অভিমত
কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার উভয় সংকট
সদ্য ঘোষিত স্বাধীনতা নিয়ে কাতালোনিয়ার জনগণ উভয়সংকট অতিক্রম করছে। স্বাধীনতার ঘোষণাকে যদি তারা দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়ন করতে না পারে তাহলে আরো অনেক কালের জন্য তাদের নিগড়ে আবদ্ধ থাকতে হবে। অপরদিকে যদি তারা স্বাধীনতার যুদ্ধ বা মুক্তি সংগ্রাম শুরু করে তাহলে তাদের একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মোকাবেলা করতে হবে। সকলেরই ধারণা ছিল কাতালানিয়া বুঝে শুনে এগুবে। কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার নেতা কার্লোস পুজেমনের গতিবিধি ও বক্তব্য দেখে এমনটি মনে হয়েছিল। কিন্তু অবশেষে সবাইকে অবাক করে দিয়ে কাতালোনিয়া একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। ইতিপূর্বে পার্লামেন্ট অধিবেশন ডেকেও স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি কাতালোনীয় নেতৃত্ব। বরং তারা রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
কাতালোনীয় আঞ্চলিক পার্লামেন্টে ২৭ অক্টোবর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করে। পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন স্বাধীনতাকামী চরমপন্থীদের চাপের মুখে কাতালোনীয় নেতা পুজেমন এ ঘোষণা দিতে বাধ্য হন। স্বাধীনতার ঘোষণায় কাতালোনিয়াকে স্বাধীন সার্বভৌম এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়। গণভোটে স্বাধীনতার পক্ষে রায় পাওয়ার প্রায় এক মাস পরে স্পেনের স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল-এই কাতালোনিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিল। পার্লামেন্টে স্বাধীনতা ঘোষণার পর পরই কাতালোনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনাসহ বিভিন্ন এলাকায় উচ্ছ্বাস-উৎসবে মেতে ওঠে হাজার হাজার মানুষ। আঞ্চলিক পার্লামেন্টের বাইরে বার্সেলোনার সিতাদেলা পার্কে সমবেত জনতা ‘স্বাধীনতা স্বাধীনতা’ বলে স্লোগান দেয়। আর পুজেমনকে প্রেসিডেন্ট বলে অভিবাদন জানায়। জনতা কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার জাতীয় সঙ্গীত গায়।
এদিকে স্পেনের কেন্দ্রীয় সরকার কাতালোনিয়ার আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন বাতিল করেছে। সেখানে তারা কেন্দ্রীয় শাসন বলবৎ করার প্রয়াস নিয়েছে। স্পেনের উপপ্রধানমন্ত্রীকে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে স্বাধীনতাকামী কাতালোনিয়ার শাসনভার প্রদান করা হয়েছে। শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি সাংবিধানিক ব্যবস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকার সেখানে আগামী ডিসেম্বরে আঞ্চলিক নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী মারিয়্যানো রাজয় জনগণকে শান্ত থাকতে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি স্বাধীনতাকামী কাতালোনিয়াকে আইনের রক্ষাকবচ দেওয়ারও অঙ্গীকার করেন। সেই সঙ্গে কাতালোনিয়ার প্রশাসনিক পদাধিকারীদের বরখাস্ত করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এঁদের মধ্যে কাতালোনিয়ার পুলিশ প্রধানও রয়েছেন। স্পেনের সরকারি কৌঁসুলি জানিয়েছেন, তাঁরা স্বাধীনতাকামী নেতা কার্লোস পুজেমনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনবেন। তবে তাঁর ভাগ্যে অবশেষে কী ঘটেছে তা জানা যায়নি। ইতিমধ্যে স্বাধীনতাকামী আরো দুজন নেতাকে অন্তরীণ করা হয়েছে। কাতালোনিয়ার এই স্বাধীনতার ঘোষণা এবং আন্দোলন বিপুল জনপ্রিয় হলেও বিরোধহীন নয়।
সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বার্সেলোনায় লাখ লাখ মানুষের সমাবেশের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন যেমন লক্ষ করা গেছে, তেমনি স্বাধীনতার বিপক্ষেও সমাবেশ হয়েছে। তার মানে কাতালোনীয় জনগণ স্বাধীনতার পক্ষে নিরঙ্কুশ নয়। অপরদিকে কেন্দ্রীয় সরকার সেখানে যখন কর্তৃত্ব প্রয়োগের প্রয়াস নিচ্ছে, তখন অস্থিরতা, অরাজকতা, অসহযোগিতা এবং সহিংসতা ঘটার সমূহ সম্ভবনা রয়েছে। কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাকামী এবং স্বাধীনতা বিরোধী পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘর্ষের সম্ভবনাও অমূলক নয়। কাতালোনীয় পুলিশ এবং প্রশাসনের ভূমিকার ওপর কাতালোনিয়ার স্বাধীনতায় সহিংসতা কতটা প্রবল হবে- তা বোঝা যাবে। বিবিসির খবরে বলা হয়, কাতালোনীয় পুলিশকে নিরপেক্ষতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের শক্তি প্রয়োগের প্রাবাল্য যতটা বেশি হবে ততটাই গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা। যদিও কাতালোনিয়ার নেতা কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের আহ্বান জানিয়েছেন, কিন্তু শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কতদিন চলতে পারবে বা চালানো সম্ভব হবে- সেটিই এখন জিজ্ঞাস্য।
