেদিন অন্য সদস্যরাও ওখানে কাজ করছিল। সেখানে তিনি দেখতে পান, এক বৃদ্ধ নারী হাঁটতেও পারছে না। সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশের আশ্রয়শিবিরে আসার জন্য ওই বৃদ্ধাকে আরও বহু পথ পাড়ি দিয়ে হেঁটে যেতে হবে। ওই দিন ইউএনএইচসিআরের সঙ্গে তাদের একটি সমন্বয় হয়। অসুস্থ ও বয়স্ক লোক দেখলে তাঁদের পৃথক করে গাড়িতে ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হবে বলে সমঝোতা হয়। তখন মেজর মো. আশিকুর রহিম দেখলেন, এক বৃদ্ধ নারী বহুদূর থেকে হেঁটে আসছিলেন এবং কিছুদূরে গিয়ে মাটিতে পড়ে যান তিনি। তখন তাঁকে প্রথমে ইউএনএইচসিআরের একজন কর্মী কোলে করে নিয়ে আসছিলেন। ওই লোকটিও তাঁকে নিয়ে আসতে ব্যর্থ হচ্ছেন। কারণ, তাঁর হাত ব্যথা করছিল। তখন মেজর মো. আশিকুর রহিম এগিয়ে গেলেন এবং ওই বৃদ্ধ মাকে বাকি পথটুকু নিয়ে আসার জন্য ধরলেন। কোলে করে সীমান্ত করলেন ওই বৃদ্ধা মাকে।
মহানুভবতার এমন দৃষ্টান্ত আলোচানায় আসতে খুব বেশি দেরি হয়নি। বৃদ্ধ রোহিঙ্গা নারীকে কোলে করে সীমান্ত পার করে দেওয়ার ওই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন ভাইরাল। বিজিবির মেজর মো. আশিকুর রহিমের এ ছবিটি ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাড়া জাগিয়েছে। বিজিবির অতিরিক্ত পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেও তিনি অসহায় এক রোহিঙ্গার প্রতি যে মমত্ববোধ দেখিয়েছেন, তা নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা।
মেজর আশিকুর রহিমের ভাষ্য, ‘আমরা তো সব সময় বাড়ি থেকে অনেক দূরে কাজ করি। চাকরির কারণে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যাই। এ কারণে বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে তেমন থাকার সুযোগ হয় না। এ জন্য কোনো বয়স্ক মানুষ দেখলে নিজেদের মা-বাবার কথা পড়ে। ওই দিনও ঠিক এমনটি হয়েছে। আজ আমার মা যদি এই রকম বিপদে পড়েন, তখন তো কেউ না কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবেন। এ জন্য নিজের মায়ের কথায় মনে পড়ে গেল। কারণ, আমার মাও তো একদিন এ রকম বিপর্যয়ে পড়তে পারেন।’
‘আমাদের প্রত্যেকের মানবিকতাবোধ আছে। আছে দৃষ্টিভঙ্গি। এই মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে কাউকে না কাউকে এগিয়ে আসতে হবে। আমি যখন ওই বৃদ্ধ মাকে কোলে নিয়ে হাঁটছিলাম, তখন মনে হয়েছিল, আমার মাকে নিয়ে আমি নো-ম্যানস ল্যান্ড পার হচ্ছি।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও প্রতিনিধি, বাংলাদেশ প্রতিদিন।