নাগরিক বোধ
বিনোদনের নৈরাজ্য এবং একজন নাজমুল হক
রাজধানীর আর কে মিশন রোডের একটি আবাসিক ভবনের ছাদে উচ্চ স্বরে গান বাজানোর প্রতিবাদ করায় নাজমুল হক (৬৫)নামের এক সাবেক সরকারি কর্মকর্তাকে পিটিয়ে হত্যার খবরটি আমাদের অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে––যে প্রশ্নের জবাব শুধু একা রাষ্ট্রের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়; যে প্রশ্নগুলো আমাদের নিজেদেরই করতে হবে।
কী ধরনের সমাজ আমরা বিনির্মাণ করেছি, ভেতরে ভেতরে কী ধরনের অসুস্থ প্রজন্ম আমরা গড়ে তুলছি এবং লালন-পালন করছি, ঝাঁ চকচকে আর আলো ঝলমলে নগরীর ভেতরে কী বিশ্রী, কী কদাকার, কী নির্মম, কী অমানবিক ‘সংস্কৃতি’র চর্চা করছি––সেই প্রশ্নগুলো বরং এখন একটি বিরাট আত্মজিজ্ঞাসা।
গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ওই ভবনের ছাদে একটি গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে উচ্চ স্বরে গান বাজানো হচ্ছিল। এতে অসুস্থ নাজমুল হক ঘুমাতে পারছিলেন না।তিনি নিচে গিয়ে কেয়ারটেকারকে বিষয়টি জানান। পরের দিন শুক্রবার সকালে বাড়ির সাত-আটজন লোক নিচে জড়ো হন। তারা তখন কেয়ারটেকারকে দিয়ে নাজমুল হককে নিচে ডেকে আনেন। নামার সঙ্গে সঙ্গেই তার ওপর হামলা শুরু হয়। একপর্যায়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন বৃদ্ধ নাজমুল হক। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়। ঘটনার পর পুলিশ কয়েকজনকে আটক করে।
গায়ে হলুদ, বিয়ে, জন্মদিন, থার্টিফার্স্ট নাইট বা এ রকম নানা উপলক্ষে রাতভর বাসার ছাদে উচ্চস্বরে গান বা কনসার্টের অত্যাচার রাজধানীবাসীর জন্য নতুন কিছু নয়।প্রতিবাদ করেও যে খুব বেশি কাজ হয়, তাও না। কারণ যারা এই কাজগুলো করে তারা সাধারণত পাহা-মহল্লার প্রভাবশালী। অনেক সময়ই আবাসিক ভবনের মালিকদের পরিবারের লোকেরাই এসব আয়োজন করে। ফলে ভাড়াটিয়ারা তাদের সঙ্গে কোনো বিরোধে জড়াতে চায় না। বিরোধে জড়ালে কী পরিণতি হয়, নাজমুল হকের নির্মম মৃত্যু সেটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। সেখানে একজন লিখেছেন, ‘এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে তো আর কখনোই ছাদে উচ্চ স্বরে গান বাজলে তার প্রতিবাদ করব না।’
শুধু ছাদে উচ্চ স্বরে গানই নয়, বিভিন্ন জাতীয় দিবসে দিনভর ভাষণ এবং দেশাত্মবোধক গান বাজিয়ে যে ধরনের শব্দ দূষণ আর নাগরিকের বিরক্তির উদ্রেক ঘটানো হয়, তার প্রতিবাদ করা আরো বেশি বিপজ্জনক। পাড়া মহল্লায়, একটি সড়কেই একাধিক মাইকে দিনভর ভাষণ ও গান বাজিয়ে যে ধরনের ‘দেশপ্রেম’ আর দলীয় আনুগত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা করা হয়, সেখানে দেশপ্রেম বলে আদৌ কিছু নেই। যা আছে তার নাম সুবিধাবাদী রাজনীতি। বিশেষ দিবসে কোনো সড়কে কত জোরে ভাষণ ও গান বাজানো গেল, সেটা এক বড় প্রতিযোগিতা।
মানুষের কাছে শব্দের সহনীয় মাত্রা রয়েছে। সেই মাত্রা অতিক্রম করে কোনো ভাষণ কিংবা দেশাত্মবোধক গান বাজিয়ে অন্যের অসুবিধা করা, অসুস্থ মানুষকে আরো বেশি অসুস্থ করে ফেলার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই।
