অভিমত
অনুভূতির বাড়াবাড়ি এবং ঘরপোড়া মানুষের দুঃখ
রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার ঠাকুরপাড়া গ্রামের নিজু বালা জানেন না, কেন তাঁর বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হলো। কেন তাঁর ঘর লুট করা হলো। কী তাঁর অপরাধ––তাঁকে এই প্রশ্নের জবাব কে দেবে?
কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের প্রতিবাদে শুক্রবার বিকেলে উত্তেজিত জনতা ওই গ্রামের বেশ কয়েকটি হিন্দু বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। তারা মহাসড়ক অবরোধ করে। পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।
স্থানীয় এক যুবক তাঁর ফেসবুকওয়ালে মহানবীকে (স.)কে অবমাননা করে কিছু লিখেছিলেন। তাই তাঁকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছিল স্থানীয়রা। কিন্তু প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় শুক্রবার জুমার নামাজের পর তারা রাস্তায় নামে।
তবে শুধু যে ধর্মীয় অনুভূতিই এইসব ঘটনার অনুঘটক তা নয়; বরং আরো অনেক কিছুই এই আগুনে ঘি ঢালে। যেমন :
১. যখনই কোথাও কেউ এরকম ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ ওঠে এবং যদি ওই আঘাতকারী লোকের ধর্মীয় পরিচয় হয় অমুসলিম, তখন ওই এলাকার হিন্দুদের জমি ও ঘরবাড়ি দখল করা বা তাদের সম্পত্তি দখলের বাসনা পুষে রাখেন যে স্থানীয় প্রভাবশালীরা, তাঁরা ওই ঘটনায় উসকানি দিয়ে থাকেন যাতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ এলাকা ছেড়ে চলে গেলে জায়গা-জমি দখল করতে পারেন।
২. রংপুরে শুক্রবারের ঘটনার সময়ও আমরা দেখেছি একজন লোক বলছিলেন যে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার সময় দুর্বৃত্তরা তাঁর নয়টি গরু নিয়ে গেছে। তার মানে কিছু লোক এরকম ঘটনার জন্যই অপেক্ষা করে, যেটিকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয়, ‘ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়া দেয়া’।
৩. প্রতিবেশীদের সঙ্গে জায়গা-জমি নিয়ে বিরোধ থাকে। এরকম ঘটনায় যখন কোনো একটি প্রান্তিক গোষ্ঠী বা যারা সংখ্যালঘু বলে চিহ্নিত যেমন হিন্দু, আদিবাসী ইত্যাদি––তারা যখন বিপদে পড়ে, তখন কিছু লোক ওই সময়ে সেই ব্যক্তিগত ক্ষোভ প্রসমনের একটা সুযোগ খোঁজে। তারা নিজেরা ঘরে আগুন না দিলেও দূর থেকে প্রতিপক্ষের এই ঘরপোড়া দেখে বিমল আনন্দ লাভ করে এবং তারা প্রতিবেশীর ঘর পুড়তে থাকলেও তা নেভানোর চেষ্টা করে না বা এরকম ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে টের পেয়েও চুপ থাকে।
৪. সরকারের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলো সব সময়ই চায় যে ছোটখাটো ঘটনাও বৃহৎ আকার ধারণ করুক। গঙ্গাচড়া উপজেলার ঘটনার রেশও সারা দেশে ছড়িয়ে যাক। কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতে সৃষ্ট জনক্ষোভ বা জনরোষ জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হোক––যাতে সরকার বিব্রত হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, যাতে পুলিশ গুলি ছুড়তে বাধ্য হয়, যাতে কিছু লোক নিহত হয়, যাতে দেশের বাইরে এরকম একটি বার্তা পৌঁছে দেওয়া যায় যে, দেশের অবস্থা ভালো না, সেখানে সংখ্যালঘুরা ভালো নেই ইত্যাদি।
