আন্তর্জাতিক
সৌদি আরবে আসলে কী হচ্ছে?
রাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য এই যে, রাজতন্ত্রে সবকিছুর মালিক-মোখতার, রাজা-বাদশাহ, আমির-ওমরাহগণ। আর গণতন্ত্রে জনগণের অধিকার সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত। রাজতন্ত্রে জবাবদিহিতার কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রাসাদে কী ঘটছে তা জানা দুঃসাধ্য। সে জন্য রাজতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রকে আয়রন কার্টেন বা ‘লৌহ পর্দা’র সঙ্গে তুলনা করা হয়। সৌদি রাজতন্ত্রের লৌহ প্রাচীর অতিক্রম করে যেসব খবর বার্তা বাইরে প্রকাশিত হচ্ছে, তা রীতিমতো ভয়াবহ এবং রহস্যজনক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবহনের পুরস্কার স্বরূপ ক্ষমতাসীন সৌদি বংশ ‘জাজিরাতুল আরব’ আরব উপদ্বীপের অধিকাংশ অঞ্চলে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। তারা চাতুর্যের সঙ্গে ওয়াহাবি মতবাদে দীক্ষিত ‘আল ইখওয়নুল মুসলিমিন’: ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের মতো ইসলামী পুনরুজ্জীবনবাদী শক্তির সহায়তা লাভ করে। যতই রাজতন্ত্র শক্ত হয়েছে, ততই ইসলাম অনুসরণের প্রতিশ্রুতি থেকে তারা দূরে সরে এসেছে। এতদিন ধরে শুধু কথায় তুষ্ট করলেও মুরসির পতনের মধ্য দিয়ে তাদের আসল চেহারা বেরিয়ে আসে।
ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের সময়কার চুক্তি অনুযায়ী শাসনের বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ করবে সৌদ বংশ। আর ধর্মীয় বিষয়ের সব দায়দায়িত্ব পালন করবে ওয়াহাবি মতাদর্শের প্রতিভা আল ইখওয়ান। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী সৌদি রাজনীতির খলনায়ক তার তথাকথিত সংস্কারের বিরোধিতা করার আশঙ্কায় ধর্মীয় নেতাদের ওপর চড়াও হয়েছেন। যুবরাজদের গ্রেপ্তারের দুই এক মাস আগেই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। যুবরাজ বিন সালমানের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, সেখানে উত্তর কোরীয় অপ্রকৃতস্থ রাষ্ট্রনায়ক কিম জং উনের মতো আরেক ‘আধা রাষ্ট্রনায়কে’র আবির্ভাব ঘটেছে। তিনি সৌদি আরবকে আমেরিকা বানাতে চান।
গণ-অধিকার বা গণতন্ত্রের সপক্ষে তার কোনো পদক্ষেপ নেই কিন্তু তিনি আধুনিকায়নের কথা বলছেন। তিনি দেশটিকে মধ্যপন্থী ইসলামের দিকে নিয়ে যেতে চান। নারীরা গাড়ি চালানোর অনুমতি পেয়েছেন। তাঁরা এখন খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে যেতে পারবেন। অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই বিদেশে যেতে পারবেন। দেখেশুনে মনে হচ্ছে তার মাথায় কামাল আতাতুর্কের ভূত চেপেছে। নব্য তুরস্কের পিতা বলে কথিত মোস্তফা কামাল পাশা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় সালতানাতের পতনের জন্য রক্ষণশীল ইসলামকে দায়ী করেন। তিনি পোশাকে আশাকে, ব্যক্তিগত আচরণে এবং শাসনব্যবস্থায় পাশ্চাত্যকে অনুসরণ করেন। যদিও আজকের তুরস্ক ভিন্নরকম। যুবরাজ সালমান পাশ্চাত্যের বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য ‘ভিশন ২০৩০’ ঘোষণা করেছেন। তিনি অতিদ্রুততার সঙ্গে সৌদি সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে চান।