বস্তুত আমাদের সিভিক সেন্স বা নাগরিক বোধ বলে আদৌ কিছু গড়ে উঠছে কি না তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আমরা রাতে রাস্তায় লোকজন চলাচল কমে গেলে, কিছু অন্ধকার দেখে, এদিকে ইতিউতি তাকিয়ে ময়লাবোঝাই পলিথিন রাস্তার পাশেই ফেলে দিয়ে আসি। কষ্ট করে একটু দূরে গিয়ে ডাস্টবিনে ফেলা কিংবা সিটি করপোরেশনের কর্মীদের জন্য সকাল পরযন্ত অপেক্ষা করার প্রয়োজনবোধ করি না কিংবা তারা যখন ‘ময়লা’ বলে ডাক দেয়, সেই সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে পাঁচ তলা বেয়ে নিচে নামতে মন চায় না। ফলে আগের রাতে রাস্তার পাশেই আমরা ময়লা ফেলে দিয়ে আসি এবং পরের দিন সকালে ওই রাস্তা দিয়েই আমরা নাকে রুমাল চেপে হাঁটি।
ময়লা ফেলার জন্য সিটি করপোরেশন আমাদের পাড়া-মহল্লার রাস্তা আর অলি-গলিতে ছোট-ছোট ডাস্টবিন বসিয়েছিল, সেগুলো আমরা খুলে ফেলেছি। কারণ ওই ছোট ডাস্টবিনে পলিথিনের প্যাকেট বা এ রকম ছোটখাট ময়লা ফেলার কথা থাকলেও আমরা গৃহস্থালি বর্জ্য বস্তাভর্তি করে ওই ছোট ডাস্টবিনেই ফেলে দিয়ে আসি এবং আশপাশের মানুষের বিরক্তির কারণ ঘটাই, চরম দুর্গন্ধের এন্তেজাম করি। ফলে অনেকে এই অত্যাচারের হাত থেকে ডাস্টবিনগুলো খুলে ফেলেছে আবার অনেক খুলে নিয়ে কেজি দরে বিক্রি করে দিয়েছে ভবঘুরে এবং ‘হিরোইঞ্চি’ বলে পরিচিতরা। দেখা যাচ্ছে, আমরা যে ধরনের নগরী গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখি কিংবা প্রত্যাশা করি সেটির জন্য সবচেয়ে বড় বাধা আমরা নিজেরাই।
ছাদে উচ্চ স্বরে গান বাজিয়ে কিংবা দিনভর মাইকে গান অথবা ভাষণ বাজিয়ে অন্যের অধিকার হরণ যে এক ধরনের অপরাধ, সেই বোধটিও আমাদের মধ্যে জাগ্রত হওয়ার প্রয়োজনবোধ করি না। ফলে আমরা এই শহরে থাকি, চলি-ফিরি কিন্তু একসঙ্গে কোটি কোটি মানুষ একা একা; বিচ্ছিন্ন; নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।
আমরা জৈবিক পরিচয়ে হয়তো মানুষ, কিন্তু নাগরিক নই। নগরীতে বসবাসের যোগ্যতা আমরা অর্জন করিনি। কারণ নাগরিক হওয়ার একটা বড় শর্তই হলো অন্য নাগরিকের অধিকার ও সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে সচেতন থাকা। আমার নিজের কিংবা পরিবার-পরিজনের আনন্দ-বিনোদনের জন্য রাতভর ছাদে উচ্চস্বরে গান বাজানোর ফলে পাশের ভবনের কোনো ফ্ল্যাটে থাকা একজন হৃদরোগীর যে অসুবিধা হচ্ছে, বাসার পাশেই যে একটি হাসপাতাল আছে এবং সেখানে শিশু-বৃদ্ধসহ সব বয়সী মনুষ রয়েছেন, সে কথা আমাদের ভাবনায় নেই। নেই, কারণ আমরা নাগরিক নই।
একটা তথ্য দিয়ে লেখাটা শেষ করছি। ছাদে এ রকম উচ্চস্বরে গানে কেউ যদি বিরক্ত হন, তাহলে সদ্য চালু হওয়া ৯৯৯ নম্বরে কল দিয়ে অভিযোগ করতে পারেন। আশা করা যায়, পুলিশ এসে তা বন্ধ করে দেবে। যতক্ষণ না আমাদের মধ্যে সিভিক সেন্স বা নাগরিক বোধ গড়ে উঠছে, ততক্ষণ পুলিশি সহায়তাই ভরসা। অবশ্য পুলিশ সেই ভরসার কতটুকু মূল্য দেবে, সেটি নির্ভর করবে তাদের জনবল ও আন্তরিকতার ওপর।
লেখক : সাংবাদিক