প্রতিক্রিয়া
আমাদের বিমান, আমাদের স্বজন
নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে বাংলাদেশের বেসরকারি ইউএস-বাংলা এয়ারের জাহাজটি কেন বিধ্বস্ত হলো? পাইলটের সঙ্গে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় ভুল বোঝাবুঝি ছিল, নাকি বিমানটি ত্রুটিপূর্ণ অথবা চালক অসাবধান ছিলেন, কেন দুর্ঘটনার পরপরই বাংলাদেশ থেকে বিশেষ বিমান নেপালের উদ্দেশে রওনা হলো না––ইত্যাদি প্রশ্ন করাই যায় এবং সঠিক তদন্ত হলে এসব প্রশ্নের জবাবও মিলবে আশা করা যায়। কিন্তু এসব প্রশ্ন ছাপিয়ে যে নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি আমরা, তা হলো বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ এই বিমান দুর্ঘটনায় আমরা হারিয়েছি আমাদের অনেক স্বজন, বন্ধু, সহযোদ্ধাকে। সেইসব হতভাগার পরিবারে এখন কান্নাই সম্বল।
কোনো মৃত্যুই কাঙ্ক্ষিত নয়; কিন্তু এটিই নিয়তি। আমাদের কে কখন কোথায় কীভাবে মারা যাব, তা আমাদের জানা সম্ভব নয়। সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার পরও মানুষ মৃত্যুকে এড়াতে পারে না। খুব ছোট দুর্ঘটনায়ও অনেকের মৃত্যু হয়। আবার নেপালের এই ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার পরও অনেকে বেঁচে গেছেন। যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, তার জন্য তাঁরা কোনোভাবেই দায়ী নন। আবার যাঁরা বেঁচে গেছেন, সেখানে তাঁরা যে খুব বেশি কৌশল করে বেঁচে গেছেন, তা-ও নয়। বরং যাঁরা মরে গেছেন, এটি তাঁদের নিয়তি। আবার যাঁরা বেঁচে গেছেন, সেটি তাঁদের সৌভাগ্য। সুতরাং কে নিয়তির শিকার হবেন আর কে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাবেন, তা কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। ফলে আমরা এখন কেবল আমাদের স্বজন হারানোর বেদনায় আহতই হতে পারি, দুঃখে ভারাক্রান্ত এবং সরবে কিংবা নীরবে অশ্রুপাত! সেইসব পরিবারের জন্য সমবেদনাও জানাতে পারি। যদিও এসব সমবেদনা কখনো কখনো সন্তানহারা মায়ের কাছে পরিহাসের মতোই মনে হয়।
নেপালে বিধ্বস্ত ওই বিমানের যাত্রীদের সবাই বিমার আওতায় ছিলেন। ফলে নিহতদের পরিবার ক্ষতিপূরণ পাবে। হয়তো সরকারের তরফেও এই পরিবারগুলোর জন্য আর্থিক সহায়তার ঘোষণা আসবে। নিহতদের স্মরণে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণাও হতে পারে। কিন্তু তাতে ওই নিহতদের বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধু-স্বজনের মনের ক্ষত দূর হবে না।
বৈশাখী টিভির রিপোর্টার ফয়সাল আহমেদ। আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় না থাকলেও পেশাগত কারণে তাঁর মৃত্যুসংবাদ আমাদের ব্যথিত করেছে। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগে কর্মরত উম্মে সালমা ও নাজিয়া আফরিন অফিসের কাজে যাচ্ছিলেন নেপাল। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে তাঁদেরও প্রাণ। পেশাগত কারণে বিভিন্ন সময়ে পরিকল্পনা কমিশনে গিয়েছি। হয়তো তাঁদের সঙ্গে আমার দেখাও হয়েছে। সুতরাং এত মৃত্যুর মিছিলে আমরা কতজনের জন্য শোক করব? আমাদের চোখের পানি তো সমুদ্রের মতো অজস্র নয়।
বাংলাদেশের নিজস্ব বেসরকারি বিমান পরিবহন কোম্পানিগুলোর মধ্যে ইউএস-বাংলার সুনাম অন্যদের চেয়ে তুলনামূলক বেশি। তাদের ৯টার প্লেন ৯টায়ই ছাড়ে। এর আগে অভ্যন্তরীণ রুটের একাধিক কোম্পানি যেমন অ্যারো বেঙ্গল, জিএমজি, ইউনাইটেড বন্ধ হয়ে গেছে। সেই বাস্তবতায় ইউএস-বাংলা মোটামুটি দ্রুত সময়েই যাত্রীদের কাছে আস্থার প্রতীক হয়ে উঠছিল এবং দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের আকাশেও যখন তাদের সুমান ছড়িয়ে পড়ছিল, ভয়াবহ দুঃসংবাদটি আমরা তখনই পেলাম।
প্রশ্ন উঠছে, এ ঘটনা আকাশপথে বাংলাদেশের উড়োজাহাজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করবে কি না বা বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান পরিবহন ব্যবসার ক্ষতি করবে কি না? এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, অতীতে বিশ্বের অনেক নামীদামি কোম্পানির বিমানও বিধ্বস্ত হয়েছে। কখনো বৈরী আবহাওয়া, কখনো যান্ত্রিক ত্রুটি, আবার কখনো অজ্ঞাত কারণে। অনেক সময় বিমানের ব্ল্যাকবক্সও পাওয়া যায়নি। ফলে বিমান বিধ্বস্তের কারণ রহস্যই থেকে গেছে। কিন্তু তারপরও ওই সব কোম্পানি বা দেশের বিমান ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যায়নি। সুতরাং ইউএস-বাংলার বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে মানেই বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে বা বিহির্বিশ্বে ভাবমূর্তির সংকটে পড়বে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই; বরং কী কারণে এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটল, সেই কারণ উদ্ঘাটন এবং ভবিষ্যতে এ রকম পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য কী করণীয়, তা নির্ধারণই এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
আমরা নিহতদের আত্মার শান্তি কামনার পাশাপাশি এই প্রত্যাশাও করি যে, বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান পরিবহন ব্যবসাকে যেসব চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হয়, বিশেষ করে জেট ফুয়েলের অতিরিক্ত দাম—সেই সমস্যা সমাধানে সরকার উদ্যোগী হবে এবং দেশে-বিদেশের আকাশে বাংলাদেশের বিমান সগর্বে পাখা মেলে উড়বে, এই প্রত্যাশা।
একটা প্রশ্ন দিয়ে লেখাটা শেষ করি। বিমান দুর্ঘটনা অবশ্যই বড় খবর। কারণ বিমান দুর্ঘটনা সচরাচর হয় না। তাই ছোট-বড় যে ধরনের দুর্ঘটনাই ঘটুক না কেন, আমরা সংবাদমাধ্যমে এটিকে শিরোনাম হতে দেখি। এমনকি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে একজন নিহত হলেও সেটিকে টেলিভিশনের সংবাদ শিরোনাম হিসেবে পাই। অথচ প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় দু-চার-দশজন মানুষের প্রাণহানি হয়। কিন্তু সেই খবরগুলো আমাদের এতটাই গা সওয়া হয়ে গেছে যে সড়ক দুর্ঘটনায় একসঙ্গে ১০-১২ জন নিহত না হলে আমরা এখন আর এগুলো প্রধান শিরোনাম করতে আগ্রহী হই না। অথচ বিমান দুর্ঘটনায় যে ৫০ জন নিহত হলেন, সেই ৫০ জন মানুষের যে জীবনমূল্য, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৫০ জনের জীবনের মূল্যও সমান। এসব ঘটনায় আমরা কেবল মানুষকেই পরাজিত হতে দেখি। পক্ষান্তরে, জিতে যায় মৃত্যু।
লেখক : সাংবাদিক।