আন্তর্জাতিক
শ্রীলঙ্কা নির্বাচনে মুখ্য হবে কোনটি?
ভোজবাজির মতো এক নির্বাচন, তারপর কাকতালীয় ফলাফল। সহসাই পাল্টে গেল শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কিংবা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকদের এ নিয়ে নানা মত, অভিমত, মতানৈক্য কিংবা দ্বিমত থাকতে পারে। কিন্তু সাধারণ পাঠক এবং আগ্রহীদের বোঝানোর জন্য বলা যেতে পারে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট টিমের উত্থান-পতনের কথা। হঠাৎ করেই ছন্দপতন কিংবা উল্লম্ফন যেভাবে চমকে দিয়েছে ক্রিকেট দর্শকদের; নির্বাচনের মঞ্চে মাহিন্দ্র রাজাপক্ষে কিংবা সিরিসেনার জয়-পরাজয় নামান্তরে রাজনৈতিক রূপান্তরের উত্তেজনা তার চেয়ে কম ছিল না কোনো অংশে।
গতবারের নির্বাচনে বহিঃশক্তির প্রভাব কিংবা অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন কোনটা বড় ভূমিকা রেখেছিল তা বড় প্রশ্ন নয়। এবারের নির্বাচন হাজির করেছে অনেকগুলো জিজ্ঞাসা। আজ হতে যাওয়া এই সংসদ নির্বাচনে শুধু লঙ্কানদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ঠিক করে দেবে না। পাশাপাশি অনেক দিক থেকে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভূরাজনীতির গতিপথ কী হতে পারে সেদিকেও আলোকবিক্ষেপ করবে এ নির্বাচন। বিশেষভাবে দৃষ্টি দিলে ভারত মহাসাগর বিশ্বের নানা স্থানে বাণিজ্য ও জ্বালানি পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। কারণ এ সাগরপথ দিয়েই বিশ্বের অর্ধেক কনটেইনার ও দাহ্য তেলের ৭০ শতাংশ পরিবহন হয়। অন্তত আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকরা মানতে রাজি নন যে চীনের জন্য শ্রীলঙ্কার আর্থ-রাজনৈতিক গুরুত্ব এখন বিনষ্ট হয়েছে। তবে চীন ভারত মহাসাগরে অস্তিত্ব শক্তিশালী করার চেষ্টা করলে সংকট বাড়বে নানা দিক থেকে। অন্তত তাদের এ চেষ্টার মুখে ভারত কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের চুপ করে বসে থাকার সুযোগ নেই।
সিরিসেনা নাকি রাজাপক্ষে! এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেওয়ার আগে অনেক জরুরি তাদের রাজনৈতিক অবস্থান কিংবা পূর্ব জীবনের দিকে দৃষ্টি দেওয়া। সামান্য স্মৃতিকণ্ডুয়ন জানান দেয় আসন্ন নির্বাচনে অন্যতম একজন প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষে তাঁর মর্মান্তিক পরাজয়ের আগে নয় বছর দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। অহেতুক কর্তৃত্বপরায়ণ শাসন, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি ও নীতিগর্হিত কিছু সিদ্ধান্ত তার শেষ দিন এনে উপস্থিত করে। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষণ বলছে অনেকগুলো কথা। সেখানে অভ্যন্তরীণ সংকট কিংবা রাজনৈতিক সমস্যা থেকে ভিন্ন কোনো বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত উঠেছে বেশি। তা না হলে ঐতিহাসিকভাবে দেশটির শাসনক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর রাজাপক্ষের এমনি করুণ পরাজয় ঘটার উপযুক্ত কারণ মিলছে না। একটু ফ্লাশব্যাকে গেলে সবাই মনে করতে পারবেন সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার ২৬ বছর ধরে চলা তামিল বিদ্রোহ সমাপ্তির দিকে টেনে নিতে সক্ষম হন। কিন্তু এমন কী ঘটল যা রাতারাতি শ্রীলঙ্কার সিংহভাগ সিংহলি মানুষের চোখে পুরোদস্তুর বীর রাজাপক্ষেকে খোঁয়াড়ের ভীত জন্তুতে পরিণত করল?
