২০১৮
অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
জ্যোতির্বিদরা ভবিষ্যৎ বলতে পারেন। তাঁরা গ্রহ-নক্ষত্র, দিনক্ষণ বিশ্লেষণ করে ভালোমন্দ বলেন। হস্তরেখাবিদরা কারো কারো হাত দেখে ভাগ্য গণনা করেন। কোনো কোনো সময় তাঁরা জাতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মন্তব্য করেন। রাশিচক্র-২০১৮ নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হবে। এমনকি বিশেষ ব্যবসায়ীরা বিশেষ সংখ্যা বের করবেন। এতে আগ্রহের কোনো কমতি নেই। তবে একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর পক্ষে যেকোনো রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে মন্তব্য করা কঠিন। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় বিবেচ্য। প্রথমত, যেকোনো রাষ্ট্রের কিছু স্থায়ী বিষয় আছে। যেমন ভূখণ্ড বা ভূরাজনৈতিক অবস্থান, জনমিতি, জলবায়ু এবং জনমনস্তত্ত্ব। এ বিষয়গুলো প্রায় অপরিবর্তিত থাকে। ইচ্ছা করলেই কেউ রাষ্ট্রের সীমারেখা পরিবর্তন করতে পারে না। জনগণের স্বভাব-চরিত্র এবং বিষয়-বৈশিষ্ট্য অভিন্ন থাকে।
প্রখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক ইবনে খলদুন তাঁর আল-মোকাদ্দিমায় আসাবিয়াহ তত্ত্বে এসব কথা বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয়ত, যে প্রসঙ্গটি অনির্দিষ্ট এবং অনির্ধারিত—তা হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি। একটি কথা এখানে বলে রাখা ভালো যে উন্নত দেশগুলোয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাদে আর সব বিষয় মোটামুটি প্রাতিষ্ঠানিকতা আছে। সেখানে সবকিছু সংবিধান, আইন, প্রথা ও পদ্ধতির ওপরে নির্ভরশীল। কেউ ইচ্ছা করলেই গণেশ উল্টে দিতে পারে না। তৃতীয় বিশ্বের নানা রাজনৈতিক পরিবর্তনকে কোনো কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে তুলনা করে রাজনৈতিক দুর্যোগ বলে অভিহিত করে থাকেন।
বাংলাদেশের আগামী বছর কেমন যাবে—এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়েই উপরোক্ত গৌরচদ্রিকার অবতারণা করা হলো। কথিত স্থায়ী ও অস্থায়ী অনুষঙ্গের ভিত্তিতে একজন সাধারণ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে বাস্তবতার আলোকে কিছু মন্তব্য করা যায়। যেকোনো একজন বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী নাগরিক এসব মন্তব্য করতে পারেন।
উদাহরণ হিসেবে কাউকে যদি বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের ব্যবস্থা নিয়ে মন্তব্য করতে বলা হয়, তাহলে সে অবশ্যই অতীতকে পর্যালোচনা করবে এবং বর্তমানকে পর্যবেক্ষণ করে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মন্তব্য প্রদান করবে। একজন নাবালকও বোঝে যে বর্তমান সরকারের অধীনে আগামীতে যে নির্বাচন হবে, তা কেমন হবে। বর্তমানকে পর্যবেক্ষণ করে যদি মন্তব্য করতে বলা হয়, তাহলে ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত দেশের ১২৬টি ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের নির্বাচনকে বিশ্লেষণ করব। একটি জনপ্রিয় দৈনিকে প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদন অনুযায়ী ‘সকালে আগে থেকেই নৌকা প্রতীকে সিলমারা ব্যালট পেপার ভোটারদের হাতে ধরিয়ে দেন পোলিং অফিসার’। সুতরাং ভবিষ্যৎ নির্বাচন সম্পর্কে মন্তব্য করা আর কঠিন কিছু নয়। কবিগুরুর ভাষায়, ‘সম্মুখে ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের আমি।’
