অভিমত
‘ফেরানো যাবে না কিছুতেই’
‘কোনো কারণে ফেরানো যাবে না তাকে, ফেরানো যাবে না কিছুতেই’; একটি জনপ্রিয় বাংলা গান, যেটি এখন বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অর্থাৎ তাদের নিজভূমি মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে যত কায়দা-কানুন করা হোক না কেন, বাস্তবতা হলো, জাতিগত নিধনের শিকার পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত এই জনগোষ্ঠীর বোঝা আখেরে বাংলাদেশকেই বইতে হবে। এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেই হয়তো ভাসানচরে তাদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। তুরস্কসহ নানা দেশ রোহিঙ্গাদের জন্য মানসম্মত ক্যাম্প ও হাসপাতাল তৈরি করে দিতে আগ্রহী। কিন্তু বিনিময়ে আমরা এরই মধ্যে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছি কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ এলাকার স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা, ধ্বংস হয়েছে প্রকৃতি, বন্যহাতির আবাসস্থল, লাখ লাখ মানুষের পয়ঃবর্জ্যে দূষিত পরিবেশ। সব মিলিয়ে এখন উখিয়া-টেকনাফের বাংলাদেশিরাই যে ওখানে ‘সংখ্যালঘু’, সেই খবরও গণমাধ্যমে এসেছে।
গত ২৩ জানুয়ারি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কার্যক্রম শুরুর কথা থাকলেও না জটিলতায় তা পিছিয়ে গেছে। মজার ব্যাপার হলো, এই যে সময়মতো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা গেল না, সে জন্য মিয়ানমার কিন্তু দায় চাপাচ্ছে বাংলাদেশের ওপরেই। দেশটির আন্তর্জাতিক সহযোগিতাবিষয়ক মন্ত্রী কিয়াউ তিন সাংবাদিকদের বলেছেন, তাঁর দেশ চুক্তি অনুযায়ী যেকোনো সময় রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে প্রস্তুত আছে। কিন্তু বাংলাদেশই প্রস্তুত নয়।
গণমাধ্যমে এ রকম খবর এসেছে যে, কিছু এনজিও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন রোধে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া দিয়ে উসকানি দিচ্ছে। এ অভিযোগে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কিছু এনজিওর কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধও করা হয়েছে। বাস্তবতা হলো, রোহিঙ্গাদের একটা বড় অংশই মিয়ানমারে ফিরতে চায় বলে মনে হয় না। কারণ, যে ধরনের বিভীষিকার মধ্য দিয়ে তারা পালিয়ে এসেছে, সেই দগদগে স্মৃতি নিশ্চয়ই তাদের মনে আছে। মিয়ানমার সরকার, সেনাবাহিনী এবং সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের আচরণ তারা জানে। ফিরিয়ে নেওয়া হলেও সেখানে তাদের জীবন কতটা আরামদায়ক হবে, তা নিয়ে তাদের সংশয় রয়েছে।
নিজেদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ হয়ে প্রাণ নিয়ে তারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এখানে অন্তত দুইবেলা তারা খেতে পারছে। কিন্তু মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়ার পরে তাদের যেখানে রাখার প্রস্তুতি চলছে বলে আমরা খবর পাচ্ছি, সেগুলো মূলত কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। অর্থাৎ নাগরিক অধিকার তো দূরে থাক, সেখানে তারা নিজের ভিটেটুকুও পাবেন না। বরং সেই ক্যাম্পে কী ধরনের সংকট তাদের জন্য অপেক্ষা করছে, নতুন করে আবারও সেনা নির্যাতনের শিকার হতে হবে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং এ রকম একটি অনিশ্চিত বাস্তবতা মাথায় রেখে বাংলাদেশের ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গারা যে তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পড়তে চাইবে না, সেটিই স্বাভাবিক।
তার মানে কি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত? বাংলাদেশ ও মিয়ানমার যতই সমঝোতা বা চুক্তি করুক না কেন, মিয়ানমার যে এই দেশহীন জনগোষ্ঠীকে ফিরিয়ে নিয়ে তাদের মানবিক ও নাগরিক অধিকার দেবে না, সে বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আন্তর্জাতিক চাপে তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে আন্তরিক বলে কিছু কর্মতৎপরতা দেখানোর চেষ্টা করলেও আদতে তারা যে রোহিঙ্গাদের বোঝা বাংলাদেশের ওপরেই চাপিয়ে দিতে চায়, সেটি দশকের পর দশক ধরে প্রমাণিত।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই মিয়ানমার যে টালবাহানা করছে, তার সর্বশেষ সংস্করণ আবেদন ফরম। অর্থাৎ ফিরে যেতে আগ্রহীদের পূরণ করার জন্য যে বিশেষ ফরমটি মিয়ানমার সরকার সরবরাহ করেছে, সেটি পূরণ করাই এক জটিল প্রক্রিয়া। বাপদাদা চৌদ্দগুষ্টির বিবরণ থাকতে হবে, ছবি থাকবে এবং সেইসঙ্গে কিছু শর্ত।
প্রশ্ন হলো, এই জটিল ফরম পূরণ করেই যদি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে হয়, তাহলে বাংলাদেশ কেন প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার নিবন্ধন করল? যদি এই নিবন্ধন প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় কোনো কাজেই না লাগে, তাহলে কেন আন্তর্জাতিক মহলও এ রকম নিবন্ধনের তাগিদ দিয়েছিল এবং এই জটিল ফরম পূরণের নামে মিয়ানমার যে নতুন কৌশল নিচ্ছে, সে বিষয়ে এখন আন্তর্জাতিক মহল কী বলবে?
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাইয়ের নামে যে প্রক্রিয়ার কথা বলছে, সেটি দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। যাচাই-বাছাই শেষে মিয়ানমার যাদের রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দা ছিল বলে মনে করবে, শুধু তাদেরই ফেরত নেবে। অর্থাৎ মিয়ানমার সরকার যাকে খুশি বলে দিতে পারবে যে, সে রোহিঙ্গা নয়। এই অস্বীকৃতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কী করতে পারবে?
সমস্যা হলো, এই সংকট সমাধানে কোনো থার্ড পার্টি বা তৃতীয় পক্ষ যেমন জাতিসংঘ, ইউএনএইচসিআর বা আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাকে (আইওএম) মিয়ানমার রাখতে রাজি নয়। তারা রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে যে ইঁদুর-বিড়াল খেলছে, সেখানে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী এখন অনেকটাই দর্শক। ফলে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের চাপে পিষ্ট বাংলাদেশের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যে ১০ লাখ রোহিঙ্গা আবির্ভূত হয়েছে, এই বোঝা কত দিন বইতে হবে এবং এর ফলে বাংলাদেশে অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশের যে ক্ষতি হবে, তা কীভাবে পোষানো যাবে, সেটিই এখন নতুন উদ্বেগের বিষয়।
লেখক : সাংবাদিক