৭ নভেম্বর
ইতিহাসের এক অমীমাংসিত সত্য
বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্রের ইতিহাসে ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ এক রহস্যময় অধ্যায়। ৪২ বছর পরে আজও বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের ধারণা পরিচ্ছন্ন ও পরিপূর্ণ নয়। নাগরিক সাধারণের জন্য ঔতসুক্য সৃষ্টি করে এমন শিরোনাম দিয়ে লেখক গবেষকরা বলছেন, ‘অজানা অধ্যায়’, ‘অনুদঘাটিত দিনগুলো’ অথবা ‘আচ্ছাদিত ইতিহাস’। বিষয়টির প্রতি একজন নিবিষ্ট গবেষক হিসেবে আমার উপলব্ধি সবকিছুই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু প্রমাণিত হয়নি। এটির রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে কমপক্ষে তিন রকম বিভক্তি রয়েছে। প্রথমত, জাতীয়তাবাদী দল তথা বিএনপির কাছে এটি সিপাহি-জনতার বিপ্লব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এটি ছিল জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা অধিষ্ঠানের ভিত্তিভূমি। বিপ্লব নামের সার্বিক পরিবর্তন এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের আবেদন তারা জিয়াউর রহমানের ক্ষমতার নৈতিকতা ও বৈধতা প্রমাণ করতে চায়।
দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগ বিষয়টিকে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা দ্বারা তাদের জন্য নিরাপদ বলয় স্থাপন করতে চায়। ৭ নভেম্বরের যে ইতিহাস প্রকাশিত হয়েছে তার কোনো ব্যাখ্যাই আওয়ামী লীগের অনুকূল নয়। সে অস্থির সময়ে সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তি, দল ও গোষ্ঠী আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। ৭ নভেম্বরের মূল অনুঘটক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব অনুষ্ঠানের জন্য সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে গোপন কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। তারা সে সময়ের তৃতীয় পক্ষ। তাদেরও একটি নিজস্ব ব্যাখ্যা এবং বিবৃতি রয়েছে। সে কারণে আনুষ্ঠানিক উপসংহারে পৌঁছানো একটি দুঃসাধ্য ব্যাপার।
১৯৮৮ সালে আমার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের পটভূমি হিসেবে বিষয়টি নিয়ে আমি কাজ শুরু করি। খুব স্বাভাবিকভাবে রাজনীতি নিরাসক্ত একাডেমিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিষয়টির গভীরে প্রবেশের চেষ্টা করি। উল্লেখত, ঘটনাক্রম বা বিষয়বস্তু আমার ব্যক্তিগত অধ্যয়ন উৎসারিত। ঘটনার প্রাথমিক লিটারেচার যেমন লিফসুজের আনফিনিশড রেভ্যুলেশন, ম্যাসক্যারান হ্যার-এর ‘লিগ্যাসি অব ব্লাড’ এবং মার্কাস ফ্রান্দার ‘বাংলাদেশ দ্যা ফার্স্ট ডিকেড’ ইত্যাদির ওপর নির্ভর করা হয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর লিখিত বর্তমান লিটারেচার-মহিউদ্দীন আহমদের ‘বিএনপি সময়-অসময়’, মাহফুজুল্লাহর ‘প্রেসিডেন্ট জিয়া’, হাবিব জাফরুল্লাহ সম্পাদিত ‘দি জিয়া ইপিসোড ইন বাংলাদেশ পলিটিক্স’ এবং শফিক রেহমান সম্পাদিত ‘রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান’ ইত্যাদি গ্রন্থসমূহ ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রফেসর ড. তালুকদার মনিরুজ্জামান, প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ, প্রফেসর ড. আতাউর রহমান লিখিত সংশ্লিষ্ট গভীর গবেষণামূলক গ্রন্থ ব্যবহার করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমার লেখা তিনটি গ্রন্থ—জিয়া রেজিম, জিয়াউর রহমান আচ্ছাদিত ইতিহাস এবং রাষ্ট্রনায়ক জিয়া গ্রন্থাবলি থেকে তথ্যউপাত্ত সংগৃহীত হয়েছে। সাম্প্রতিককালে অনেক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা তাঁদের অভিজ্ঞতা নিয়ে গ্রন্থ ইত্যাদি রচনা করেছেন।
পটভূমি