সৌদি আরবের রাজতন্ত্রের ধারাবাহিকতা অগ্রাহ্য করে বর্তমান বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ তাঁর নিজপুত্র মোহাম্মদ বিন সালমানকে তাঁর পরবর্তী উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন। অনুসৃত নিয়ম অনুযায়ী বাদশাহের ভাইদের মধ্যে একজন রাজবংশের জ্যেষ্ঠদের নিয়ে গঠিত ‘অভিবাবক পরিষদের’ গরিষ্ঠ সিদ্ধান্তে পরবর্তী বাদশাহ মনোনীত হবেন। কিন্তু সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে বৃদ্ধ বাদশাহ পূর্বঘোষিত ‘যুবরাজ’ মিতেব বিন আবদুল্লাহকে পদত্যাগে বাধ্য করে বর্তমান যুবরাজকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী তথা সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করলেন। ইতিমধ্যে কথিত হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রিন্স মনসুর বিন মুকরিম নিহত হয়েছেন। তিনি সাবেক যুবরাজ মুকরিম বিন আবদুল আজিজের ছেলে। একই সঙ্গে অন্য আরেকজন যুবরাজ গ্রেপ্তার এড়াতে গুলি করলে তাঁকে হত্যা করা হয়।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন বর্তমান যুবরাজ নিজ ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার জন্য ‘দুর্ঘটনা’ এবং ‘বন্দুকযুদ্ধে’র কৌশল নিয়েছেন। তথাকথিত দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে তিনি ১১ জন যুবরাজ, একজন শীর্ষ ব্যবসায়ী যুবরাজ আল ওয়াহিদ বিন তালালসহ বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আটক ও বরখাস্তকারীদের মধ্যে প্রয়াত বাদশাহ আবদুল্লাহর কয়েকজন সন্তান রয়েছে। মোহাম্মদ বিন সালমান যাদেরকে তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত মনে করেন না এ রকম রাজপরিবারভুক্ত ব্যক্তি, মন্ত্রী এমনকি বিশেষজ্ঞ মর্যাদায় দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেককে পদচ্যুত এবং গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দৃশ্যত সংস্কার ও দুর্নীতির নামে এসব গ্রেপ্তার করা হলেও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মনে করেন এটি হচ্ছে যুবরাজের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার পরিকল্পনার অংশ।
তৃতীয় বিশ্বের অন্য দেশের মতো দুর্নীতির অভিযোগ তুলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে চাচ্ছেন। তার এ পদক্ষেপ ভিন্নমত পোষণকারীদের দমন করার আরেকটি প্রক্রিয়া। এসব পদক্ষেপের কারণে সৌদি রাজতন্ত্রের অংশীদারিত্বের শাসন থেকে নিরঙ্কুশ ব্যক্তি শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বৃদ্ধ বাদশাহ অসুস্থ এবং অক্ষম। এ সুযোগে বর্তমান যুবরাজ নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ববাদী শাসন চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।
বর্তমান সৌদি আরবের রাজনৈতিক অবস্থা অস্থিরতায় পর্যবসিত হয়েছে। অর্থনীতিতে এতটাই ধস নেমেছে যে তাদের ঋণ গ্রহণ করতে হয়েছে। তেলের দাম পড়ে যাওয়ায় সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। এর মাঝে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বস্ত মিত্রতায় ফাটল ধরে। ওবামা প্রশাসনের আমলে দুটি কারণে সৌদি রাজতন্ত্রের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। প্রথমত, শিয়া ইরানের প্রতি সুন্নি সৌদি আরব চিরকালই বৈরী। ইরানের প্রতি ওবামার নমনীয় মনোভাব এবং পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে সৌদি আরব অসন্তোষ প্রকাশ করে। দ্বিতীয়ত ৯/১১ ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদানে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীরা মামলা করতে পারবেন- কংগ্রেসে এরকম সিদ্ধান্তে সৌদি রাজতন্ত্র অসন্তুষ্ট হয়।
