বিজয় দিবসের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
গোটা জাতি আজ বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে গৌরবময় ৪৭তম বিজয় দিবস উদযাপন করছে। বাংলাদেশের জনগণ নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী এবং বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের পর বিজয় অর্জন করে। ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসের যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ বিষর্জন দেয়। প্রায় এক কোটি মানুষ শরণার্থী হিসেবে ভারতে অশ্রয় নেয়। দখলদার বাহিনী অসংখ্য বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। আবার লুটতরাজ করে। মানুষকে নিপীড়ন-নির্যাতন করে। অসংখ্য মানুষকে কারারুদ্ধ করে। এসবের পরে মজলুম মানুষ যখন জুলুমকারিদের ওপর বিজয় অর্জন করে, তখন সে দিনটি গোটা জাতির জন্য এক বড় ধরনের অর্জন বলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিজয় যেহেতু আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছে সুতরাং এ দিনটি চিরকালই বাংলাদেশের ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট স্বাধীনতার দুটো অর্থ করে ছিলেন। প্রথমত, ক্ষুধা থেকে মুক্তি বা স্বাধীনতা। দ্বিতীয়ত, ভীতি থেকে মুক্তি বা স্বাধীনতা। ক্ষুধা থেকে মুক্তির অর্থ মৌলিক মানবিক প্রয়োজনের স্বীকৃতি। গোটা পৃথিবী আজ মানুষের সেই- খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার স্বধীনতা মোটামুটি নিশ্চিত করেছে। স্বাধীনতার প্রায় ৪৬বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর আমাদের জনগণ কি সেই মৌলিক স্বাধীনতা ভোগ করছে? আজও মানুষ ক্ষুধার জন্য প্রাণপাত করছে। এ রকম অসংখ্য খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। একটি দেশের জাতীয় নিরাপত্তার বড় দিক হলো সব নাগরিকের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এখানে খাদ্যের সুষম বণ্টন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্য যদি স্বাধীনতার একটি পূর্বশর্ত হয় তাহলে এখন সহজে বলা যায়, বাংলাদেশের মানুষ কতটা খাদ্য নিরাপত্তা তথা খদ্যের স্বাধীনতা ভোগ করছে। বিজয় বাংলাদেশের মানুষের জন্য জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য শর্ত কি পূরণ করতে পেরেছে?
স্বাধীনতার দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে- ভীতিমুক্ত পরিবেশ। ভীতিমুক্ত পরিবেশ হতে হলে ভূখণ্ডটি স্বাধীন হতে হবে। বাংলাদেশ প্রায় ২০০ বছর ব্রিটিশদের দখলে ছিল। ১৯৪৭ সালে এই উপমহাদেশ ব্রিটিশদের দখলমুক্ত হয়। আরো ২৩ বছর পাকিস্তানের দখলে থাকে বাংলাদেশ। এই উভয় দখলদারদের আমলে বাংলাদেশ ভীতিমুক্ত ছিল না। রাজনৈতিক নিপীড়ন, নির্যাতন, জেল-জুলুম অব্যাহত ছিল। ৪৬ বছর ধরে আমরা স্বাধীন হয়েছি। স্বাধীনতার অর্থ যদি হয়- ভীতি মুক্ত পরিবেশ তা হলে আমরা কি সেই ভীতি মুক্ত পরিবেশে বসবাস করছি?
১৯৭১ সালের পর একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অস্বাভাবিক অবস্থা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু যা অস্বাভাবিক ছিল তা ছিল ক্রম সংকোচিত স্বাধীনতা। বাংলাদেশে একটি বিরল ঘটনা যে, সামরিক সরকার গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়। রাজনৈতিক নেতারা যে বহুদলীয় ব্যবস্থা বাতিল করেছিলেন সামরিক নেতা তা ফিরিয়ে দেন। ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গণতান্ত্রিক মানসিকতা অথবা বাংদেশের মানুষের চির প্রবহমান গণতন্ত্রের প্রত্যাশা এর কারণ হতে পারে। সে যাই হোক সামরিক বাহিনীর আর একটি বিপথগামী অংশ জনপ্রিয় প্রেসিডেন্টকে হত্যা করে। ক্ষমতা লোভী রাজনীতিকদের ষড়যন্ত্রে আর একবার সামরিক শাসন জারি করা হয়। গণতন্ত্রের জন্য মানুষের প্রত্যাশা আর একবার ব্যাহত হয়। ১৯৯০ সালে একটি গণআন্দোলনে মানুষের গণতন্ত্রের প্রত্যাশা আবার পূর্ণতা পায়।
১৯৭১ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক শাসনে বর্ণনা দেখে আমরা বুঝতে পরব যে, বিজয়ের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি আমাদের কতটা পূর্ণ হয়েছে আর কতটা পূর্ণ হয়নি। এ ক্ষেত্রে প্রথমে আমরা রুজভেল্ট কথিত স্বাধীনতার দুটো মানদণ্ড- ক্ষুধা ও ভীতি দ্বারা বিগত ৪৬ বছর পর্যালোচনা করেছি। আমদের গরিব সাধারণ জনগণ এখনো তাদের বেঁচে থাকার পাঁচটি মৌলিক সুবিধা পায়নি। অপরদিকে যদি ভীতিমুক্ত শর্ত দ্বারা আমাদের বিগত শাসন কালগুলোকে বিশ্লেষণ করি তাহলে আমাদের অবশ্যই হতাশ হতে হবে। আমরা দেখব ‘ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে আমাদের স্বাধীনতার পৃথিবী।’ প্রবীণরা বলেন ‘যায় দিন ভালো যায়, আসে দিন খারাপ হয়।’বিজয় দিবসের সুপ্রভাতে আমাদের প্রার্থনা- ‘আসবে দেশে শুভ দিন, ভীতি শোষণ হবে লীন।’
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়