১৯৭১ সালে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। একটি নতুন দেশের নতুন নাগরিক হিসেবে সর্বত্র একটি আশা-আকাঙ্ক্ষার ভীত রচিত হয়। কিন্তু প্রাথমিক শাসক এলিট এবং এর নেতৃত্ব সে আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে জনগণের জন্য আরো দুর্যোগ ও দুঃখকষ্ট বয়ে আনে। জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা কমছিল বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। সেনাবাহিনীর একটি বিপথগামী অংশ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। জনগণের দুর্ভোগ এবং শাসন প্রশাসনের ব্যর্থতা সুযোগ গ্রহণ করে তারা। ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনাবলিকে প্রকারান্তরে সেনাবাহিনী অনুমোদন দেয়। ওই দিন বেলা ১১টায় সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে হত্যাকারী মেজররা নিজেদের সেনাবাহিনীর কাছে সমর্পণ করে। সেনাবাহিনী তাদের গৃহীত সিদ্ধান্তে এমনভাবে প্রকাশ করে যে, ‘হোয়াট হ্যাপেন্ড ইজ হ্যাপেন্ড’। জেনারেল জিয়াউর রহমান সংবিধান অনুযায়ী অগ্রসর হওয়ার তাগিদ দেন। তিনি সাবেক ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ উল্লাহর কাছে দায়িত্ব সমর্পণের পরামর্শ দেন। অবশ্য ততক্ষণে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদ প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। প্রাথমিক আবেগ-উত্তেজনা এবং ভাব ও বিহ্বলতা কাটিয়ে ওঠার পর সেনাবাহিনীতে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। খুনি মেজররা বঙ্গভবনে বসে রাষ্ট্র চালাচ্ছিল। আর সিনিয়ররা সেনানিবাসে বসে তাদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছিলেন। খন্দকার মোশতাক আহমেদ মেজরদের আস্থা অর্জন করেছিলেন। সিনিয়রদের তাঁর প্রতি দৃঢ় আনুগত্য ছিল না।
খন্দকার মোশতাক মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানীকে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা নিয়োগ করলে স্বস্তির আশাবাদ সৃষ্টি হয়। কিন্তু উভয় পক্ষই তাকে যেমন বিশ্বাস করছিল তেমনি অবিশ্বাস করছিল। উল্লেখ্য যে, ততদিনে সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহ রাষ্ট্রদূতের চাকরি নিয়ে লন্ডনে পাড়ি জমান এবং জেনারের জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত হন। জিয়া তাঁর স্বভাবসুলভ কুশলতা এবং ভারসাম্যপূর্ণভাবে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। জিয়ার প্রতি মেজরদের আস্থায় ঘাটতি না থাকলেও সিনিয়ররা ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়েন। ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় পদাধিকারী খালেদ মোশাররফ এবং ঢাকা ব্রিগেডপ্রধান কর্নেল সাফায়াত জামিল দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর এই দুজন মুক্তিযোদ্ধা ব্যক্তিত্ব জিয়াউর রহমানের কমান্ডকে অস্বীকার করেন। তারা পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটান। জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করেন। খালেদ মোশাররফ নিজেকে সেনাবাহিনীপ্রধান ঘোষণা করেন। তারা খন্দকার মোশতাকের পরিবর্তে প্রধান বিচারপতি এএসএম সায়েমকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেন। তিনটি প্রেক্ষাপট দ্বারা এই পরিস্থিতিটি ব্যাখ্যা করা যায়।
প্রথমত সেনানিবাস পরিস্থিতি
সেখানে জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গোপনে কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আশায় কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে তারা গোপনে কর্মরত ছিল। ৩ নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থান সেনাছাউনিতে এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব একটি আত্মঘাতী যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করে। সেনাবাহিনীর রাজনীতি সচেতন অংশ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মাধ্যমে কর্নেল তাহেরের কাছে করণীয় নির্দেশ আশা করে। কর্নেল তাহের তখন নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করছিলেন। নির্দেশনা দেওয়ার জন্য ট্রেনে তিনি ঢাকা আসেন এবং এলিফ্যান্ট রোডে এক শুভাকাঙ্ক্ষীর বাড়িতে অবস্থান নেন। কর্নেল তাহের এ পরিস্থিতিকে কাঙ্ক্ষিত বিপ্লবের জন্য মাহেন্দ্রক্ষণ মনে করেন। কিন্তু তাঁর জনবল এবং কাঠামো বিপ্লব কার্যকর করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাই তিনি জিয়াউর রহমানের বন্দিদশা এবং সৈনিকদের মধ্যে তাঁর সদ্ব্যবহারের সুনাম- ব্যবহার করার কৌশল গ্রহণ করেন।
জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার জন্য বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কতিপয় সৈনিককে পৃথকভাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। নির্দেশ ছিল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে ঢাকায় এনে জিম্মি হিসেবে ব্যবহার করা হবে। কিন্তু জিয়াকে মুক্ত করার জন্য বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোকেরা যখন অগ্রসর হয়, তখন উপস্থিত শত শত সৈনিক তাদের অনুগমন করে। সৈনিকরা জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে স্লোগান, আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে করতে তাকে কাঁধে বহন করে ২২ বেঙ্গল রেজিমেন্টে নিয়ে আসে। ফলে কর্নেল তাহেরের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়। কর্নেল তাহের এলিফ্যান্ট রোডের বাসার বারান্দায় অধীর আগ্রহে জিয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোকেরা যখন খালি হাতে এলিফ্যান্ট রোডে পৌঁছে তখন কর্নেল তাহের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের তিরস্কার করেন। পরে তারা আরেকবার চেষ্টা চালায় জিয়াউর রহমানকে নিয়ে আসার জন্য। ২২ বেঙ্গলে গিয়ে তারা জিয়াউর রহমানকে বলে যে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে আপনি মুক্ত হয়েছেন। চলুন তাঁর সঙ্গে দেখা করে আসবেন।
ধীরস্থির অথচ দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী জিয়াউর রহমান ততক্ষণে অনেক কিছু আঁচ করতে পেরেছেন। নাটকীয় কায়দায় তিনি বললেন, ‘কর্নেল তাহের তোমাদের নেতা এবং আমারও নেতা। একদিন তাকে এই সেনানিবাস ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। তাকে আবার এখানে নিয়ে আসো। তিনি এখান থেকেই বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবেন।’ পরে কর্নেল তাহের ২২ ইস্ট বেঙ্গলে চলে আসেন। এ সময় জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে, জিয়াকে ফুলের মালা পরিয়ে দিতে চাইলে জিয়া নিজে তা কর্নেল তাহেরের গলায় পরিয়ে দেন এবং বলেন এটা তাহের ভাইকেই শোভা পায়। কর্নেল তাহের ক্রমশ উপলব্ধি করতে থাকেন যে তাঁর পায়ের নিচের মাটি আর নেই। তাহেরের লোকেরা জিয়াউর রহমানকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার জন্য রেডিও অফিসে নিয়ে আসার জন্য আরেকবার শেষ চেষ্টা চালায়। ঢাকা ব্রিগেডের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি কর্নেল আমিনুল হক মতলব বুঝতে পেরে একটি রেকর্ডিং ইউনিট ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে আসার জন্য নির্দেশ করেন।
