প্রতিক্রিয়া
অপুর সংসারে বিচ্ছেদের পাঁচালি
ঢাকাই সিনেমার সস্তা গল্পের মতোই বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে নায়ক শাকিব খান ও অপু বিশ্বাসের সংসারে। মানবিক বোধবুদ্ধি নয়, তাঁদের মনের নিয়ন্ত্রক হলো এক অদ্ভুত মোহ। তাঁরা চাইলেই বিয়ে করতে পারেন, তা বছরের পর বছর গোপন রাখতে পারেন। সন্তান জন্ম দিয়ে তার পিতৃত্ব অস্বীকার করতে পারেন। জীবনটাকেও ঢাকাই ছবির কেচ্ছাকাহিনীতে রূপান্তর করে নিয়েছেন। যে সন্তানটিকে তাঁরা পৃথিবীতে নিয়ে এসেছেন, তার সুখ-শান্তি কেড়ে নিয়ে নিরাশ্রয় করে দিতেও তাঁরা বিবেকের দংশন অনুভব করেন না।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, মুসলিম রীতি মেনে বিয়ের পর গৃহিণী হয়ে না থাকার কারণ দেখিয়ে অপু বিশ্বাসকে তালাকনামা পাঠিয়েছেন চিত্রনায়ক শাকিব খান। ২২ নভেম্বর অপুর ঠিকানায় পাঠানো তালাকনামায় শাকিব খান এ কারণ দেখিয়েছেন বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন তাঁর আইনজীবী শেখ সিরাজুল ইসলাম। অপু নাকি বিয়ের সময় কথা দিয়েছিলেন, বিয়ের পর মুসলিম রীতিনীতি মেনে চলবেন এবং সতী-সাধ্বী গৃহিণী হয়ে থাকবেন। কিন্তু অপু কথা রাখেননি। তাই শাকিবও নাকি আর বিয়ের চুক্তি মানতে পারছেন না।
এখন আমাদের সহজ সরল বক্তব্য হলো, ইসলামী রীতিনীতি মানবার দায় অপুর কেবল একা কেন? তিনি নারী বলে? তাও আবার ভিন্ন ধর্ম থেকে কনভার্টেড হয়ে আসা বলে! যদি বিয়ের সময় অপু অমন কথা দিয়ে থাকেন, সে কথা অপুর ভাঙা ঠিক হয়নি। আর যদি চুক্তিটা এমন হয়ে থাকে, অপু তুমি ঘরে থাকবে। কোনো পরপুরুষের চোখ কেন, পোশাক-আশাকের দিকেও তাকাতে পারবে না! কিন্তু আমি শাকিব নতুন নতুন নায়িকার সঙ্গে ঢাকাই মুভির ঝলমলে জগৎ দাবড়ে বেড়াব, তুমি অপু টুঁ শব্দটিও করতে পারবে না! তাহলে এটা হবে উত্তরাধুনিককালের হীনমানসিক জটিল পুরুষতান্ত্রিকতা।
শাকিব বিয়ে ভেঙে দেওয়ার প্রথম কারণ হিসেবে বলেছেন, অপু বিশ্বাস ধর্মীয় রীতিনীতি মানেন না এবং ঘরে থাকেন না। দ্বিতীয় অভিযোগটি আরো গুরুতর। তালাকনামায় শাকিব অভিযোগ তুলেছেন, পুত্রসন্তান জয়কে বাড়িতে গৃহকর্মীর সঙ্গে তালাবদ্ধ রেখে সম্প্রতি ছেলেবন্ধুকে নিয়ে দেশের বাইরে যান অপু। শাকিবের কথায় অপু যে ধর্মকর্ম মানেন না তা নয় শুধু, অপুর চারিত্রিক স্খলনও আবিষ্কার করা হয়েছে।
চারিত্রিক স্খলনের স্বরূপ সন্ধান করতে গেলে আমাদের কয়েক মাস পেছনে যেতে হবে। গত এপ্রিলে ঢাকাই ছবির নতুন নায়িকা শবনম বুবলীর সঙ্গে শাকিব ঘরোয়া পরিবেশে একটি ছবি তোলেন। ছবিটিতে ‘ফ্যামিলি টাইম’ ক্যাপশন লিখে নিজের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রকাশ করেন বুবলী। এর পরই অপু বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে শাকিব খানের। ছবিটি প্রকাশের পর পরই গণমাধ্যমে দীর্ঘদিন গোপনে থাকা বিয়ে ও সন্তানের বিষয়টি খোলাসা করেন অপু। সেটা ছিল আরেক মেলোড্রামা। ২০০৮ সালে এই তারকা দম্পতি বিয়ে করলেও আট বছর ধরে বিয়ের কথা গোপন রাখেন তাঁরা। এ বছর ১০ এপ্রিল হঠাৎ অপু বিশ্বাস তাঁর ছয় মাসের শিশুসন্তান আব্রাম জয়কে নিয়ে টেলিভিশন লাইভে বিয়ের কথা ফাঁস করে দিলে ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরি হয়। অপু বিশ্বাস চরম অবিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়ে শাকিবের হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিলে বিরাট বিপাকে পড়েন শাকিব খান। উন্মত্ত হয়ে যান শাকিব। প্রথমে বিয়ে ও বাচ্চার কথা অস্বীকার করে বসেন। পরে বলেন বাচ্চাটা তাঁরই, তাই বাচ্চার দায়িত্ব নেবেন; কিন্তু অপু বিশ্বাসকে স্ত্রী বলে মানবেন না। ওই সময়টাতে শাকিবের হালের নায়িকা বুবলী মানসিক বিপর্যয় নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। শাকিবকে সেখানে গিয়ে দেখভাল করতেও দেখা যায়। এর পরও অবশ্য শাকিব স্ত্রীর সঙ্গে হাসিমুখে ছবি তুলে মিডিয়াকে দেখান। কিন্তু শাকিব-অপুর সংসার যে টিকবে না, এটা অনেকেই সন্দেহ করেছিল সেই সময়।
