প্রতিক্রিয়া
খান আতা বিতর্ক ও কিছু কথা
এ কথা সত্য যুক্তরাষ্ট্রে এসে বিভিন্ন সময়ে নানান বক্তব্য দিয়ে অনেকেই ঘোলাটে পরিস্থিতি তৈরি করেছেন। অনেক সময় এসব বক্তব্য বক্তার বিরুদ্ধেও গেছে। আবার অনেক তথ্য ভাবনার খোরাক জুগিয়েছে, নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে দাঁড় করিয়েছে। কথা বললে, সেই কথা সব সময় সবার পক্ষে যাবে, বিষয়টা তেমনও নয়। ফলে কখনো কখনো বিতর্ক তৈরি হতেই পারে। হয়েছেও তাই।
সবশেষ আলোচনার সূত্রপাত করলেন মুক্তিযোদ্ধা, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং নাট্যজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। তিনি একজন অত্যন্ত গুণী মানুষ। ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে আমি পছন্দ করি। তাঁর কথা বলার ধরন ও পরিমিতি বোধে আমি সব সময়ই মুগ্ধ। কেবল তাই নয়, একের পর এক মনে দাগ কাটার মতো চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন তিনি। তাঁর ‘আলফা’ চলচ্চিত্রে খুব অল্প সময়ের জন্যে সংবাদ উপস্থাপক চরিত্রে দেখা যাবে আমাকে। বাচ্চু ভাইয়ের ব্যক্তিগত আগ্রহেই কাজটি করেছিলাম আমি। সেই তিনিই এবার আমাকে বিরাট দ্বিধায় ফেলে দিলেন। বাংলাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা, গীতিকার, সুরকার ও অভিনেতা খান আতাউর রহমানকে ‘রাজাকার’ বললেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। তাঁর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তৈরি হয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রীতিমতো কথার লড়াই শুরু হয়েছে।
খান আতাউর রহমানকে সবাই ‘খান আতা’ নামেই চেনে। ছোটবেলা থেকে আমিও সেই নামেই তাঁকে জানি। টেলিভিশনের পর্দায় ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্র দেখেছি অসংখ্যবার। সেখানে খাতা আতার অনবদ্য অভিনয় মুগ্ধ করেছে। ১৯৭০ সালে জহির রায়হান পরিচালিত এই সিনেমায় খান আতার লেখা ও গাওয়া ‘এ খাঁচা ভাঙবো আমি কেমন করে...’ গানটিকে প্রতিবাদী গান হিসেবেই জেনে এসেছি। অথচ ‘দিকে দিকে বাজল যখন শেকল ভাঙার গান/আমি তখন চোরের মত, হুজুর হুজুর করায় রত’-খান আতার গান থেকেই এই লাইনগুলো নিয়ে এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর সমালোচনায় অনেককে সোচ্চার হতে দেখা যাচ্ছে। নবাব সিরাজ উদ দৌলা সিনেমাটি নির্মাণের পাশাপাশি, এতে খান আতার অভিনয় কত মানুষকেই না মুগ্ধ করেছে। ভালো লাগার মতো সৃষ্টিশীল অনেক কাজই করেছেন তিনি। সেই তিনি ‘রাজাকার’?