সিরিয়া, ইয়েমেন এবং লেবানন পরিস্থিতি সৌদি আরবের জন্য সে সময় বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি করে। ঘরে বাইরে এ রকম অবস্থার দ্বারা একঘরে হয়ে পড়লে রাজতন্ত্র শঙ্কিত হয়। এ সময়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন যুবরাজ তাঁর চাতুর্য এবং কৌশল নিয়ে রাজতন্ত্রকে রক্ষায় এগিয়ে আসেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে এই যুবরাজ ওয়াশিংটনে যান এবং নিরঙ্কুশ আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দেন। মার্কিন করপোরেট পুঁজির প্রতিভূ ডোনাল্ড ট্রাম্প সে সুযোগ গ্রহণ করেন। মুসলমানদের বিরুদ্ধে কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি পোষণকারী এই প্রেসিডেন্ট প্রথম যে দেশটি সফর করেন, তা হচ্ছে সৌদি আরব। এতে সৌদি রাজতন্ত্র এবং উভয়ই লাভবান হন। ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবকে কেন্দ্র করে তাঁদের ক্রমহ্রাসমান প্রভাবকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ পান। তাঁর সমর-বাণিজ্য তথা অস্ত্র বিক্রির ব্যবসা জমে ওঠে। সৌদি আরব ইরানকে চ্যালেঞ্জ করার শক্তি অর্জন করে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী ইরান সৌদি আরবকে যুদ্ধাবস্থার মতো আচরণ করার জন্য দায়ী করেছে।
উল্লেখ্য যে, ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা রিয়াদের উপকণ্ঠে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছে। যদিও ক্ষেপণাস্ত্রটি সৌদিরা ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। বেশ কয়েকে বছর ধরে ইয়েমেনে যে গৃহযুদ্ধ চলছে, তাতে ইরান ও সৌদি আরব বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। এই গৃহযুদ্ধে সৌদি আরবের সরাসরি অংশগ্রহণের জন্য দায়ী বর্তমান ক্ষমতাসীন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। সর্বত্রই তাঁর আগ্রাসী নীতির পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি এই যুবরাজের চাপের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। নিজ দেশ ছেড়ে রিয়াদে বসে এ ঘোষণা দিতে তাঁকে বাধ্য করা হয় বলে মনে করা হচ্ছে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, কাতারের ওপর যে অবরোধ আরোপ করা হয়, তার নীলনকশাকারী হচ্ছেন এই যুবরাজ। ৩২ বছর বয়সী যুবরাজ বিন সালমানের কার্যক্রমে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল একরকম অকার্যকর হয়ে পড়েছে বলে বার্তা সংস্থার খবরে বলা হয়েছে। তাঁর একগুঁয়েমি তথা কঠোর মনোভাবের কারণে কোনো স্থিতিশীল সিদ্ধান্ত একরকম অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
যুবরাজের এসব কার্যাবলি লৌহ প্রাচীরের সীমানা অতিক্রম করে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মহলে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। সৌদি আরবের সাধারণ মানুষ এমনিতেই রাজনৈতিক অধিকারবঞ্চিত। তারা আরো বেশি নিপীড়ন, হয়রানি ও মিথ্যাচারের কবলে নিপতিত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমনকি আরো রক্ত ঝরার সম্ভাবনা বাতিল করা যায় না। ব্যাপক গ্রেপ্তারের ফলে রাজবংশে ভয়ভীতির খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা। অস্থিরতা থেকে অরাজকতা এবং অবশেষে ভ্রাতৃঘাতী রক্তারক্তির ধারণা অমূলক নয়। সৌদি আরব গোটা মুসলিম বিশ্বের কাছে একটি সম্মানীয় অবস্থানে রয়েছে। একজন যুবরাজের হটকারী সিদ্ধান্ত এবং অন্যায্য পদক্ষেপের কারণে সাধারণ মানুষ জিম্মি হতে পারে না। অবিলম্বে ইসলামের পবিত্র ভূমিতে শান্তির বারতা প্রতিষ্ঠিত হোক—এই আমাদের প্রার্থনা।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়