অভিমত
বাংলাদেশ সবার আগে
আমরা যেমন বিজ্ঞানে তত্ত্ব ও ব্যবহারিকতার কথা (Theory and Practice) বলি, তেমনি পররাষ্ট্রনীতি এবং প্রয়োগে অনেকক্ষেত্রে এক বিস্তর ব্যবধান লক্ষ করা যায়। আর লৌকিকতার ব্যাপারটিও মনে রাখতে হবে। যেমন ধরুন, যে ব্যক্তিকে আপনি পছন্দ করেন না তিনি আপনার ঘরে এলেন। তখন কি আপনি তার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করবেন না? কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এর আধিক্য বরং বেশি। অনেক সময় কূট রাজনীতিকরা কূটনীতির এসব ভাষা-পরিভাষা ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দেন। সাম্প্রতিক বাংলাদেশ ভারত প্রসঙ্গে বিষয়টি প্রতিভাত হয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- রোহিঙ্গা বিতাড়নের প্রাককালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যখন মিয়ানমারে গেলেন তখন তিনি ‘সন্ত্রাস দমনে মিয়ানমারের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে এলেন।’ তিনি যুক্তি দিতে পারেন যে, রোহিঙ্গা বিতাড়নকে তিনি সমর্থন দেননি। মিয়ানমারের জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি যে হুমকি বা আক্রমণ তাৎক্ষণিকভাবে পরিচালিত হয়েছে তিনি তার নিন্দা করেছেন। তাহলে বুঝতে হবে কূটনীতির ভাষার মারপ্যাচ আছে। এ রকম একখানা ভালো কথা- মানুষকে খুশি করার কথা বলে গেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। যাওয়ার আগে ভারতীয় চ্যানসেরি কমপ্লেক্স উদ্বোধনের সময় তিনি আবেগের সঙ্গে বলেন, ‘পড়শি পেহলে, লেকিন বাংলাদেশ সাবসে পেহলে।’ তাঁর এ মন্তব্য নিয়ে সরস আলোচনা হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন- ‘সবসে পেহলে’ কথার তাৎপর্য কি এই যে সব ভালো কিছুর আগে বাংলাদেশ নাকি সব কিছুর খারাপের জন্য বাংলাদেশ নির্ধারিত।
ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক প্রাণবন্ত । আমাদের কূটনীতিকদের ভাষায় তা ‘অতি উচ্চ হিমালয় অতিক্রম করেছে।’ সেই উচ্চতার মাত্রায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। তিনি যৌথ পরামর্শক কমিশন-জেসিসির বৈঠকের উদ্দেশে ঢাকা আসেন। কমিশন গঠনের প্রয়োজনীয়তা থেকে নির্ভরশীলতার স্থানটি অনুমান করা যায়। দুটো বড় ধরনের ইস্যু তাঁর এ সফরকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। প্রথমত, রোহিঙ্গা ইস্যু। কূটনীতির তুষ্টকর ভাষা দেখে মনে হয় ভারতের মৌলিক ভূমিকার কোনো পরিবর্তন হয়নি। একবারও রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারিত হয়নি। সেখানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর যে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সে প্রশ্নে স্পষ্ট কোনো নিন্দার ভাষা উচ্চারিত হয়নি। বাংলাদেশের অনুরোধ সত্ত্বেও মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগের কোনো প্রতিশ্রুতিও ভারত দেয়নি।তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং প্রধান বিরোধী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে যাওয়ার পক্ষে কথা বলেছেন। প্রকারান্তরে সুষমা স্বরাজ আরাকান রাজ্যে ভারতীয় বিনিয়োগের সাফাই গেয়েছেন। সেখানে স্থায়ী সমাধান হিসেবে তিনি অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অবকাঠামো গড়ে তোলার জোড় দিয়েছেন। সবকিছু হিসাব-নিকাশ করে রোহিঙ্গা প্রশ্নে অবশেষেও চীন, রাশিয়া ও ভারতের অবস্থান সমান্তরাল রয়েছে।
অন্য যে বিষয়টি দ্বিতীয় হলেও এর রাজনৈতিক গুরুত্ব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। দেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতি তথা আগামী নির্বাচন নিয়ে সুষমা স্বরাজ দরাজ গলায় কথা বলেছেন। আর আমরাও কথা বলেছি। একসময়ে ভারতের নেতা জওহরলাল নেহেরু পঞ্চশীলা নীতির কথা বলতেন। পরস্পরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার এ নীতি ১৯৫৫ সালে অনুষ্ঠিত বান্দুং সম্মেলনে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়। সেই ভারত এখন প্রতিবেশী রাষ্ট্রে হস্তক্ষেপ করার জন্য সেনাবাহিনী পাঠায়, অবরোধ করে, সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের নামে অপরের অভ্যন্তরে আঘাত করে এবং নির্বাচনে দলের নিরঙ্কুশ বিজয়ের জন্য বস্তা বস্তা টাকা পাঠায়। যাহোক বিশ্ব রাজনীতিতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।
ভারত পৃথিবীর এ অঞ্চলে পরিবর্তনের অণুঘটক বা চেঞ্জ মেকার হতে চায়। বাংলাদেশের যেকোনো রাজনৈতিক পরিবর্তন যাতে ভারতের বিপরীতে না যায়, সেজন্য তারা রণকৌশল নির্ণয় করছে। কয়েক বছর ধরে ভারতীয় কূটনীতিকরা অধিকতর আনুষ্ঠানিক ভাষা প্রয়োগ করে আসছেন। তাঁরা ‘পিপল টু পিপল’ সম্পর্কের কথা বলছেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেছেন, ভারত শুধু কোনো দল বা সরকারের সঙ্গে বন্ধুত্ব চায় না বরং বাংলাদেশের জনগণের বন্ধুত্ব চায়। সুষমা স্বরাজ স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখতে চায় ভারত। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণের বিষয়ে ’সহায়ক পরিবেশ’ নিশ্চিতকরণের দায়িত্বও যে সরকারের তা তিনি জোর দিয়ে বলেন।
সুষমা স্বরাজ পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেন। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো সত্যিকার অর্থে যদি গণতান্ত্রিক নীতিমালা দ্বারা শাসিত হয় তাহলে পারস্পরিক সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ থাকাই স্বাভাবিক।
নেতিবাচকভাবে আমরা কোনোটিই দেখতে চাই না। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাস্তব সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধান বাংলাদেশের মানুষের কাম্য। রোহিঙ্গা সমস্যার আশু সমাধান যেমন আমরা আশা করি ঠিক তদ্রুপভাবে তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে ন্যায্য হিস্যা আশা করি। আমরা আমাদের সীমান্তে এখনো প্রতিদিন নাগরিক হত্যার খবর পাচ্ছি। আমরা এখনো জানতে পারিনি কী কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাঙালি খেদাও অভিযান শুরু হয়েছে। ভারতের অন্যত্র, দিল্লি, মুম্বাই, উত্তর প্রদেশে বাংলাদেশি নাগরিক মাত্রই শঙ্কিত। তাই শুধু কথার ফুলঝুড়ি নয়, বাস্তবে বাঙারি ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতি তাদের ‘সাবসে পেহলে’ সহানুভূতি আশা করি।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।