অভিমত
কেমন আছেন ছবির এই মানুষগুলো?
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ও তার পরবর্তী সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল কিছু ছবি। ছবিতে থাকা সেই মানুষগুলো এখন কোথায় আছেন, কি করেন তার কোনো হুদিস নেই আমাদের কাছে। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও আমরা খোঁজে ফিরি ছবিতে থাকা সেই সুবর্ণ মানুষগুলোর গল্প। আমাদের জানতে ইচ্ছে হয়, সেই মানুষগুলো এখন কোথায় আছেন, কি করছেন?
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নিজেদের বাঁচার অধিকার নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করেন দেশের সাধারণ জনগণ। বিক্ষোভ মিছিল করেন রাজপথে অনেকে। ছবিতে বিক্ষোভ মিছিলের সামনে দেখা যায় অনেককে । কিন্তু এবা এখন কোথায় আছে, কি করছে, আদৌ বেঁচে আছে কি না তা আমাদের জানা নেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার সম্পর্কে আমরা কখনো কোনো খোঁজই নিলাম না।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সকলের স্লোগান ছিল ‘জয় বাংলা’। দেশের খেটে খাওয়া নারী পুরুষরাও পথে পথে সেই স্লোগান দিতেন। মূলত মুক্তিযুদ্ধের বড় একটা অংশজুড়ে ছিল তাদের অংশগ্রহণ। ছবিটিতে দেখা যায় তিনজন পুরুষের মাঝে একজন নারী রয়েছেন। এই তিন মানুষ সম্পর্কে আমাদের নেই কোনো তথ্য।
দেশকে শত্রু মুক্ত করতে ছেলেদের পাশাপাশি অনেক নারীরাও হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। তাদের হাতে ও ঘাড়ে সব সময় ছিল এই অস্ত্র। পরনে সাদা পোশাক। আমাদের এই মা ও বোনেরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছে কতই না নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো এখনো বেঁচে আছেন, আর অনেকেই হয়তো বেঁচে নেই। কিন্তু যারা বেঁচে আছেন তারা এখন কোথায়?
কখনো খালি গায়ে, স্যান্ডো গেঞ্জি পরে কাঁধে রাইফেল নিয়ে শত্রু হননের জন্য বের হয়েছিলেন এ দেশের তরুণ সুর্য্য সন্তানরা। রেলরাইনের পথ ধরে হাতে রেডিও নিয়ে ছুটেছেন মাইলের পর মাইল। কিন্তু এই পথ চলার শেষ হয়েছিল কি না, তারা এখন কোথায় আছেন, কী করেন তা জানতে বড়ই ইচ্ছে হয়।
পরনে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি। কাঁধে রাইফেল। যুদ্ধ করছেন দেশকে স্বাধীন করার জন্য। এই ছবিটি সেই মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে আসছে। বর্তমান সময়ে অনলাইন ঘাঁটলেই ছবিটি অতি সহজে পাওয়া যায়। কিন্তু পাওয়া যায় না সেই ছবির মানুষগুলোর গল্প। আমরা জানি না তাদের কোনো অবস্থান। এই তাজা তরুণরা শত্রু হনন করতে গিয়ে মায়ের কোলো ফিরে এসেছে কি না, তাও নেই আমাদের জানা।
একজন মা দাঁড়িয়ে আছেন অপলক দৃষ্টিতে। তাঁর চোখে-মুখে শুধু করুণার ছাউনি। কাঁধে ২-১ বছরের একটি ছোট শিশু। আর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে খালি গায়ে তিন-চার বছরের আরেকটি ছোট শিশু। হয়তো তাদের বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে পাকিস্তানি মিলিটারিরা। নয়তো পাকিস্তানিদের হাতে অপাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তারা। কিংবা তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল নরপশুরা। কিন্তু ছবির ওই ছোট দুটি শিশু আর মা এখন কোথায় আছেন, কী করেন, তা কি আমরা জানি?
মাথায় কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে সামনের হেঁটে চলছেন একজন বৃদ্ধ বাবা। আর পেছনে পেছনে চলছেন একজন বৃদ্ধা মা। হয়তো তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন, অথবা নিজ এলাকা ছেড়ে জীবন বাঁচার তাগিতে অন্য এলাকায় আশ্রয় নেওয়ার জন্য যাচ্ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশ গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের বেশির ভাগ ছিলেন তরুণ। এই তরুণরা পানি-কাঁদা অপেক্ষা করে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। ছবিতে একদল তরুণকে দেখা যায়, যারা রাইফেল কাঁথে নিয়ে জলাশয় পার হচ্ছিলেন। এই তরুণদের মধ্যে কতজন বেঁচে আছেন, কতজন মায়ের কোলে ফিরে ঘরে বউ নিয়ে এসে সংসার করছেন তা আমরা জানি না। তাঁদের ঘিরে শতশত প্রশ্ন আজ মাথার ভেতর ঘুরপাক খায়।
ছবিতে ঘোমটা পরে একজন মা। হাতে তাঁর রাইফেল ও কলস। পাশে তাঁর তিন সন্তান। একজন কন্যা সন্তান অন্য একজন শিশু সন্তানকে কাঁধে করে নিয়ে আছেন। তাঁর পাশে আরেকটি ছেলে সন্তান। আজো কি তারা বেঁচে আছেন? ছোট শিশুটি কত বড় হয়েছে, এখন সে কী করে?
মুক্তিযুদ্ধের সময় শত্রুদের হনন করে এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এভাবেই অস্ত্র উঁচিয়ে বিজয় আনন্দ করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। এই মানুষগুলো কতদিন অভাবে দিন যাপন করেছে, কতটা অসম্মানে কেঁদেছে তা আমরা জানি না। ছবির এই মানুষদের স্বাধীন দেশে কেউ আর খোঁজল না, জানা গেল না কি তাদের নাম, বাড়ি বা কোথায়, এখন তারা কী করেন, কোথায় আছেন?
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও প্রতিনিধি, বাংলাদেশ প্রতিদিন