সর্বশেষ সমাপনী ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুবায়ের। তিনি তাঁর আত্মজীবনীমূলক ‘আমার জীবন আমার যুদ্ধ’ গ্রন্থে বলেন, ‘৭ নভেম্বর সন্ধায় রাষ্ট্রপতি সায়েম যখন বেতার ভাষণ দেন তখন জিয়াউর রহমান ও কর্নেল তাহের উভয়ই বেতার কেন্দ্র উপস্থিত ছিলেন। বেতারের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কামরায় বসে জিয়ার সঙ্গে তাহেরের কথাবার্তা হয়। তাহের জিয়াকে বলেন, বিপ্লবী সৈনিকদের কিছু দাবি দাবওয়া আছে। জিয়া যেন তা শোনেন এবং অবিলম্বে মেনে নেন। জিয়া স্বভাবসুলভ ধীরস্থিরভাবে বলেন, তিনি একটু পরে সৈনিকদের সঙ্গে দেখা করবেন। উল্লেখ্য যে, বেতারের স্টুডিওতে আসার আগেই রাষ্ট্রপতির ভাষণ রেকর্ড করা হয়েছিল, যাতে আলোচনার সময় তাহের বা জাসদের সশস্ত্র সৈনিকেরা কোনো শর্ত বা দাবি দাওয়া নিয়ে চাপ না দিতে পারে। জিয়ার এ কৌশল ম্যাজিকের মত কাজ করেছিল।’ “রাষ্ট্রপতির ভাষণ শেষ হওয়ার পর জিয়া খুব হালকা মেজাজে তাহেরকে নিয়ে পাশের ঘরে গেলেন। সেখানে জাসদপন্থী ২০-২৫ জন সশস্ত্র সৈনিক দাবি-দাওয়ার একটা লম্বা তালিকা নিয়ে অপেক্ষা করছিল।
জিয়া ঘরে ঢুকেই সৈনিকদের সঙ্গে হাত মেলালেন, কুশল জিজ্ঞাসা করলেন এবং ছোট একটা টেবিলের ওপর বসে খোশ মেজাজে হেসে হেসে তাদের সঙ্গে আলাপজুড়ে দিলেন। তিনি সৈনিকদের মধ্যে একজনকে দাবি-দাওয়া পড়ে শোনাতে বললেন। পড়া শেষ হলেই জিয়া বললেন, দাবিগুলি খুবই ন্যায্য এবং তা অবশ্যই পূরণ করা উচিত। দাবিগুলোর মধ্যে একটি ছিল জেলে আটক ও জাসদ নেতা জলিল ও রবের মুক্তি। জিয়া সঙ্গে সঙ্গে তাদের মুক্তির নির্দেশ দিলেন। এতে জাসদপন্থী সৈনিকদের মধ্যে যেটুকু উত্তেজনা অবশিষ্ট ছিল, তাও মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। বাকি দাবিগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিবেচনা করা হবে, এই আশ্বাস দিয়ে জিয়া অত্যন্ত আস্থার সঙ্গে সৈনিকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে গেলেন। (মহিউদ্দিন আহমেদ : ২০১৬ : ৭৬)।
জুবায়ের সিদ্দিকী লিখেছেন, ‘জেনারেল জিয়ার এই তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন কৌশলের কাছে কর্নেল তাহের একেবারে পর্যুদস্ত হয়ে হতাশ এবং অত্যন্ত নিরাশ হয়ে পড়লেন। আরো একটি সিগারেট ধরিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালে জমে ওঠা ফোঁটা ফোঁটা ঘাম মুছতে মুছতে পাশেই রাখা ক্র্যাচের মতো লাঠিটা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলেন। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে জাসদপন্থীদের সিপাহি বিপ্লবের ফলাফলকে নিজেদের পক্ষে নেওয়ার সর্বশেষ আশাটুকুও যেন কর্পূরের মতো উবে গেল। টু ফিল্ডের সৈনিকরা চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকল যতক্ষণ না লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে কর্নেল তাহের তাদের দৃষ্টি সীমানা ছাড়িয়ে গেলেন।’ এসব হতাশা ও ব্যর্থতার পরও তাহেরপন্থীরা চেষ্টা চালাতে থাকে। ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ তারা ভারতীয় হাই কমিশনার সমর সেনকে অপহরণের চেষ্টা করে। সেনা অফিসারদের হত্যা এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগে পরবর্তীকালে কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে সামরিক আদালতে অভিযোগ দায়ের করা হয়। তিনি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন।
রাজনৈতিক পরিস্থিতি
১৯৭৫ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বুঝতে হলে মধ্য আগস্ট-পরবর্তী ঘটনাবলিতে ফিরে যেতে হয়। সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বের কথা আগেই বলা হয়েছে। আর একটি অপ্রকাশিত দ্বন্দ্ব ছিল দলীয় বিরোধ। আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য ভারতের বিপরীতে প্রবাহিত হচ্ছিল। ভারত-বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমীকরণ পাক-মার্কিন বলয়কে শক্তিশালী করেছিল। ভারত সার্বক্ষণিকভাবে বাংলাদেশ পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছিল। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান সরাসরি ভারতীয় ইন্ধন ছিল এ রকম কোনো প্রামাণ্য দলিল নেই। ভারতের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা দ্বারাও এটা প্রমাণ করা সহজ হবে না। তবে এটা নিশ্চিত যে, খালেদ মোশাররফ একান্তই আওয়ামী পরিবারের সন্তান ছিলেন। তাঁর ভাই রাশেদ মোশাররফ আওয়ামী লীগের এমপি ছিল। খালেদ মনেপ্রাণে আওয়ামী লীগের ওপর যে খুশি ছিলেন, তা-ও নয়। তবে অভ্যুত্থান পরবর্তীকালে তিনি ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
৪ নভেম্বর যখন তাঁর বৃদ্ধা মাতা এবং ভাই বঙ্গবন্ধুর শোক প্রকাশে মিছিলে অংশগ্রহণ করেন তখনই খালেদ মোশাররফের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। খালেদ নিজে তাঁর মাকে তাঁর পরিণতির কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। যহোক, তখন বাংলাদেশে ভারত বিরোধী মনোভাব তুঙ্গে এবং ঘটনাচক্রে সেনাবাহিনীতে তাঁর অবস্থান আওয়ামী লীগ অনুকূলে হিসাব করা হয়। সেনানিবাসে সাধারণ সৈনিক থেকে কেএম শফিউল্লাহ পর্যন্ত অর্থাৎ সেনাপ্রধান পর্যন্ত একটি প্রচ্ছন্ন ভারতবিরোধী মনোভাব বর্তমান ছিল। ৪ নভেম্বরের মিছিল ভারতবিরোধী মনোভাবে ঘৃতাহুতির কাজ করে। সৈনিক থেকে সাধারণ মানুষ অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে শঙ্কিত হয়ে উঠে যে, আবারও ভারতমুখী সরকারের অধীন হতে হবে।
কর্নেল তাহের এই সস্তা ভারতবিরোধী সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগায় এবং তাদের কথিত বিপ্লবে অংশীদার হওয়ার জন্য সাধারণ সৈনিকদের আহ্বান জানায়। সাধারণ সৈনিকরা গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা এবং প্রচণ্ড ভারতবিরোধী মনোভাবের কারণে তাহের বাহিনী সঞ্চারিত বিপ্লবে যোগদান করে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ৬ নভেম্বর দিবাগত রাত ‘জিরো আওয়ারে’ গুলিবর্ষণের মাধ্যমে বিপ্লবের সূচনা করা হয়। শহরমুখী ট্রাকগুলোতে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার লোকদেরকে গাইড হিসেবে প্রদান করা হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার যে স্লোগান দিতে বারণ ছিল সেই স্লোগান মুখে মুখে প্রবলভাবে উচ্চারিত হয়। এই লেখক ব্যক্তিগতভাবে সেই মিছিলের ঘনঘটা এবং জনগণের উল্লাস প্রত্যক্ষ করেন। সৈনিকরা নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার স্লোগান দেয়। খন্দাকার মোশতাকের ছবি বহন করে তাকে প্রেসিডেন্ট পদে পুনঃঅধিষ্ঠানের আহ্বান জানায়। তবে মজার ব্যাপার এই যে খালেদ মোশাররফ নিজেই খন্দকার মোশতাকের পক্ষে দাঁড়ান। তিনি তাকে প্রেসিডেন্ট পদে অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। কিন্তু রাজনীতির চতুর্মুখী সমীকরণে খন্দকার মোশতাক আহমেদ পরাজিত হন।
আওয়ামী লীগের দৃঢ় সমর্থক কর্নেল সাফায়াত জামিল খন্দকার মোশতাককে অপমান অপদস্থ করেন। এবং পদত্যাগে সই করতে বাধ্য করেন। এভাবে যখন নাটকের শেষ অঙ্ক অভিনীত হচ্ছিল বঙ্গভবনে তখন সেনাবাহিনীতে ঘটছিল আরেক নাটকের শুরু। কর্নেল তাহের জিয়াউর রহমানের দিকে বন্দুকের নল ঘুরিয়ে ধরেন। জিয়াউর রহমানকে যেখানে নিয়ে যায় সৈনিকেরা সেখানেই দিবারাত কাটাতে থাকেন। অস্ত্র নিয়ে সেনাবাহিনী পরিত্যাগকারী সৈনিকদের ফিরে আসার জন্য আহ্বান জানান। পলায়নপর সেনা অফিসারদের সাহস ও সহমর্মিতা দিয়ে আবার একত্রিত করেন। তিনি তাদের এই বলে ভর্ৎসনা করেন যে, সৈনিকের জীবন তো মৃত্যুর জন্যই। ভীরু কাপুরুষের মতো পালিয়ে যেয়ো না। ঘুরে দাঁড়াও এবং দেশকে রক্ষা কর। জিয়াউর রহমানের সর্বাত্মক চেষ্টা, সাহস ও অনুপ্রেরণায় শিগগিরই সেনানিবাসগুলোতে ক্রমান্বয়ে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরে আসে। একজন মার্কিন সাংবাদিক মন্তব্য করেন যে, ‘It was Zia himself who Saved the Army from and impending doom.’ (Marcus franda:1982.258)
৭ নভেম্বর ’৭৫-পরবর্তী অধ্যায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রজীবনে অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখে।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।