এ হিসাব মেলাতে না পেরে অনেকেই নানাবিধ প্রশ্ন মনে ঠাঁই দিতে শুরু করেন। আর বিরোধী পক্ষ বলছে রাজাপক্ষের নৃশংস আচরণের কথা। তাদের হিসাবে তামিল বিদ্রোহ দমনের নামান্তরে চলা নির্মম অভিযানের মাধ্যমে রাজাপক্ষে এক ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার পৈশাচিক উন্মত্ততায় তামিল বিদ্রোহীদের ওপর আঘাত হানার সিদ্ধান্তে প্রাণ খোয়া যায় ৪০ হাজার নিরীহ মানুষের। অন্যদিকে দাপুটে শাসক রাজাপক্ষের শাসনকালে ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সম্পর্ক ক্রমশ খারাপ দিকে মোড় নিতে শুরু করে। এর বড় কারণ রাজাপক্ষের সরকার সংখ্যালঘু তামিলদের সঙ্গে সংঘাত ও সামাজিক সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি বরং উসকে দিয়েছে নানা দিক থেকে। এর ফলে পুরো শ্রীলঙ্কার সরকার কাঠামো একটি নড়বড়ে অবস্থানের মধ্যে পড়ে যায়। অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী পরাশক্তির সঙ্গে আঁতাত না করে বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা তাঁর বিপদ আসন্ন করে তোলে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকদের কেউ কেউ সরাসরি মন্তব্য করেছেন রাজাপক্ষ আসলে বুঝে উঠতে পারেননি কী করতে হবে, আর কী করা তাঁর জন্য উচিত নয়।
উপমহাদেশের রাজনীতিতে শ্রীলঙ্কার গুরুত্ব হতে পারে বহির্দেশীয় পরাশক্তির একটি ল্যান্ডিং স্টেশন হিসেবে। আর সেদিক থেকে ধরলে রাজাপক্ষের সময় চীনের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সম্পর্কের অগ্রগতি ভারত ভালো চোখে দেখেনি। বিশেষ করে পাশের পরাশক্তি ভারতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নামসর্বস্ব কিছু চীনা প্রতিষ্ঠান শ্রীলঙ্কায় অনেক কাজ করার সুযোগ পায়। বলে রাখা ভালো চীনের ‘মেরিটাইম সিল্ক রোড’ পরিকল্পনায় শ্রীলঙ্কা এক গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডিং স্টেশন বৈকি। এশিয়ার সঙ্গে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের যোগাযোগ স্থাপন করার পাশাপাশি বাণিজ্য বিস্তারে এ পথের গুরুত্ব দিনদিন বাড়ছে। আর যাই হোক, অন্ধ ব্যক্তিও বুঝবেন চীনের এই অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বার্থের বিষয়টি অন্তত ভারতের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আর তার সরাসরি জবাব হয়তো রাজাপক্ষের চালচুলোহীন অবস্থায় পরাজয় বরণ?
রাজাপক্ষের উত্তরসূরি মাইথ্রিপালা সিরিসেনা ও প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে যদি ধরে নিতে পারেন কী থেকে গভীর কূপে নিক্ষিপ্ত হয়েছে তাঁর নেতা, তবে তা ভূমিকা রাখবে নির্বাচনের ফলাফলে। বিশেষ করে রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে নির্বাচনের লড়তে গিয়ে সিরিসেনা একটা পুরান গানে ধুয়ো তুলেছিলেন যে চীনকে সব কাজে ঠাঁই দেওয়াতে শ্রীলঙ্কার সংকট ঘনীভূত। আর তার থেকেই ভাতের সুনজর তাঁদের ওপর, আর শেষটায় এসে একই নির্বাচনে রাজার আসনে সিরিসেনা আর রাজা থেকে ভিখিরির চেয়ে যাচ্ছেতাই স্থান রাজাপক্ষের। আর অল্প কিছু সময়ের অপেক্ষা; আন্তর্জাতিক স্বার্থ নাকি কর্মফল কী মুখ্য হবে শ্রীলঙ্কা নির্বাচনে? আর সে প্রশ্নের উত্তর পেতে অপেক্ষা করতে হবে বিজয়মালা কার গলায় উঠছে সেটার জন্য।
লেখক : পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।