রসিক নির্বাচন
রাজনৈতিক সমীকরণ কী বলে?
রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয় রাজনীতি কিংবা দলীয় প্রতীকের চেয়ে বড় হয়ে উঠতে পারে স্থানীয় রাজনীতি ও ব্যক্তি ইমেজ। নতুন ভোটার কিংবা ৬৬ হাজার সংখ্যালঘু ভোটারও পাল্টে দিতে পারে যে কোনো সমীকরণ। অবশ্য শেষ সময়েও আছে আচরণবিধি লঙ্ঘনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ এবং নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়া নিয়ে কোনো কোনো প্রার্থী বা দলের আশঙ্কা। জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এই রসিক নির্বাচনকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো।
ভোটগ্রহণের ৩২ ঘণ্টা আগে মঙ্গলবার রাত ১২টার পর থেকে সব ধরনের প্রচার-প্রচারণা বন্ধ। নির্বাচনের শেষ সময়ে এসে রংপুর চষে বেড়িয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতারা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপির প্রার্থী কাওসার জামান বাবলার প্রচার প্রচারণায় অংশ নিয়ে বলেছেন, বর্তমান সরকার ও কমিশনের অধীনে সুষ্ঠ নির্বাচন সম্ভব নয়। তবে ভোটারদের তিনি অধিকার আদায় করে নেওয়ার আহ্বান জানান।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ অবশ্য বলেছেন, রংপুরে ভোট কারচুপির কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না। জাতীয় পার্টির প্রার্থী পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিয়ে আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ ওঠায় স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গাকে শোকজ করে নির্বাচন কমিশন। জরিমানা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী সরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুও। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাসহ কয়েকজন কমিশনার কয়েকবার রংপুর সফর করে সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দিয়েছেন। সুজন, দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠন ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণও এই নির্বাচন গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে।
গত নির্বাচনে জয়লাভ করার পর ‘মফিজ’ নামটি ঘোচানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন সদ্য সাবেক মেয়র শরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু। তবে, রংপুরের উন্নয়ন নিয়ে হতাশা আছে ভোটারদের মধ্যে। এবার অবশ্য তিনি নৌকার প্রতীক নিয়ে লড়ে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে চান। এক্ষেত্রে, নিজের জনপ্রিয়তা ও দলীয় প্রতীক দুটোই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছেন এই প্রবীণ নেতা। অবশ্য ঝন্টুও একসময় জাতীয় পার্টির রাজনীতি করতেন।
নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচনের আন্দোলনের অংশ হিসেবে এই নির্বাচনকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে বিএনপি। নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ার আশঙ্কা করলেও নিজের ব্যাপারে আশাবাদী বিএনপির প্রার্থী কাওসার জামান বাবলা।
একসময় জাতীয় পার্টির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল রংপুর। এবার সুযোগ আবার তা পুনরুদ্ধারের। ২০১২ সালের নির্বাচনে ঝন্টু এক লাখ ছয় হাজার ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা পান ৭৮ হাজার ভোট। আর জাতীয় পার্টির আরেক নেতা আবদুর রউফ মানিক ৩৭ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। প্রার্থিতার লড়াইয়ে এবার মানিক না থাকলেও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের ভাতিজা মকবুল শাহরিয়ার আসিফ মাঠে আছেন। তবে এ নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত নন দলটির মনোনীত প্রার্থী মোস্তফা।
