যশোর রোড
উন্নয়নের করাতে চেরাই না হোক ইতিহাস
যশোরের জমিদার কালী পোদ্দার। মাকে সোজা পথ দিয়ে গঙ্গাস্নানে নিয়ে যাওয়ার জন্য ৫৮ হাজার কড়ি ব্যয়ে ১৮৪২ সালে যশোর শহরের বকচর থেকে ভারতের নদীয়ার গঙ্গাঘাট পর্যন্ত একটি সড়ক নির্মাণ করেন। আর ৮০ কিলোমিটারের ওই রাস্তার ছায়ার জন্য দুধারে রোপণ করেন অতিবর্ধনশীল রেইনট্রি; যেগুলো আনা হয়েছিল বিদেশ থেকে। কালের পরিক্রমায় সেই গাছগুলো এখন মহীরুহ। এরকম মহীরুহ সারা দেশেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কিন্তু যশোর রোড নামে পরিচিত যশোর–বেনাপোল সড়কের দুধারের এই শতবর্ষী বৃক্ষগুলো কেটে ফেলার প্রতিবাদে সামাজিক যোগোযোগমাধ্যম ফেসবুকের দেয়াল যেভাবে ছেয়ে গেছে, তা অভূতপূর্ব। মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এই বৃক্ষগুলো বাঁচাতে মানুষের যে আকুতি,যে নিবেদন, তা শেষঅবধি ধারালো করাতে চেরাইয়ের হাত থেকে এই বয়সী প্রাণগুলোকে রক্তাক্ত হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে কি না, তা এখনও নিশ্চিত নয়।
মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’—যেটির পরে ভাবানুবাদ ও সুরারোপ করে কণ্ঠ দেন ভারতের শিল্পী, মৌসুমী ভৌমিক; সেই গানের কল্যাণে যশোর শহরের দড়াটানা মোড় থেকে বেনাপোল বন্দর পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটারের এই সড়কটি যেন নতুন করে চিনেছে এই প্রজন্ম।
গিন্সবার্গ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষদিকে কলকাতায় এসেছিলেন। তখন পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের সংযোগকারী সড়ক হিসেবে কাজ করতো, এই যশোর রোড। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ থেকে অনেক শরণার্থী, পশ্চিমবঙ্গ ও সীমান্তবর্তী অন্যান্য শহরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। গিন্সবার্গ যশোর সীমান্ত এবং এর আশেপাশের শিবিরগুলোতে বসবাসকারী শরণার্থীদের দুর্দশা দেখেছেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছিলেন কবিতাটি।
মহাসড়কের দুই পাশে প্রায় আড়াই হাজার গাছ। এরমধ্যে আছে ১৭৪ বছরের পুরাতন, যশোরের তৎকালীন জমিদার কালী পোদ্দারের লাগানো, তিন শতাধিক রেইনট্রি; যা এই মহাসড়কে ছায়া দেয়ার পাশাপাশি সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে।
কিন্তু গত বছরের মার্চে যশোর-বেনাপোল মহাসড়ক ৪ লেনে উন্নীত করার প্রয়োজনে এই গাছগুলো কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যা ক্ষুব্ধ করে তোলে প্রকৃতিপ্রেমি তো বটেই, সাধারণ মানুষকেও। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদের মুখে, জুলাই মাসে গাছগুলো বাঁচিয়ে রেখে মহাসড়কটি পুনঃনির্মাণের ঘোষণা দেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। কিন্তু সম্প্রতি সড়ক বিভাগের বিশেষজ্ঞরা গাছ রেখে রাস্তা প্রশস্তকরণ সম্ভব নয় বলে জানালে, আগের সেই ঘোষণা থেকে সরে আসে কর্তৃপক্ষ।
যশোর রোডের ভারত অংশের গাছগুলোও কেটে ফেলারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সেখানে রাস্তায় নেমেছেন পরিবেশবাদী এবং ইতিহাস সচেতন মানুষ। এমনকি গাছ কাটা বন্ধে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন আন্দোলোনকারীরা। অর্পিতা সাহা ও শৌভিক মুখোপাধ্যায় নামে দুই শিক্ষার্থীর জনস্বার্থ একটি মামলার রায়ে কলকাতা হাইকোর্ট যশোর রোডের গাছগুলো কাটার উপর প্রথমে ১ সপ্তাহ এবং পরে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিতাদেশ জারি করেন।
গাছ কাটার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে একটি চিঠিও লিখেছিলেন প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী কবির সুমন। তিনি লিখেছেন, ‘শুনছি চার হাজার গাছ কাটা হচ্ছে। একটি গাছও যদি কাটা হয় আমি প্রতিবাদ করবো। কী বড় বড় গাছ যশোর রোডের দুপাশে। কত বছর লেগেছে ঐ গাছগুলো অমন আকার পেতে। বনস্পতি। মহীরুহ। ওরা যে আমাদের বুক ভরে দেন অক্সিজেন। ওঁরা যে আমাদের গুরুজন- বন্যপ্রাণীদের মতো। ওরা যে আমাদের কী- স্নিগ্ধ ছায়া দেন। ওদের ঐ সবুজ রঙ! ওরা যে পৃথিবীর সব প্রাণীর সখা, সেবক, অভিভাবক, প্রেমিক।’
