জেরুজালেম ইস্যু
জেরুজালেম কি ইসরায়েলের রাজধানী?
মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিনি আরব ভূমিতে জোরজবর দস্তিমূলক ভাবে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটেন তথা পাশ্চাত্যই দায়ী। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোর এর ঘোষণার মাধ্যমে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ১৯১৯ সালে মুসলিম বিশ্বের শক্তিধর সাম্ররাজ্য তুর্কি উসমানীয় সালতানাতের চরম পরাজয় ঘটে। তখন থেকে ব্রিটিশ ও ফরাসি সহযোগিতায় ফিলিস্তিনে পরিকল্পিতভাবে গোটা পৃথিবী থেকে ইহুদিরা বসতি স্থাপন করতে থাকে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে তা ষোল কলায় পূর্ণ হয়। ১৯৪৮ সালে এসব ইহুদিরা যখন স্বাধীন সার্বভৌম ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয় তখন পাশ্চাত্যের নতুন পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে সর্বাত্মক সহায়তা দেয়। সেই থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে এমনভাবে ইসরায়েলকে সমর্থন দেয় যে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকগণ ইসরায়েলকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একান্নতম স্টেট বা প্রদেশ বলে রসিকতা করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হিটলার কর্তৃক ইহুদি নিধন ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সহানুভূতিশীল ভিত্তি তৈরি করে। তখন অবশ্য আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে অথবা মালাগাসী দ্বীপে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেওয়া হলেও ইহুদিরা তাদের ঐতিহাসিক বাসভূমি ফিলিস্তিনে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জেদ ধরে। পাশ্চাত্য শক্তিগুলো সবরকম সহযোগিতা দিয়ে ইহুদি রাষ্ট্রের পূর্ণতা দেয়। আরবদের তথাকথিত বন্ধু সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নও শক্তভাবে ইহুদি রাষ্ট্রের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে।
ফিলিস্তিনের চারিদিকের পরস্পর বিবদমান, দুর্বল গণবিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রসমূহ- মিশর, সিরিয়া, জর্ডান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও চরম পরাজয় ইসরায়েল রাষ্ট্রের সীমানাই কেবল সম্প্রসারিত হয়। ১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭ এবং ১৯৭৩ প্রায় প্রতিটি যুদ্ধে আরব শক্তি পরাজিত হয়। ১৯৭৭ সালে ক্যাম্পডেভিড চুক্তির মাধ্যমে আবর বিশ্বের প্রধান শক্তি মিসর ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদান করে। একই পথ ধরে জর্ডান। এরপর ১৯৭৭ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরবদের প্রতি মৌখিক সমর্থন ও সৌজন্যের কূটনীতি অব্যাহত রাখে।
প্রেসিডেন্ট ওবামা কায়রো ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের প্রতি অব্যাহত অবমাননার কথা স্বীকার করেন। সেই দৃশ্যমান মৌখিক ও কূটনৈতিক পর্যায়ের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে গত ৬ ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৬৭ সালের জুন যুদ্ধের পর গোটা জেরুজালেম ইহুদিদের হাতে চলে যায়। জেরুজালেম মুসলমান, খ্রিস্টান এবং ইহুদি-এই তিন ধর্মের পবিত্র স্থান হওয়ায় জেরুজালেমের মর্যাদা ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নানা ধরনের আন্তর্জাতিক দেন দরবার হয়। প্রতিটি ধর্মের পবিত্র স্থানসমূহ স্ব স্ব কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা হয়ে আসছে। কিন্তু মূল অধিকার ইসরায়েলের হাতেই থেকে যায়। ইসরায়েল সব রকমের আন্তর্জাতিক সমঝোতা ও আইন অগ্রাহ্য করে একপর্যায়ে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করে। তারা তেলাবিব থেকে সদর দপ্তরসমূহ জেরুজালেমে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেয় কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তা স্থগিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত ও সমালোচিত হয়।
ঐ সময়ে কোনো সুনির্দিষ্ট সুপারিশ গ্রহণ না করে মার্কিন সিনেট প্রেসিডেন্টকে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অর্পন করে। এত দিন ধরে অনুসৃত সৌজন্যের কূটনীতির কারণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কোনো সিদ্ধান্ত না দিলেও এবার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর অনুসৃত মুসলিম বিদ্বেষী নীতির কারণে ইসরায়েলের অবৈধ সিদ্ধান্তকে বৈধতা দিলেন। তিনি মার্কিন দূতাবাস তেলাবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করারও নির্দেশ দিয়েছেন। এই ঘোষণায় সারা বিশ্বে মার্কিনবিরোধী বিক্ষোভ ও সমালোচনা প্রবল হয়ে ওঠেছে।