কাতালোনিয়ার রাজনৈতিক বিরোধটি বুঝবার জন্য আঞ্চলিক পার্লামেন্টের দিকে চোখ বোলানো যায়। সেখানে সর্বমোট আসন সংখ্যা ১৩৫। কার্লোসের দল পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ। স্বাধীনতার জন্য যখন পার্লামেন্টে ভোট গণনা করা হয়, তখন পক্ষে ৭০ ভোট এবং বিপক্ষে ১০ ভোট পড়ে। দুজন আইন প্রণেতা পার্লামেন্টে অবস্থান করা সত্ত্বেও ভোট দানে বিরত থাকেন। আর অনেক বিরোধী আইন প্রণেতা ভোটাভুটির আগে অধিবেশন বর্জন করে বেরিয়ে যায়। এসব আইন প্রণেতারা স্পেনের জাতীয় ভিত্তিক দল- দ্য পিপলস্ পার্টি, সোস্যালিস্ট এবং সিউডাডানস পার্টির প্রতিনিধিত্ব করেন। এবার ১ অক্টোবর গৃহীত ভোটাভুটির হিসাব-নিকাশ নেওয়া যাক। এতে ২০ লাখ ২০ হাজার লোক ভোট দিয়েছিল। এর ৯০ ভাগ ভোট ছিল স্বাধীনতার পক্ষে। এক লাখ ৭৭ হাজার মানুষ স্বাধীনতার বিপক্ষে ভোট প্রদান করে। কাতালোনিয়া কর্তৃপক্ষ বলছেন যে, আরো সাত লাখ ৭০ হাজার ভোট কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে বাতিল হয়ে গেছে। স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি দাবি করছেন যে তাঁরা গৃহীত ভোটের ৯১.৯৬ শতাংশ ভোট লাভ করেছেন। অপরদিকে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বলছে ভোটে অনিয়ম এবং জালিয়াতি হয়েছে। ভোট দানে সক্ষম ব্যক্তিদের মাত্র ৪৭ শতাংশ এ ভোটে অংশ গ্রহণ করে। কেন্দ্রীয় সরকার দেখাতে চাচ্ছে যে, বাকি গরিষ্ঠ অংশ তাদের পক্ষে রয়েছে, তা ছাড়া তারা এই গণভোটকে অবৈধ ও বেআইনি বলে ঘোষণা করে এবং ভোট গ্রহণে বাধা দেয়। সেখানে সহিংসতার ঘটনাও ঘটে। এর পর পরই স্পেনের কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব ও কাতালান প্রশাসনের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলা যায় যে, স্পেনের সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগণ থেকে নৃতাত্ত্বিকভাবে এরা পৃথক। কাতালোনিয়ার রয়েছে নিজস্ব ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি। দীর্ঘকাল ধরে তারা স্বাধীনতার সংগ্রাম পরিচালনা করছে। বিশেষ করে ১৯৩৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তারা ফ্রাঙ্কোর রাজনৈতিক নিপীড়ন মোকাবিলা করে। এ সময় কাতালোনিয়ার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তথা স্বায়ত্তশাসন নস্যাৎ করা হয়। স্পেনের উত্তর পূর্বাঞ্চলে কাতালোনিয়া অঞ্চলের আয়তন ৩২ হাজার ১১৪ বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ৭৫ লাখ। এটি স্পেনের সবচেয়ে সম্পদশালী ও শিল্পোন্নত এলাকা। পর্যটন ও শিল্প কারখানা এ অঞ্চলের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি।
কাতালোনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও ইউরোপসহ বহির্বিশ্বের সমর্থন শূন্য। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মের এক মুখপাত্র কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি না দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একই ভাষায় বলেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র কাতালোনিয়াকে স্পেনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বলেছেন, কাতালোনিয়ায় কেন্দ্রীয় শাসন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তে তার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। জার্মানিও একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণাকে অনুমোদন করেনি। তারা দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে। ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট জঁ ক্লদ জাঙ্কার বলেছেন, কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার পর ২৮টি দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নে নতুন করে ভাঙনের আশংকা করছেন তিনি। এ ভাঙনের মুখে গোটা ইউরোপে বাণিজ্যিক বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে ব্যবসায়ীদের আশংকা। ন্যাটোর মুখপাত্র কাতালোনিয়া সংকটকে স্পেনের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বর্ণনা করেন। তিনি মনে করেন, স্পেনের সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে কাতালোনিয়া সংকটের সমাধান হওয়া উচিত। স্পেন ন্যাটো জোটের এক শক্তিশালী অংশীদার বলে তিনি অভিহিত করেন।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়