যশোর রোডের গাছগুলো বাঁচানোর আকুতিতে ভরে গেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের দেয়াল। একদিন ঢাকার রাস্তায় প্রতিবাদ জানানোর আহ্বান জানিয়েছেন প্রকাশক রবিন আহসান। উৎপল কুমার নামে একজন লিখেছেন, প্রয়োজনে আমরণ অনশন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গীতি আরা নাসরিন লিখেছেন, আমি গাছের জন্য ফেসবুকে শোকপ্রস্তাব লিখি। আদতে আমারই জন্য। অনেকেই লিখেছেন, গাছগুলো রেখে আরেকটি রাস্তা নির্মাণ করা যায়। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন সাংবাদিক প্রভাষ আমিন।
যশোর রোডটি অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই এটির বেহাল দশা। ফলে এই সড়কটি সংস্কারের বিকল্প নেই। কিন্তু সংস্কারের চেয়ে এখন এর সম্প্রসারণের বিষয়টিই যেন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এ বাস্তবতাও অস্বীকার করা যাবে না যে, যশোর রোডের এই গাছগুলো অনন্তকাল বেঁচে থাকবে না। গাছগুলোর আয়ু কমে আসবে এবং একসময়, সব গাছই মারা যাবে। কিন্তু তারপরও মানুষ চায় না গাছগুলো কাটা পড়ুক। কারণ যতদিন সে জীবিত থাকবে, ততদিন সে এই ধরিত্রীর জন্য বিলাবে জীবনদায়ী অক্সিজেন, ছায়া ও আশ্রয় দেবে মানুষ ও পাখিদের। মহিরুহসম এই বৃক্ষগুলো এখন আর শুধু বৃক্ষই নয়, তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রাণবৈচিত্র্য-পোকামাকড়, কীটপতঙ্গ ও পরজীবীদের বাঁচা-মরার বিষয়ও।
তবে ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে এই বৃক্ষশোভিত সরু সড়কটিকে সংস্কার করে এর দু পাশ দিয়ে আরও প্রশস্ত রাস্তা করা সম্ভব। সেজন্য বেশ কিছু স্থাপনা ভাঙতে হবে। অনেকের ঘরবাড়ি সরিয়ে নিতে হবে। অনেক দখলদারকে উচ্ছেদ করতে হবে। সরকার চাইলে এর কোনোটিই অসম্ভব কাজ নয়। উন্নয়ন যেমন জরুরি, তেমনি মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও কালের সাক্ষী হয়ে যে বৃক্ষগুলো দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলো বাঁচানোও কম জরুরি নয়। সারা পৃথিবীতেই এরকম গাছ বা পুরানো স্থাপনা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সংরক্ষণ করা হয়। সুতরাং গাছ কাটা নয়, বরং যশোর রোডের এই বৃক্ষগুলোকে ‘হেরিটেজ ট্রি’ হিসেবে ঘোষণা করা উচিত।
তবে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাংলাদেশ অংশে সড়কের পাশে অধিগ্রহণযোগ্য জমির পরিমাণ কম। অনেক জায়গায় রাস্তালাগোয়া মানুষের বসতি। ফলে বৃক্ষশোভিত সড়কটিকে মাঝখানে রেখে, দুপাশে নতুন রাস্তা নির্মাণ করতে গেলে, বহু মানুষকে সরাতে হবে। আবার স্থানীয় অনেকেই নিজেদের জায়গা ছাড়তে চান না, এমন বাস্তবতাও রয়েছে।
অবকাঠামো উন্নয়ন এবং পরিবেশের মধ্যে একটি সাংঘর্ষিক অবস্থা বিরাজ করে। মাত্রাতিরিক্ত জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার যেমন বাড়িয়ে দিয়েছে পৃথিবীর উষ্ণতা এবং যার ফলে বেড়েছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ—তেমনি সড়ক যোগাযোগ, ঘরবাড়ি ও শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে গিয়ে কাটা পড়ছে অজস্র বৃক্ষ। ধ্বংস হচ্ছে ফসলি জমি, নদী, খাল, জলাশয়। শিল্প-কারখানার বর্জ্য আর কালো ধোঁয়ায় প্রবৃদ্ধির চাকা দ্রুতগামী হলেও ভেতরে ভেতরে আমরা বাসের অযোগ্য করে ফেলছি আমাদের প্রিয় এই ধরিত্রীমাতাকে। ফলে সারা বিশ্বেই এখন প্রাণ-প্রকৃতি আর পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখেই, অর্থাৎ সবুজ বাঁচিয়েই কীভাবে অবকাঠামো উন্নয়ন করা যায়, তা নিয়েই চলছে গবেষণা। সুতরাং যশোর রোডের গাছগুলো বেঁচে থাকুক। উন্নয়নের করাতে চেরাই না হোক আমাদের ইতিহাস, আমাদের ঐতিহ্য।
লেখক : সাংবাদিক