নির্বাচনের কথা বাদ দিয়ে যদি সাধারণ বিষয়-আশয় রাজনীতি, সমাজনীতি এবং অর্থনীতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে বলা হয়, তাহলে যে কেউ বর্তমানের নিরিখেই কথা বলবে। বাংলাদেশের বর্তমানই ভবিষ্যৎ নির্মাণ করবে। সবাই জানে. ২০১৯ সাল বাংলাদেশে নির্বাচনের বছর। বিরোধী শক্তিসমূহ যে নির্বাচনকালীন সরকারের কথা বলছে, তা অর্জিত না হলে সর্বাত্মক আন্দোলন ছাড়া বিরোধী শক্তির সম্মুখে আর কোনো বিকল্প নেই। তবে আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে হিসাব-নিকাশ আছে। সরকার ততই মারমুখী হয়ে উঠবে, যতই নির্বাচন ঘনিয়ে আসবে। এটা সবাই বোঝে যে পুলিশ হচ্ছে ক্ষমতাসীন সরকারের ক্ষমতার একমাত্র ভিত্তি। দেশটাকে তারা পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করেছে গত নয় বছর আগে। ক্ষমতার উৎস এখন আর জনগণ নয়। মাও সেতুং যেমন বলেছিলেন, ‘বন্দুকের নল থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা বেরিয়ে আসে।’ তেমনি বন্দুক, অর্থাৎ শক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে বর্তমান সরকার। আগামী বছরে ‘যুদ্ধ’ সমাগত। জনগণের শক্তি এবং সরকারের শক্তির মধ্যে সে রাজনৈতিক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয় জনগণ। তারা চায়, নিয়মতান্ত্রিকভাবে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার হস্তান্তর। বছরটি শুরু হচ্ছে ক্ষমতার অদলবদলের অনিশ্চয়তা দিয়ে।
এ তো গেল নির্বাচন তথা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কথা। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও একই অনিশ্চয়তা। কোটি কোটি টাকার বাজেট তৈরি করা হয়েছে, যার মর্মার্থ হচ্ছে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ অবস্থান করলেও প্রবৃদ্ধির গতি নিম্নমুখী। ব্যাংকগুলোর বেহাল দশা। অনেক ব্যাংকে লাল বাতি জ্বলার সময় হয়েছে। দেশের রেমিট্যান্স কমে এসেছে। প্রধান রপ্তানি পণ্য- গার্মেন্টস শিল্পে নানা ধরনের অরাজকতা ও অস্থিরতা চলছে। রপ্তানির তুলনায় আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে। যে খাদ্যশস্যে বাংলাদেশ এত দিন স্বয়ংসম্পন্ন ছিল, সেখানে আজ ঘাটতি। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রবাদির মূল্য আকাশচুম্বী। পেঁয়াজের মূল্য ১৪০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। গরিব সাধারণ মানুষের জীবন অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
সামাজিক মূল্যবোধের মাত্রা সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। সমাজের সর্বত্র খুন-গুম-জখমে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। ‘সোনার ছেলে’রা ইতিমধ্যে পাশবিকতায় সমস্ত অতীতকে অতিক্রম করেছে। সমাজ থেকে স্নেহ-মায়া-মমত্ব-সহযোগিতা-সহানুভূতি বিদায় নিয়েছে। ২৯ ডিসেম্বর সংবাদপত্রে এক ভয়ংকর সংবাদ ছাপা হয়েছে। এক পশু সন্তান তা মাকে গলা কেটে হত্যা করেছে। সমাজের সর্বত্র হামলা মামলা, নিপীড়ন-নির্যাতন অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং সামাজিক জীবন অনিশ্চয়তায় নিপতিত হয়েছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক অক্ষমতা, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় দেশকে আগামী বছর ২০১৮ সালে আরো অনিশ্চয়তার দিকে ধাবমান করবে। সুরঙ্গের অবশেষে আলোর কোনো রেখা দেখা যাচ্ছে না। সরকারের তরফ থেকে রাজনৈতিক উন্নয়ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক সংহতির পক্ষে কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হচ্ছে না। তাদের সকল উদ্যোগ, উপভোগ, উৎকণ্ঠা—সকলই ক্ষমতাকে ঘিরে। ‘তোরা যে যা বলিস ভাই মোদের সোনার হরিণ চাই’। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার পরিবর্তে তারা গোল্ডেন টাচ গল্পের নায়কের মতো সবকিছু সোনা দিয়ে তৈরি করতে চায়। মাটি ও মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার হিসাব তাদের নেই। ২০১৮ সাল হোক ভাগ্যবদলের সময় কাল।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।