শ্রদ্ধাঞ্জলি
আর গান শোনাবেন না শিল্পী শাম্মী আখতার
বরেণ্য কণ্ঠশিল্পী শাম্মী আখতারও না-ফেরার দেশে চলে গেলেন। শিল্পপথে যাঁদের প্রাণান্ত বসবাস, এমন সুন্দর মানুষরা একে একে আমাদের ছেড়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমান বয়সী যাঁদের শিল্পচর্চা আবদুল জব্বার, রাজ্জাকের মতো মহান মানুষদের সমান্তরালে নতুন বছরের শুরুতেই পৃথিবীর পূর্ণযাত্রা সম্পন্ন করলেন শামীমা আখতার তথা শাম্মী আখতার। গান গেয়ে মানুষটি জয় করেছিলেন লাখো ভক্তের মন। আমাদের হৃদয় আজ ভারাক্রান্ত আর দৃষ্টি বড়ই সজল। মহাপ্রকৃতির দেওয়া বয়সসীমার ওপরে মানুষের হাত থাকে থাকে না সত্য, তবু প্রিয় মানুষদের অকালবিদায় মন মানে না কিছুতেই। যেখানেই থাকুন আমাদের গভীর শোক ও শ্রদ্ধাঞ্জলি জানবেন প্রিয় মানুষ, প্রিয় শিল্পী শাম্মী আখতার।
ছয় বছর ধরে বুকে কর্কট রোগের দুঃসহ যন্ত্রণাকে সঙ্গী করে চলছিলেন শাম্মী আখতার। গত মঙ্গলবার আর কর্কটের সঙ্গে পেরে উঠলেন না তিনি। মাত্র ৬২ বছরের অকালজীবনকে মহান ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ করতে বাধ্য হলেন। কিন্তু শিল্পী দৃশ্যত দেহান্তরিত হলেন বটে, আমাদের অন্তর্দৃষ্টিতে রয়ে গেল তাঁর অমূল্য ও নিপুণ কর্মকুশলতা। বাংলা সংগীতের আপন ভুবন আলোকিত করে যাওয়া সেসব গান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে দ্যোতি ছড়াবে। আমরা শাম্মী আখতারের ভক্তরা তাঁর অমৃত সুরধারাকে বয়ে বেড়াব আগামীর ইথারে গভীর ভালোবাসায়।
১৯৭০ সালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী’ গানের মাধ্যমে প্রথম খুলনা বেতারে তালিকাভুক্ত শিল্পী হিসেবে কণ্ঠ দেন শাম্মী আখতার। ১৯৭৫ সালে ঢাকায় এসে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ পান তিনি। এরপর ১৯৮০ সালে প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক সত্য সাহা ‘অশিক্ষিত’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্রের প্লেব্যাকে সুযোগ দেন। অভিষেক ছবিতেই ‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে’ এবং ‘আমি যেমন আছি তেমন রবো বউ হব না রে’ গান দুটি গেয়ে বাজিমাত করেন। যে গান এখনো ভীষণ শ্রোতাপ্রিয় এবং সবার মুখে মুখে ফেরে।
মাত্র ছয় বছর বয়সে তাঁর সংগীতজীবনের ধারাপাত হয়। বরিশালের ওস্তাদ গৌরবাবুর কাছে গানের প্রথম হাতেখড়ি নেন। এরপর বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে দেশের কয়েকটি জেলায় বিভিন্ন শিক্ষকের কাছে সংগীতের তালিম নেওয়ার সুযোগ পান তিনি। রাজবাড়ী ও খুলনায় সংগীত শিক্ষা নেন বাবু বামনদাস গুহ রায়, রণজিৎ দেবনাথ, সাধন সরকার, নাসির হায়দার ও প্রাণবন্ধু সাহার কাছে।