আকস্মিকভাবে ট্রাম্পের এই ঘোষণা এলেও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট যথার্থ হোম ওয়ার্ক করেই ঘোষণাটি প্রদান করলেন। প্রথমত, নির্বাচনী প্রচারণার সময় মুসলিমবিরোধী কঠোর মনোভাব প্রকাশ করে তিনি মার্কিন মনোজগতে আলোড়ন তোলেন। দ্বিতীয়ত, ছয়টি মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে অভিবাসী আইন প্রয়োগ করে তিনি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে অগ্রসর হন। ওই সময় মার্কিন তাবেদার মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ ট্রাম্পের ওই অন্যায় সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায়। তৃতীয়ত, ট্রাম্প সৌদি আরব সফরের মাধ্যমে ইসলামের তথাকথিত প্রধান মোড়লকে তার একান্ত তাবেদার বানাতে সক্ষম হন। চতুর্থত, নতুন সৌদি যুবরাজ যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিশ্বস্ত অনুচরে পরিণত হয়েছেন- সেখান থেকে তেমন উচ্চবাচ্য হবে না বলেই হয়তো তাঁর বিশ্বাস। পঞ্চমত, বার্তা সংস্থা অনেকবার সৌদি ইসরায়েল গোপন সম্পর্কের কথা প্রকাশ করেছে। ইসরাইলিমন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রকারান্তরে সৌদিদের সাথে বিশেষ সম্পর্কের কথা স্বীকার করছেন। সৌদিদের কাছে ইসলামের তৃতীয় পবিত্র ভূমি জেরুজালেমের চেয়ে নিশ্চয়ই তাদের রাজতন্ত্র অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে জনসংখ্যা বহুল এবং সামরিক শক্তিতে বলিয়ান মিসরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বস্ত তাবেদার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। সেখানে এখন ইসরায়েলবিরোধী প্রধান শক্তি ইসলামী ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে নির্মূল অভিযান চলছে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করেন যে, মার্কিন-ইসরায়েলের যৌথ ষড়যন্ত্রে মিসরে মুরসি সরকারের পতন ঘটে।
ট্রাম্পের ব্যাপক বিতর্কিত ঘোষণার পর ফিলিস্তিনসহ সারাবিশ্বে তীব্র বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। বিজ্ঞ কূটনীতিকরা মনে করেন ট্রাম্পের এই ঘোষণা কয়েক দশকের পররাষ্ট্র নীতিকে নসাৎ করে দিয়েছে। ট্রাম্পের এই ঘোষণার ফলে মার্কিনবিরোধী সন্ত্রাসী তৎপরতা বৃদ্ধি পাবে বলে তিউনিসীয়ার আদর্শিক নেতা রশিদ ঘানুসি মন্তব্য করেছেন। এই ঘোষণায় মার্কিন মিত্র ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি সহমত পোষণ করেনি। নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি অধিবেশন আহ্বান করা হয়েছে। মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন- ওআইসি ১৩ ডিসেম্বর বৈঠক আহ্বান করেছে। আরবলিগ বৈঠকরত রয়েছে। এসব সম্মেলন ও বৈঠকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত নীতির তীব্র প্রতিবাদ জানানো হবে। ট্রাম্পের ঘোষণার পর পরই জরুরি বৈঠকের ডাক দিয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস ট্রাম্পের ঘোষণার সময়কে ‘বিরাট দুশ্চিন্তার মুহূর্ত’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, ওই অঞ্চলের শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ আরো কঠিন হয়ে পড়বে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম্প তার দেশের ইহুদি লবি এবং বিদেশে ইহুদিবাদের বন্ধুদের খুশি করার জন্য যে ঘোষণা দিয়েছেন তা আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো সর্বনাশা সিদ্ধান্ত। প্রকাশিত সংবাদ মোতাবেক মার্কিন বুরুক্রেসি এবং গণমাধ্যম তার এ অন্যায়কে মেনে নেয়নি। এমনিতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ ট্রাম্পের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে আছে, এ সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া মার্কিন নাগরিকদেরও আন্দোলন উন্মুখ করে তুলতে সহায়তা করবে। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসনের যে প্রাথমিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তা এ ঘটনার মাধ্যমে আরো যৌক্তিকতা পাবে। সুতরাং ঘরে এবং বাইরে ক্রমশ শত্রুতা না বাড়িয়ে ট্রাম্পের উচিত ঘোষিত বিষয়টি নিয়ে সেকেন্ড থট দেওয়া। নিজের নাক কেটে কেউ পরের যাত্রা ভঙ্গ করতে পারে না।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়