গত ১২ অক্টোবর নিউইয়র্কের জ্যামাইকায় একটি রেস্টুরেন্টে প্রবাসী বাংলাদেশি সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে একটি মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়েছিলেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। সেই অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে, তিনি উডসাইডে আমার অফিস টিবিএন২৪ টেলিভিশনের এসেছিলেন। এক ঘণ্টার একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি অবশ্য মুক্তিযুদ্ধ, নাট্য আন্দোলন এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন। বলেছেন নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা। মুক্তিযুদ্ধে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের ভূমিকার কথা তখন আলোচনায় তেমন একটা আসেনি। উডসাইড থেকে সেই মতবিনিময় সভায় যোগ দিতে সরাসরি জ্যামাইকায় চলে যান বাচ্চু ভাই। তাতে আমারো অংশ নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অফিসের কাজের কারণে শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়নি। ফলে অনুষ্ঠানে বাচ্চু ভাই ঠিক কী বলেছিলেন তা নিজের কানে শোনা হয়নি। কিন্তু পরে ফেসবুকের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখেছি, তিনি কিছুটা উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা বলছেন।
আলোচনার এক পর্যায়ে চলছিল প্রশ্নোত্তর পর্ব। হঠাৎই একটি প্রশ্নের জবাবে নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, ‘খান আতা অনেক বড় শিল্পী এটা অস্বীকার করব না, কিন্তু খান আতা রাজাকার। আমি না হলে খান আতা বাঁচত না। আমি গৌরব করব না, আমি না হলে খান আতা সেভেনটি ওয়ানে মারা যায়, ষোলই ডিসেম্বরের পরে।’
১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া খান আতা পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’ সিনেমা নিয়েও কঠোরভাষায় সমালোচনা করেন তিনি। বলেন, “‘আবার তোরা মানুষ হ’ খুবই নেগেটিভ ছবি। মুক্তিযোদ্ধাদের বলতেছে আবার তোরা মানুষ হ। আরে তুই মানুষ হ… তাই না… তুই তো রাজাকার ছিলি।’”
নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর বক্তব্যের ভিডিও ফেসবুকে তুমুল আলোচনার জন্ম দেয়। পক্ষে বিপক্ষে অনেকে কথা বলতে শুরু করেন। খান আতাকে নিয়ে ওই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তাঁর ছেলে সংগীতশিল্পী আগুন তাৎক্ষণিকভাবে বলেন, ‘খান আতাউর রহমান জনতার মানুষ। তাঁর সম্পর্কে কিছু বললে আগে জনতা উত্তর দেবে, তার ওপর ভিত্তি করে আমি প্রেসকনফারেন্স ডাকব। বাচ্চু চাচা এতবড় একজন মানুষ, প্রিয় একজন মানুষ, নিশ্চয়ই কোনো একটা গণ্ডগোল আছে। জনগণ উত্তর দেবে, আর আমার কাছেও এর উত্তর আছে’। খান আতার ছেলে আগুন চট করেই ‘আগুন ঝরানো’ কোনো উত্তর অবশ্য দেননি।
সেই ঘটনার পর, অনেকের মতো আমার মনেও বেশ কৌতূহল তৈরি হয়। ফলে বিস্তারিত জানতে আমি বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করি। সেদিনই তিনি দেশে ফিরে যাচ্ছেন। ফলে কিছুটা ব্যস্ততা ছিল। তার ওপর খান আতা বিতর্ক তার ওপর বেশ প্রভাব ফেলেছিল বলেই মনে হলো। আমি তাঁকে প্রশ্ন করলাম, ‘বাচ্চু ভাই, খান আতা রাজাকার ছিলেন?’ তিনি বললেন, ‘ঠিক সেই অর্থে রাজাকার নন; স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেননি। স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন’। কিন্তু আপনি বলছেন, তাঁকে আপনি বাঁচিয়েছেন। কেন বাঁচিয়েছিলেন ভাই? ‘কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের কিছু নীতি ছিল, যুদ্ধের পর আমরা কাউকে মেরে ফেলতে পারি না। তা ছাড়া তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত ছিলেন না। বিস্তারিত আমার ফেসবুকে দিয়েছি; সেখান থেকে দেখে নিও’। উত্তর দেন বাচ্চু ভাই। আরও জানার আকাঙ্ক্ষা থেকে প্রশ্ন করি, কিন্তু বাচ্চু ভাই, আমি জানতে চাই, কীভাবে আপনি তাঁকে বাঁচিয়েছিলেন? ‘শামীম যা বলার ফেসবুকে বলে দিয়েছি’। কিন্তু এত বছর পরে কেন বললেন? তিনি জানালেন, ‘ সেদিন আলোচনার প্রেক্ষিতে কথাগুলো এসেছে’। এর বেশি কথা টেলিফোনে বলা সম্ভব হলো না। তার ওপর তিনি দেশে ফেরার ব্যস্ততায় ছিলেন।
তীব্র প্রতিক্রিয়ার কারণে নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন তখন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘খান আতাউর রহমান একজন সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন। কিন্তু একাত্তরে তিনি ‘পাকিস্তানের সমর্থক’ ছিলেন; দেশ ও মানুষের পাশে দাঁড়াতে ‘ব্যর্থ হয়েছিলেন’। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নাই। শিল্পী হিসেবে তাঁর প্রশংসা করি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর ভূমিকার সমালোচনা তো করতেই পারি’। এই বক্তব্যের পক্ষে তিনি একাত্তরে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে খান আতাসহ ৫৫ জন বুদ্ধিজীবী ও শিল্পীর দেওয়া এক বিবৃতি এবং রেডিও-টেলিভিশনে পাকিস্তানপন্থী প্রচারে সহযোগিতাকারীদের শনাক্ত করতে স্বাধীনতার পর ড. নীলিমা ইব্রাহীমের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন তুলে ধরেন। তিনি জানান, খান আতাকে নিয়ে তাঁর বক্তব্যকে ঘিরে ফেসবুক ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমে যে ‘অহেতুক বিতর্ক’ চলছে, তাঁর অবসান ঘটাতেই এই বিবৃতি। বিবৃতিতে তিনি লিখেন, ‘বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সংগীত পরিচালক খান আতাউর রহমান ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে অপারগ হয়েছিলেন। যে ৫৫ জন বুদ্ধিজিবী ও শিল্পী ১৯৭১ এর ১৭ মে মুক্তিযুদ্ধকে ‘আওয়ামী লীগের চরমপন্থিদের কাজ’ বলে নিন্দাসূচক বিবৃতি দিয়েছিলেন, দুঃখজনকভাবে খান আতাউর রহমান তাঁর ৯ নম্বর স্বাক্ষরদাতা ছিলেন। ১৭ মে ১৯৭১ দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকা দ্রষ্টব্য।’ সেই সঙ্গে নীলিমা ইব্রাহীমের দেওয়া তালিকায় ৩৫ নম্বর নামটি খান আতাউর রহমানের বলে জানান তিনি।
নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু অবশ্য লেখেন, ‘খান আতা যে একজন গুণী শিল্পী, তা অনস্বীকার্য। তাঁর সৃষ্টিশীলতা নিয়েও কোনো প্রশ্ন নেই। মুক্তিযুদ্ধের আগে তাঁর অনেক সিনেমা মানুষকে উজ্জীবিত করেছে।’ নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু কেন তাঁকে বাঁচিয়েছিলেন বিবৃতিতে সেই প্রশ্নের উত্তরও দেন, ‘অনেকের মনে প্রশ্ন উদ্রেক হয়েছে যে, ৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর অব্যহতিতে কেন আমি বা আমরা তাঁকে রক্ষা করেছিলাম। কারণ খান আতাউর রহমান কোনো প্রকার মানবতাবিরোধী কর্মে লিপ্ত ছিলেন না; যদিও পাকিস্তানিদের সমর্থনে রেডিও-টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করেছেন’। তিনি বলেন, ‘আমরা এও ভেবেছি, ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, অনেকে পাকিস্তানিদের পক্ষাবলম্বন করেছে। আমরা তা বিচারের এখতিয়ার রাখি না। তা ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের এ কথা বাধ্যতামূলক মানতে হয়েছিল যে, কোনো অবস্থাতেই যুদ্ধোত্তর সময়ে কারো ক্ষতি বা আঘাত করা যাবে না। বিচারিক প্রক্রিয়ায় দোষী সাব্যস্তদের বিচার করা হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে। মুক্তিযোদ্ধারা সেই আদেশ পুরোপুরিভাবে মেনেছিল বিধায় যুদ্ধোত্তরকালে প্রাণহানির ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে কম হয়েছিল।’
নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু আরও বলেন, ‘ইতিহাসের দায় থেকে আমি খান আতাউর রহমান সম্পর্কে উক্তিটি করেছিলাম।… আশা করি আমার এ বক্তব্য সকল তর্ক-বিতর্কের অবসান ঘটাবে’।
বাচ্চু ভাই তর্ক বিতর্কের অবসান ঘটানোর জন্যে বিবৃতি দিলেও, তা কিন্তু থেমে থাকেনি। বাচ্চু ভাইয়ের বক্তব্যের পর, অসংখ্য মানুষকে পাওয়া গেছে তাঁর পক্ষে। দেশে অনেক সাংস্কৃতিক কর্মী তাঁর কথাকে সমর্থন করে নিজেরাও বক্তব্য দিয়েছেন। এমনকি সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন ১৯ জন প্রবাসী সাহিত্যিক, লেখক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক। যারা মূলত যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। পাশপাশি অবশ্য অন্যদের নামও কেন বাচ্চু ভাই বললেন না, তা নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন তারা।
আবার অনেকেই খান খাতার পক্ষে কথা বলেছেন। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে সরব দেখা গেছে বিশিষ্ট চলচ্চিত্র অভিনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা ফারুককে। বিভিন্ন জায়গায় এ নিয়ে প্রতিবাদী বক্তব্য রেখেছেন তিনি। ‘খান আতা রাজাকার ছিলেন’ এই বক্তব্য প্রমাণ করতে নাসির উদ্দীন বাচ্চুর প্রতি আহবান জানান তিনি। ‘চলচ্চিত্র পরিবার’ এর ব্যানারে ‘দুঃখের কিছু কথা বলতে চাই’ শিরোনামে একটি সংবাদ সম্মেলনও করেন ফারুক। আলোচনায় অংশ নেন নির্মাতা আমজাদ হোসেন ও খান আতার ছেলে আগুনসহ বেশ কয়েকজন প্রবীণ চলচ্চিত্র নির্মাতা। চিত্রনায়ক ফারুক বলেন, ‘খান আতা পরিচালিত ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭৩ সালে। তখন বঙ্গবন্ধুর সরকার ক্ষমতায় ছিল। ছবিটি নিয়ে তখনই বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। পরে মুক্তিযোদ্ধা ও বর্তমান ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ছবিটি রিভিউ করে এটি চালানোর অনুমতি দেন। মুক্তিযুদ্ধের সরকারই ছবিটি নিয়ে আপত্তি করেনি’। নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুকে উদ্দেশ করে ফারুক প্রশ্ন করেন, ‘এ নিয়ে কথা বলার আপনি কে?’ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া ফারুকও এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। ‘আবার তোরা মানুষ হ’ সিনেমার প্রেক্ষাপটের কথাও ব্যাখ্যা করেন তিনি।
খান আতার ছেলে আগুন বলেন, ‘এভাবে গুণী মানুষদের ছোট করতে নেই। আমার বাবাকে দেশের সবাই চেনেন ও জানেন। আজকে হঠাৎ তাঁকে রাজাকার বলে দিলেই তাঁকে খাটো করা যাবে না।’ অনেকে আবার তাঁর বক্তব্যের জন্য নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুকে ক্ষমাও চাইতে বলেছেন।