শাম্মী আখতার বাংলাদেশের অগ্রগণ্য প্লেব্যাক সিঙ্গারদের একজন, যিনি প্রায় ৪০০টি চলচ্চিত্রে গান গেয়েছেন। জীবদ্দশায় তাঁর দুটি গানের অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। ২০১০ সালে ‘ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না’ ছবির ‘ভালোবাসলেই সবার সাথে ঘর বাঁধা যায় না’ গানের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন এই গুণী শিল্পী।
শাম্মী আখতারের বহু শ্রোতাপ্রিয় গানের মধ্যে ‘বিদেশ গিয়া বন্ধু তুমি আমায় ভুইল না’, ‘মনে বড় আশা ছিল তোমাকে শোনাব গান’, ‘আমার মনের বেদনা বন্ধু ছাড়া বুঝে না’, ‘খোদার পরে তোমায় আমি বড় বলে জানি’, ‘আমার নায়ে পার হইতে লাগে ষোলোআনা’, ‘ঝিলমিল ঝিলমিল করছে রাত’, ‘এই রাত ডাকে ঐ চাঁদ ডাকে হায় তুমি কোথায়?’ গানগুলো এই শিল্পীকে নিরঙ্কুশ ও নিঃসংশয়ভাবেই কোকিলকণ্ঠি অভিধায় অভিষিক্ত করে।
যে বয়সে আমরা উড়নচণ্ডী ছিলাম, পড়াশোনা ফাঁকি দিয়ে দয়িতাকে হৃদয়ে ধারণ করে গুনগুন করে সারাক্ষণ প্রেমের গান গাইতাম—সেকালে শাম্মী আখতার আমাদের মন ভীষণভাবে মজিয়ে রাখতেন। শিল্পী জীবনে সুবীর নন্দীর সঙ্গে শাম্মী আখতারের ডুয়েট গানের কেমিস্ট্রিটা ছিল অসাধারণ। মোস্তফা আনোয়ার পরিচালিত 'কাজল লতা' ছবির গান 'এই রাত ডাকে ওই চাঁদ ডাকে আজ তুমি কোথায়?' গানটিতে শাম্মী আখতার কণ্ঠ ছাড়েন, 'এমন করে ডাকো যদি আমার ঘরে থাকাই দায়' সুরের কী ইন্দ্রজাল, কী প্রাণস্পর্শী দ্যোতনা!
ওই গানেই শাম্মী তাঁর অনন্য সুরের মোহময়ী মায়া ছড়ান, 'আমি থাকি বা না থাকি, তবু বাতাস হয়ে সুবাস হয়ে, তোমার কাছে আসব বয়ে। গানে গানে ডাকব তোমায় হয়ে বনের পাখি!' গানটি লিখেছেন মোহাম্মদ রফিকুজ্জামান আর সুর দিয়েছেন খন্দকার নূরুল আলম। কিন্তু শাম্মী আখতারের কোকিলকণ্ঠ ছাড়া এই গানের কথারা হয়তো এমন করে জাদু ছড়াতই না।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ শিল্পীর এ এক ক্লিষ্টকর নিয়তি যে, শেষ বয়সে তাঁরা মারাত্মক অর্থ সংকটে ভোগেন। শাম্মী আখতারও এমন সীমাবদ্ধতার বাইরে ছিলেন না। গত বছর অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর নিজস্ব তহবিল থেকে পাঁচ লাখ টাকা অনুদান দেন এই গুণী শিল্পীকে।
শেষ পর্যন্ত জীবনযুদ্ধে হার মেনে চিরতরে অন্তরালে চলে গেলেন তিনি। শিল্পীর স্বামী গণসংগীত শিল্পী আকরামুল ইসলাম, দুই সন্তান ও স্বজনদের প্রতি আমাদের হার্দিক সমবেদনা রইল। মহান প্রভু নিশ্চয় তাঁকে তাঁর নতুন জায়গায় ভালো রাখবেন—এমন প্রার্থনা আমাদের সবার।
শিল্পী শাম্মী আখতারের জন্য মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদ বধ কাব্যের প্রথম সর্গের এই অমোঘ সত্য পঙক্তিমালা হোক সবিশেষ বিয়োগান্তক শ্রদ্ধার্ঘ্য :
এ মোর সুন্দরী পুরী! কিন্তু একে একে
শুখাইছে ফুল এবে, নিবিছে দেউটি;
নীরব রবাব, বীণা, মুরজ, মুরলী;
তবে কেন আর আমি থাকি রে এখানে?
কার রে বাসনা বাস করিতে আঁধারে?
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশিন।