রসিক নির্বাচন
জয়-পরাজয় প্রতীক না ব্যক্তির?
এ বিজয় লাঙ্গল নাকি ব্যক্তি ইমেজের? আর পরাজয়টাই বা কার? নৌকা প্রতীকের, না ব্যক্তির। এটিকে কি মডেল নির্বাচন বলা যায়? দলীয় প্রতীকের এই স্থানীয় সরকার নির্বাচন জাতীয় রাজনীতিতে কি কোনো ইতিবাচক প্রভাব রাখবে?
রংপুরের মানুষ দেখিয়ে দিল, একজনকে তারা কীভাবে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নিতে জানেন, আবার যে তাঁদের আপন ভাবতে পারবে না, তাঁকে তাঁরা ছুড়েও ফেলে দিতে পারেন। নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকবে, তবে ৯৮ হাজার ৮৯ ভোটের এত বড় ব্যবধানে হার মানতে হলো আওয়ামী লীগের প্রার্থী সরফুদ্দীন আহমেদ ঝন্টুকে। এসব নিঃসন্দেহে বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
অবশ্য মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা এই বিজয়কে রংপুরের জনগণের বিজয় হিসেবে উল্লেখ করেন। রাস্তাঘাট, জলাবদ্ধতা এবং যানজট—এ তিনটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে চান তিনি। সবাইকে নিয়ে কাজ করার কথাও বলেন।
রংপুর সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালিকা একেবারে ছোট ছিল না। বলতে গেলে ডজনখানেক নেতার নাম আসে। তবে দল আস্থা রাখে রংপুরের এই প্রবীণ নেতা সরফুদ্দীন আহমেদ ঝন্টুর ওপর। প্রথম মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর পাঁচ বছর আগে রংপুরের মানুষদের ‘মফিজ’ নামটি ঘোচানোর অঙ্গীকার করেছিলেন। বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে রংপুরের জনগণ তাঁকে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু পাঁচ বছরে পর কেন ছুড়ে ফেলে দিল তাঁদের এই জনপ্রিয় নেতাকে।
প্রচার-প্রচারণার সময় সাধারণত ভোটাররা বলে থাকেন, আমার ভোট আমি দেবো, যাকে খুশি তাকে দেবো কিংবা একজন যোগ্য নগরপিতা চায়। কিন্তু রংপুরের মানুষ যেন একটু আলাদা। এখনকার মানুষ কিছুটা সহজ-সরল এবং আবেগপ্রবণও। কথা বলেন খোলা দিলে। নগরের উন্নয়ন নিয়ে মানুষের অনেকের অভিযোগ না থাকলেও খোলা মনে তাদের উত্তর, ঝন্টুর ব্যবহার খারাপ। তাঁর কাছে যাওয়া যায় না, শুধু গালমন্দ করেন। ফলে যে প্রত্যাশা নিয়ে তাঁরা প্রথম নগরপিতা নির্বাচন করেন, তাতে চরমভাবে হোঁচট খান।
রংপুর ৬৫ হাজার সংখ্যালঘু ভোটার, যা আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক হিসেবে ধরে দেওয়া হয়। সেই ভোটের বেশির ভাগই যে এবার নৌকায় পড়েনি, তা বলাই যায়। এবার এক লাখ নতুন ভোটার ভোট দিয়েছেন। ৭৪ ভাগ ভোট পড়লেও সেই ভোট মোস্তাফাকে বেছে নিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজন রংপুর মহানগরের শাখার সভাপতি অধ্যক্ষ খন্দকার ফকরুল আনাম মনে করেন, একটি শহরের জন্য যে ধরনের মাস্টার প্রয়োজন, তার সূচনা করতে ব্যর্থ হন ঝন্টু। তাঁর কথাবার্তা-আচরণে আহত হয়েছেন রংপুরের মানুষ।
স্থানীয় সরকার রংপুর জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী নেতা প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা মনে করেন, এই পরাজয় নৌকার নয়, ব্যক্তি ঝন্টুর।
তবে সরফুদ্দীন আহমেদ ঝন্টু মেয়র হওয়ার আগপর্যন্ত সব সময় মাঠের নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। দীর্ঘ রাজনীতি জীবনে তিনি ধীরে ধীরে মাঠ পর্যায় থেকে উঠে এসেছেন। জীবনে যিনি কোনো নির্বাচনেই পরাজিত হননি। ১৯৮৭ সালে নির্বাচনে প্রথম উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯২ সালে রংপুর পৌরসভা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর রংপুর সিটি করপোরেশন প্রথম নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশে এই প্রথম ব্যক্তি, যিনি একাধারে উপজেলা, পৌরসভা, সংসদ সদস্য ও সিটি মেয়র নির্বাচিত হন।
নির্বাচনী প্রচারের সময় স্পষ্ট হয়ে যায়, রংপুর আওয়ামী লীগ ঐক্যবোধ নয়। কুমিল্লার মতো এখানেও দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল স্পষ্ট হয়। রংপুরের আওয়ামী লীগের নেতারা নাখোশ ছিলেন ঝন্টুর ওপরে। লোক দেখানো প্রচরণায় অংশ নিলেও অনেকেই জানান, ঝন্টু আবার মেয়র হতে পারবেন না।
গত নয় বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে অনেক ভোটারও আওয়ামী লীগের ওপর হয়তো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এর কিছু প্রভাবও পড়তে পারে এই নির্বাচনে। বয়সও একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ঝন্টুর জন্য। শারীরিক অবস্থা যখন অবসরের কথা বলে, তখন আওয়ামী লীগ তাঁকেই মনোনয়ন দেয়। ফলে বেশি বয়সে এসে পরাজয়ের স্বাদ নিতে হলো। স্থানীয় গণমাধ্যমের সঙ্গে তার আগে থেকেই দূরত্ব তৈরি হয়। নির্বাচনের সময় সেটি আবার স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে, জাতীয় পার্টির আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত রংপুর। তবে দিনে দিনে যেন মাঠ চলে যায় অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর দখলে। উত্তরাঞ্চলে কেন দলটির জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে থাকে। এর কারণ বিশ্লেষণ করলেই প্রকৃত চিত্রটি উঠে আসে। সকালে এককথা, বিকেলে আরেক এবং রাতে অন্য কথা বলে রাজনীতির মাঠে এবং রংপুরের মানুষের কাছে হাস্যরসের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন উত্তরাঞ্চলের/রংপুরের ঘরের এরশাদ। ২০১৪ সালের নির্বাচনে যাবেন না বলে এক প্রকার শপথ করেন। অথচ তিনি পরে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। জাতীয় পার্টি বিরোধী দল, আবার সরকারের মন্ত্রী। সেই সঙ্গে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সংসদে বিরোধীদল নেতা রওশন এরশাদের সঙ্গে দলীয় সিদ্ধান্ত এবং সম্পর্কের টানাপড়েন।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৯৯১ সালে ৩৫টি, ’৯৬ সালে ৩২, ২০০১ সালে ১৪টি আসন পায় জাতীয় পার্টি। এর মধ্যে বেশির ভাগই উত্তরাঞ্চলের ৩৫টি থেকে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মহাজোটভুক্ত হয়ে ২৭টি আসনে জয়লাভ হয়। ১৯৯১ থেকে ২০০১ তিনটি নির্বাচনেই পাঁচটি আসনেই জয়ী হন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তবে ২০০৮-এর নির্বাচনে রংপুর থেকেই হাতছাড়া হয়ে যায় তিনটি আসন।
বারবার নির্বাচিত করেও কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন না হওয়ায় প্রিয় মানুষ এরশাদের ওপর নাখোশ হয়ে পড়েন রংপুরবাসী। ২০১২ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে এরশাদের পরপর পাঁচটি সিদ্ধান্তের কারণে হাতছাড়া হয়ে যায় সিটি মেয়রের পদটি।
তবে অনেক দিন পর ঐক্যবোধ দেখা গেল জাতীয় পার্টিকে রংপুরে। পার্টির চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের নেতাই বলতে গেলে তাঁদের প্রার্থীকে জেতাতে ছিলেন মরিয়া।
২০১২ সালের রংপুরের প্রথম সিটি নির্বাচনেও মূলত এই তিন প্রার্থীর মধ্যে ভোটযুদ্ধ ছিল। গত নির্বাচনে সরফুদ্দীন আহমেদ ঝন্টু এক লাখ ছয় হাজার ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। প্রায় ৭৮ হাজার ভোট পান জাতীয় পার্টি থেকে সে সময়ে বহিষ্কৃত প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। কাওছার জামান বাবলা পেয়েছিলেন ২১ হাজার ২৩৫ ভোট।
গত পাঁচ বছরে ধীরে ধীরে রংপুরের মানুষের একান্ত আপনজন হয়ে ওঠেন মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। বিশেষ করে বর্ধিতাংশ মানুষের কাছে। কারণ শহর রংপুর সদরের ১০টি, কাউনিয়া, সারাই ও পীরগাছার কল্যাণীসহ ১২টি ইউনিয়নের ১১২টি মৌজাকে সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করে এখন নগরীর আয়তন ২০৩.৬৫ বর্গকিলোমিটার। আয়তন বাড়লেও বাড়েনি নাগরিক কোনো সুবিধা। সিটির বর্ধিতাংশ ১৮টি ওয়ার্ডের বেশির ভাগই মাটির রাস্তা। বর্ষায় রাস্তার বেহাল দশা। নেই কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান।
কৃষিকাজই প্রধান। এই বর্ধিতাংশে এখনো বাড়ির কর নেওয়া শুরু না হলেও বেড়েছে ভূমিকর। কিছু এলাকায় বিদ্যুতের আলো পৌঁছায়নি। কোথাও কোথাও খুঁটি পুঁতলেও মেলেনি সংযোগ। সন্ধ্যার পর বর্ধিত এলাকার অধিকাংশ সড়ক থাকে অন্ধকারে। এই বর্ধিতাংশের ভোটারই রংপুরে বেশি। উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত এসব এলাকার মানুষ দুই প্রার্থীর মধ্যে পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন অনেক বেশি।
বিএনপির প্রার্থী কাওছার জামান বাবলা অবশ্য নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখ্যান করলেও তাঁর প্রাপ্ত ভোটের চিত্র অনেক কিছুই স্পষ্ট করে দেয়। আর তা হলো দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হলেও জাতীয় নির্বাচন আর স্থানীয় সরকার নির্বাচন এক নয়। এখানে স্থানীয় রাজনীতি এবং প্রার্থীর ব্যক্তি ইমেজ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এমনিতেই রংপুরে বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা কোনো সময়ই ভালো ছিল না। তাদের ঘরের ছেলে হাবিব-উন-নবী খান সোহেল এখন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি। দলকে চাঙ্গা করার মতো তেমন কোনো কর্মকাণ্ড করতে পারেনি রংপুর বিএনপি।
এই নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে বিএনপির যে এক ধরনের গড়িমসি লক্ষ করা হয়। নিজেদের অবস্থান উপলব্ধি করে এই নির্বাচনকে আনুষ্ঠানিক অংশগ্রহণের জন্য গুরুত্ব কম দেওয়া কিংবা যোগ্য প্রার্থী না থাকার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। কাওছার জামান বাবলা একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী পরিচিত থাকলেও স্থানীয়রা মনে করেন, রংপুরের স্থানীয় রাজনীতিতে তিনি খুব বেশি সময় দেননি কিংবা প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। যদিও দান করার ক্ষেত্রে তাঁর একটা সুনাম আছে। পাশাপাশি ঋণখেলাপি হিসেবে তিনি আলোচিত হন। তাঁর প্রার্থিতা বাতিল চেয়ে আবেদন হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়।
দলীয় প্রতীকে বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা লাঙ্গল প্রতীকে এক লাখ ৬০ হাজার ৪৮৯ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। নৌকা প্রতীকে সরফুদ্দীন আহমেদ ঝন্টু পেয়েছেন ৬২ হাজার ৪০০ ভোট। ধানের শীষ প্রতীকে কাওসার জামান বাবলা পেয়েছেন ৩৫ হাজার ১৩৬ ভোট।
মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা রংপুরবাসীর প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে পারবেন, সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, এটিএন নিউজ।