পরিস্থিতি যখন এই, তখন বেশ কিছু প্রসঙ্গ সামনে চলে আসে। এতগুলো বছর পরে কেন খান আতাকে নিয়েই কথাগুলো বলতে গেলেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। বিবৃতির সঙ্গে তিনি যে তালিকা দিয়েছেন, সেখানেই রয়েছে অনেক রথী-মহারথীর নাম। তাদের মধ্যে কিংবদন্তিতুল্য কয়েকজন শিল্পীও রয়েছেন। তাদের অনেকে বেঁচেও আছেন। পরবর্তীকালে যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, দেশ নিয়ে চমৎকার সব গানও গেয়েছেন। বাচ্চু ভাই তাদের কথা বললেন না কেন। ‘আবার তোরা মানুষ হ’ চলচ্চিত্রটি যদি নেগেটিভই হবে, তাহলে কেন এত বছর বলেননি। মুক্তির সময়টাতেই বা কেন, প্রতিরোধ গড়ে তোলেননি। তার ওপর যাকে নিয়ে বাচ্চু ভাই বক্তব্যটি দিয়েছেন, তার কোনো উত্তর পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ তিনি জীবিত নন। খান আতা বেঁচে থাকার সময় বিতর্কটি উঠলে হয়তো খান আতার বক্তব্যও পাওয়া যেত। তিনি কি বলতেন? বেঁচে আছেন এমন কারো নামও যদি তিনি বলতেন, তাহলে তাঁরও প্রতিক্রিয়া নিশ্চয়ই জানতে পারতাম।
সেদিন বাচ্চু ভাইয়ের সঙ্গে প্রবাসী সংস্কৃতিকর্মীদের মতবিনিময় সভায় আরও কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। ঠিক কী উদ্দেশ্যে, কেন খান আতার বিষয়টি সেদিন এলো, বাচ্চু ভাই কি পরিকল্পণা করে, প্রস্তুতি নিয়ে কথাগুলো বলেছেন? নাকি প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছে, এসব বিষয় নিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে আমার কথা হয়। তাদের কেউই নাম প্রকাশ করতে চান না। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, বিষয়টা কতটা স্পর্ষকাতর। তাদের অনেকেই জানালেন, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু পরিকল্পনা করে এই প্রসঙ্গটি সামনে এনেছেন বলে তাদের মনে হয়নি। আলোচনার এক পর্যায়ে বিষয়টি আসে। সেখানে উপস্থিত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানিয়েছেন, ‘মতবিনিময় সভায় উপস্থিত কেউ কেউ যেন চাইছিলেন বাচ্চু ভাই বিতর্কিত কিছু বলুক। কেউ কেউ দৌড়ে এসে তাঁর বক্তব্যের ভিডিও করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে।
একটা একাডেমিক আলোচনাকে সিরিয়াস করে তুলেছেন। ঘরের বাইরে নিয়ে গেছেন’। সেখানে উপস্থিত একজন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের কাছে জানতে চাইলাম, বাচ্চু ভাইয়ের মতের সঙ্গে তিনি একমত কি না। তিনি দাবি করেন, ‘খান আতা সম্পর্কে নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ঠিক বলছেন। সেই সঙ্গে তিনি মনে করিয়ে দিলেন, কেবল খান আতা নন; এখন বিখ্যাত অনেককে দেখেন, যারা সেই সময় দেশে থেকেছেন। রেডিও-টিভিতে অনুষ্ঠান করেছেন, স্বাধীনতার বিপক্ষে বক্তৃতা বিবৃতিও দিয়েছেন’।
আবার আলোচনায়, লেখায় ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে বলার চেষ্টা করছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেকেই দেশে ছিলেন। বাধ্য হয়ে অনেকে কাজও করেছেন। অনেক বুদ্ধিজীবীও দেশ ছেড়ে যাননি। তাঁদের কেউ কেউ যাননি, ‘মরি বাঁচি দেশে থাকব’—এই ভাবনা থেকে। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন। কেউ কেউ যাননি নিজেদের স্বাভাবিক কাজকর্ম অব্যাহত রাখতে। কেউ পাকিস্তানের পক্ষেই থেকেছেন। যিনি যে কারণেই যাননি, যার যা ভূমিকা; এগুলো কি নিরপেক্ষভাবে সামনে আসবে এবার?
রাজনৈতিক মোহবিষ্ট না হয়ে, বিতর্ক আর ভয়কে উপেক্ষা করে, এমন কোনো নজির স্থাপন করা যায় না। পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে, পুরো সত্যিটা কি এই সুযোগে উঠে আসবে। নাকি বিতর্ক থামানোর প্রচেষ্টায়, নতুন করে বিতর্ক তৈরির ভয়ে কিংবা বিব্রত হয়ে সবাই চেপে যাবেন কথাগুলো।
লেখক : সাংবাদিক