রংপুর পৌরসভার আয়তন ছিল মাত্র ৫২ বর্গকিলোমিটার। রংপুর সদরের ১০টি, কাউনিয়া, সারাই ও পীরগাছার কল্যাণীসহ ১২টি ইউনিয়নের ১১২টি মৌজাকে সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রায় দেড়শ বছরের পুরোনো পৌরসভাকে বিলুপ্ত করে ২০১২ সালে রংপুর সিটি করপোরেশন ২০ ডিসেম্বর প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এখন নগরীর আয়তন ২০৩.৬৫ বর্গকিলোমিটার। আয়তন বাড়লেও বাড়েনি নাগরিক কোনো সুবিধা। সিটির বর্ধিতাংশ ১৮টি ওয়ার্ডের বেশির ভাগই মাটির রাস্তা। বর্ষায় রাস্তার বেহাল দশা। নেই কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান। কৃষিকাজই প্রধান। এই বর্ধিতাংশে এখনো বাড়ির কর নেওয়া শুরু না হলেও বেড়েছে ভূমিকর। কিছু এলাকায় বিদ্যুতের আলো পৌঁছায়নি। কোথাও কোথাও খুঁটি পুঁতলেও মেলেনি সংযোগ। সন্ধ্যার পর বর্ধিত এলাকার অধিকাংশ সড়ক থাকে অন্ধকারে।
সিটি করপোরেশনের মোট রাস্তার পরিমাণ প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে পাকা রাস্তা মাত্র ৪৫০ কিলোমিটার আর কাঁচা রাস্তা প্রায় ৯২২ কিলোমিটার।
আবার শহর অংশের নাগরিক সেবা নিয়েও হতাশা আছে ভোটারদের মধ্যে। রংপুর শহর কার্যত অচল অটো রিকশার দখলে। অনেকেই তাই রসিকতা করে বলেন, রংপুর শহরের এখন মানুষের সংখ্যা বেশি না অটোরিকশার। মূল শহরের বেশির ভাগ রাস্তায় অপ্রশস্ত। প্রায় পাঁচ হাজার অটোর লাইসেন্স থাকলেও শহরে চলাচল করে ৩০ হাজারেরও বেশি। অটোরিকশার সংখ্যা কমিয়ে টাউন সার্ভিসের পরিকল্পনা থাকলেও এখনো তা কাগজে-কলমে। ৩৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে পুরোনো ১৫টি। শহরের প্রধান প্রধান সড়কের বেশির ভাগ ভালো থাকলেও কোথাও কোথাও খানাখন্দ, অনেক জায়গা হকারদের দখলে।
রংপুর অঞ্চলজুড়ে পয়োনিষ্কাশনের তেমন ব্যবস্থা না থাকায় একসময় ম্যালেরিয়াবাহী মশার উপদ্রব ছিল খুব বেশি। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েই সে সময় মারা যান, রংপুর পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান ও ডিমলার জমিদার রাজা জানকী বল্লভ সেনের মা শ্যামাসুন্দরী দেবী। মাতৃশোকে বিহ্বল জমিদার এই মরণব্যাধির হাত থেকে প্রজাদের রক্ষা করতে ১২৮ বছর আগে খাল খননের উদ্যোগ নেন। ১৮৯০ থেকে ১৮৯৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ আট বছর ধরে খনন করে এর নাম রাখা হয় ‘শ্যামাসুন্দরী খাল’। মহানগরের জজকোর্টসংলগ্ন কেরামতিয়া মসজিদের সামনে সে সময় খনন করা এ খালের স্মৃতিস্তম্ভে মায়ের উদ্দেশে লেখা ‘পীড়ার আকরভূমি এই রঙ্গপুর/প্রণালী কাটিয়া তাহা করিবারে দূর/ মাতা শ্যামাসুন্দরী স্মরণের তরে/ জানকী বল্লভ সুত এই কীর্তি করে', এখনো সবার দৃষ্টি কাড়ে।
একসময় রংপুর শহরের প্রাণ ছিল ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ শ্যামাসুন্দরী। কালের পরিক্রমায় তা এখন জীর্ণ, গতিহীন, আবর্জনা ও দূষণের স্তূপ। নিরুপায় শ্যামাসুন্দরী। তাই উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন জাইকার অর্থায়নে শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা করা হলেও খালটি সংস্কারের অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরতে বসেছে। শহরের অবৈধ বিলবোর্ড অপসারণ করা হলেও সিটি করপোরেশন অনুমোদিত বিলবোর্ডই কোথাও কোথাও শহরকে ঢেকে ফেলেছে। রংপুরকে উত্তরাঞ্চলের রাজধানী বলা হলেও হয়নি শিল্পায়ন। এখনো কৃষিকাজই প্রধান। আছে বেকারত্ব, মাদকের ভয়াবহতা।
এবার মেয়র পদে সাতজন লড়ছেন, এর মধ্যে দলীয় প্রতীকে ছয়জন, সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর ৬৫ জন এবং সাধারণ কাউন্সিলর ২১১ জন প্রার্থী। ৩৩টি ওয়ার্ডে মোট ভোটার তিন লাখ ৮৮ হাজার ৪২১ জন, এর মধ্যে অর্ধেকই নারী ভোটার। ভোট কেন্দ্র ১৯৩টি, বুথ এক হাজার ১৪৫টি। এর মধ্যে ৬৬ ভাগ কেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ, অবশ্য নির্বাচন কমিশনের হিসেবে অতি গুরুত্বপূর্ণ। রংপুর আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং কর্মকর্তা সুভাষ চন্দ্র সরকার বলেছেন, একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের সব ধরনের পদক্ষেপ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হয়েছে, চার স্তরের নিরাপত্তা থাকছে নির্বাচনে।
লেখক : সংবাদকর্মী, এটিএন নিউজ