ধর্ম মানার দায় অপুর একার হতে যাবে? চরিত্র ঠিক রাখার দায় সেটাও অপুর? আবার বিয়েটা আট বছর ধরে গোপন রাখতে হবে, সে দায়িত্বও অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে পালন করে যেতে হবে ওই অপুরই? এমন ঘটনাকে নারীর প্রতি পুরুষের মানবেতর দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবে বিবেচনা করা যেত। কিন্তু অপু, বুবলী আর শাকিবের ত্রিমাত্রিক ঘটনায় নিরঙ্কুশভাবে তা বলবার উপায় নেই। অপু-শাকিবের বিচ্ছেদ উপাখ্যানে নারীকেই নারীর শত্রু করে তোলা হয়েছে। আজকে যে আব্রামের মা অপুকে শাকিবের ভালো লাগছে না, তার দায় অনেকটাই গিয়ে চাপছে বুবলীর ওপর। ঘটনায় যদি বুবলীর দায় না থাকে, তবে দুজন নারীকে অপমান করবার চাপ শাকিব খান নিতে পারবেন কি? শাকিব যত বড় নায়কই হন, বাংলা সিনেমাকে যা কিছুই দিক না কেন, নারী কেলেঙ্কারিতে নিজেকে অসম্মানিত করে আমজনতার ভালোবাসা বা সমর্থন আপনি পাবেন না। যারা আপনাদের মতো মানুষকে তারকা ভেবে মাথায় তুলে রাখে, সেই তারাই আপনাকে মাটিতে ফেলে দিতে পারে।
আসলে অপু, শাকিব আর বুবলী আখ্যানের মূল ভিলেন পুরুষতান্ত্রিকতার লক্ষ বছরের প্রতিভূ ওই শাকিব খানই। শাকিব তাঁর ব্যক্তিগত লাভালাভ অথবা মোহগ্রস্ততাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে প্রকাশ্যে অপু ও বুবলী নামের দুই নারীকে অসম্মান করে যাচ্ছেন। আর এই দুই নারীরও এমন সবল সক্ষমতা বা আত্মবিশ্বাস নেই বা ছিল না যে, তাঁরা চাইলে শাকিবের বলয় থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে স্বাধীন জীবনযাপন করে যাবেন। তবে এ দুই নারীর চেয়েও বড় বিপাক এখন মাত্র বছরোর্ধ শিশু আব্রামের। বাবা-মায়ের সাংসারিক স্বর্গীয় বন্ধন থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে তাকে। শিশুটি বড় হতে হতেই জানবে, তার মা যেখানে থাকেন, সেখানে বাবা থাকেন না। অথবা কে জানে, এমন ঘটনা ঘটবে না যে নিজের বাবা-মা ছাড়াও আরো দুজন নতুন মানুষকে বাবা অথবা মা বলে পরিচয় দিতে হচ্ছে। নিজের সন্তানের এমন দুর্ভাগ্যের ট্র্যাজেডি যাঁরা আপন হাতে রচনা করতে পারেন, তাঁদের কাছে অন্যদের আর কি প্রাপ্যতার আশা থাকে?
শাকিব খান অপুকে তালাকনামা পাঠিয়েছেন। এখন নিয়ম অনুযায়ী ঢাকা সিটি করপোরেশনের সালিশি পরিষদ দুজনকে ডেকে নিয়ে বসবে যেন সংসারটি ভেঙে না যায়। যদি শাকিব খান তারপরও মনে করেন, এটাই তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, তবে ৯০ দিন পর তালাকনামা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হয়ে যাবে। এরপর আব্রাম একটু একটু করে জানবে, তার জন্মদাতা মা-বাবা দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা। এমন একটা পরিস্থিতিতে অপু বিশ্বাস চাইলেও আর শাকিবকে তাঁর সংসারে ফেরাতে পারবেন বলে মনে হয় না। আত্মমর্যাদা থাকলে অপু তেমনটা চাইবেনও না। কিন্তু মহাকাল নিশ্চয় সাক্ষী হয়ে থাকবে যে শাকিব খান আট বছর ধরে এক নারীর সঙ্গে ঘর করে সন্তান উপহার দিয়ে, অবলীলায় সেই সংসার ভেঙে দিতে পারেন। সেই পুরুষের জীবনে অন্য যে নারী আসবে, তাঁকেও বিচ্ছেদ উপহার দিতে পারেন। বাংলা চলচ্চিত্র পরিবার নয় কেবল, কোনো মানবিক জগতেই এমনধারার নাটুকে চরিত্ররা না নামুক। পারিবারিক বন্ধন না হারাক আব্রামের মতো সুন্দর শিশুরা। মানবিক বিশ্বে শিল্প এবং শিল্পীরা হোক সত্য ও সুন্দরের একনিষ্ঠ পূজারি।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।