৫. যখনই ওই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বুঝতে পারে যে কোনো একটা ইস্যু নিয়ে স্থানীয় জনগণের মধ্যে কিছু ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, তখন তারা ওই ক্ষোভ উসকে দেওয়ার জন্য নানা তরিকা অবলম্বন করে। এই লোকেদের প্ররোচনায় পবিত্র স্থান মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করা হয় এবং সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, কৃষক, জেলে বা পানের দোকানিও তখন রাস্তায় নেমে আসে। অথচ তারা জানে না, কিছুক্ষণ পরে তাদেরই হাতে পুড়বে তাদের এক প্রতিবেশীর ঘর, যার সঙ্গে সকালে হলেই তার দেখা হয়। এই অবিবেচক লোকগুলো বেমালুম ভুলে যায় যে, কোনো একটি গোষ্ঠী তাদের ধর্মীয় অনুভূতি ব্যবহার করে একটি খারাপ ও গর্হিত কাজে তাদেরই ব্যবহার করছে।
৬. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে কী লেখা হয় না হয়, সেখানে লিখিত কথাগুলোর কতটা সত্য বা বানানো, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি আদৌ সেটি লিখেছেন কি না, এসব যাচাই-বাছাই করার ক্ষমতা গঙ্গাচড়া বা পাগলাপীরের সাধারণ মানুষের থাকার কথা নয়।
৭. যখনই কারো বিরুদ্ধে এরকম ধর্ম অবমাননার অভিযোগ ওঠে এবং পুলিশ প্রশাসন যদি তৎক্ষণাৎ এটি তদন্ত করে এবং এই ইস্যুতে যাতে কোনো ধরনের জনরোষ তৈরি না হয়, সে ব্যাপারে তৎপর হয়, তাহলে এরকম ঘটনা ঘটে না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও এ বিষয়ে যদি মানুষকে শান্ত থাকার কথা বলেন বা তাদের এটি বোঝান যে, ফেসবুকে কে কী লিখল তা আমলে নেওয়ার প্রয়োজন নেই বরং এর চেয়ে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের সামনে রয়েছে, তখন সাধারণ মানুষ কিন্তু রাস্তায় নামার আগে দশবার ভাবে। কিন্তু রামু, নাসিরনগর কিংবা রংপুরের এসব নৃশংসতার আগে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তা থামানোর কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন বলে আমরা জানি না। বরং নাসিরনগরের ঘটনায় কোনো কোনো জনপ্রতিনিধির ইন্ধন ছিল বলেও খবর বেরিয়েছে। সুতরাং জনগণকে শান্ত রাখার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরাই যদি বিপরীত ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তাহলে এসব ঘটনা প্রতিরোধ করা অসম্ভব।
তবে এও ঠিক যে, কিছু লোক সচেতনভাবেই অন্যের ধর্ম বা তাদের অবতার কিংবা নবীর সমালোচনা করে, বিষোদ্গার করে আনন্দ পায়। কিছু লোক ধর্মের সমালোচনা করে নিজেকে অধিকতর আধুনিক প্রমাণের চেষ্টা করে। অথচ তিনি এটা উপলব্ধি করে না যে, তার এই স্ট্যাটাসে সেই ধর্মের মানুষ আহত হতে পারে। সুতরাং হিন্দুদের ঘর পুড়িয়ে দেওয়া বা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া যেমন অপরাধ, তেমনি অন্যের ধর্মের (যে ধর্মই হোক) সম্বন্ধে এমন কিছু বলা যাতে অন্যরা ক্ষুব্ধ হতে পারে, সেরকম কথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেন প্রকাশ করতে হবে?
এখন কেউ হয়তো বলবেন তাহলে কি ভিন্নমতের অবকাশ নেই? অবশ্যই আছে। কিন্তু এও মনে রাখতে হবে যে, আমাদের একে অপরের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোও প্রয়োজন।
সুতরাং ধর্মীয় অনুভূতির নামে বাড়াবাড়ির চর্চা যেমন বন্ধ করা জরুরি, তেমনি আমি সব বিষয় নিয়ে ফেসবুকে লিখব কি না, অন্যকে হেয় করব কি না বা কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করব কি না, সে বিষয়েও ভাবা দরকার।
আমীন আল রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক।